সকল মেনু

তালাকের কারণেই চাঁদপুরে তিন খুনের ঘটনা ঘটেছে

unnamed শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর: সদর উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের কামরাঙ্গা গ্রামে গত ২০ এপ্রিল সংগঠিত তিন খুনের নেপথ্য অনুসন্ধান করতে যেয়ে বেরিয়ে এসেছে হত্যাকান্ডগুলোর কারণ প্রেমের বিয়ে আর বিয়ের ক’ বছর পরে তালাক। সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেলো। ১১ দিনের মুঠোফোনের পরিচয়ে স্কুল ছেড়ে বিয়ে, এরপর স্বামীর সাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংসার করা এবং সন্তানের মা হওয়া। মা হওয়ার পর স্বামীর অত্যাচার দিন দিন মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় স্বামীকে তালাক দেয় লাকী। শুধুমাত্র এই তালাকের কারণেই ঘাতক স্বামীর হাত থেকে ভাগ্যগুণে নিজে বেঁচে গেলেও বাঁচাতে পারেনি বাবা আর মাকে। এ কথা বলেই কেঁদে উঠে লাকী।
সরজমিন কামরাঙ্গা গ্রামের মিজি বাড়িতে গেলে দেখা যায় তিন খুনের ঘটনার কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও বাড়িতে উৎসুক শতশত নারী-পুরুষের ভিড়। এর মধ্যে লাকীর চাচার ঘরের সামনে কথা হয় লাকীর সাথে। তিনি তার অতীত জীবনের সোনালী দিন থেকে শুরু করে তালাকের কথা আর বাবা-মাকে হত্যার দিন রাতে তিনি কি পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন এই কথাগুলো অনর্গল বলতে শুরু করেন। মাঝে মাঝে চোখের পানি গাল থেকে গলা গড়িয়ে নেমে আসে আর আঁচলে চোখ মুখ মুছতে থাকেন। মাথার সামনের দিকে সেলাই ও হাতে ব্যান্ডেজ করা লাকীর দিকে উৎসুক নারী-পুরুষ চেয়ে থাকে। এর মধ্যে কেউ তাকে ধিক্কার জানায় কেউ আবার লাকীর কান্নার সাথে নিজেদের চোখের পানি মুছে।
লাকী জানান, ২০১০ সালে তিনি স্থানীয় বাকিলা উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে পড়তেন। সে সময় তার বাবা ইকবাল হোসেন বুলু (৪৫) প্রবাসে থাকতেন। এরই মধ্যে মুঠোফোনের মাধ্যমে সুমন শেখের সাথে যোগাযোগ হয়। ফোনের পরিচয়ে হঠাৎ করেই কেনো জানি সুমনকে তার অনেক বেশি মনে ধরে বসে। মাত্র ১১দিনের সম্পর্কের সূত্র ধরে স্কুল থেকে সুমন লাকীকে নিয়ে খুলনার খালিশপুর এলাকায় যায় সুমনের ভাই-বোনদের কাছে। সে সময় সে বলেছিলো তাদের বাড়ি সাভার এলাকায়। বিয়ের অনেক পরে লাকী বুঝতে পারে তার জীবনের পুরুষ সুমন শেখের আরেকটি স্ত্রী ও একটি ছেলে রয়েছে। এরই মাঝে সে বুঝতে পারে সে নিজে মা হতে চলেছে। তাই নিরুপায় হয়ে স্বামীকে মেনে নিয়ে সংসার শুরু করে। তখন বুঝতে পারেন সুমন তাস, জুয়া খেলতো। লাকী আরো বলেন, তখন আমি নিজেকে আস্তে আস্তে গুঁটিয়ে নিতে শুরু করি। এর পরেই আব্বু দেশে এসে সাভার এলাকার আমাদের ভাড়া বাসায় আমার কাছে যায়। সে সময় আব্বু আমার মামা শ্বশুর নাছিরের কাছ থেকে সব শুনে। এরই মধ্যে কয়েক বছর কেটে যায়। পরে গত ২৮ মার্চ তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠাই। তখন সে আমাকে ফোনে বলে তুমি যদি এক সপ্তাহের মধ্যে কোনো ডিভোর্স লেটার পাঠাও তাহলে আমার নাটক দেখবা। তখন আমি তাকে বলি আমি তো ডিভোর্স দিয়েই দিছি।
লাকী সে ভয়ঙ্কর রাতের ঘটনা বলতে গিয়ে বলেন, এদিন রাতে সে (সুমন) আব্বুর সাথে বাড়ি আসলে আব্বুকে বলি, আব্বু তার সাথে না ডিভোর্স হয়ে গেছে, তুমি কেনো তাকে বাড়ি আনলে। তাকে চলে যেতে বলো, বেশি রাত হলে বাস পাবে না। তখন সে আব্বুকে বলে, আব্বু আমি ভালো হয়ে গেছি, আমি কাল সকালে লাকীকে নিয়ে যাবো। তখন আব্বু তাকে বলে, আমি মেয়ে দেবো না, যদি পারো ইনকাম করে এখানে দাও, আমি ঘর দরজা করে দেই, এখানেই থাকো। আর তুমি যখন এসেছো ঠিক আছে থাকো, সকালে কথা হবে। এখন ভাত খাও। তখন তাকে আমি শরবত দেই আর আব্বুর সাথে ভাত দিলে সে ভাত খায়নি। আমি তখন বুঝতে পারি তার ভেতরে রাগ আছে। পরে সে আমাকে বলে সকালে আমার সাথে যেতে হবে কাপড় গুছিয়ে রাখো। তখন আমি বলি আগে সকাল হউক । সে ভেতরে ভেতরে অনেক ভয়ঙ্কর আমি জানতাম। সে জন্যই আমি সাইড হয়ে যাই।
রাতে সে, আব্বু ও আম্মু এক ঘরে আর আমি আমাদের অন্য ঘরে ঘুমাই। হঠাৎ করেই রাত ৩টার দিকে সে আমার ঘরের দরজা ধাক্কাতে শুরু করে। তখন আমি ভেতর থেকে বলি তুমি এমন করতাছ কেন? আমার ঘরের দরজা সামনে দিয়ে লক করা ছিলো আর চাবি ছিলো আম্মুর কাছে। সে চাবি দিয়ে দরজা খুললেও আমার ঘরের দরজা ভেতর দিয়ে বন্ধ থাকার কারণে ও ঘরে ঢুকতে না পেরে একবার চালের কাছে উঠে আবার নীচ দিয়ে হাতের মাধ্যমে দরজা খোলার চেষ্টা করে। এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা পার হয়ে যায়। আমি চুপ করে ঘরের ভেতরে বসে পুরাতন বাড়িতে সায়েম কাকার কাছে ফোন করার সময় সে দরজা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকেই আমার মাথায় আঘাত করে। কোনো কিছু না বুঝে আমি মাথায় হাত দিয়েই বলি তুমি কি করতাছ, আব্বু-আম্মু কোথায়। তখন সে বলে তারা রাস্তায় গেছে। আমি বলি এতো রাতে তারা রাস্তায় কেন যাবে? এর পরেই সে আমাকে মারার জন্য গলায় ধরে উপরে উঠিয়ে ফেলে। তখন আমি তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে আঘাত করি। অন্ধকারের মধ্যে তার হাত পিচ্ছিল মনে হয়েছে। এর পরেই সে আমার চুলের মুঠি চেপে ধরে। এ সময় তার হাত ভেজা থাকার কারণে আর অনেক জোরাজুরি করার পর তার হাত থেকে চুলের মুঠি ছুটে যায়। এ সময় তার হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি অনেক যুদ্ধ করি। এর পরেই আমি এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে পুকুরে পড়ে যাই। পুকুর থেকে উঠে ডাক-চিৎকার দিতে শুরু করি যেনো আশপাশের লোকজন এসে আমাদেরকে উদ্ধার করে। এর পরেই আশপাশের লোকজন আসতে শুরু করে। লাকী আরো বলেন, আমি তাকে ডিভোর্স দিছি সেটাই মনে হচ্ছে আমার ভুল। সে আমাকে প্রায় সময় মারতো, তাই আমার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন সবাই আব্বুকে বলতো মেয়েটাকে দিস না, সে মেরে ফেলবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে লাকী জানান, তার কাছ থেকে শুনেছি তাদের বাড়ি বরিশাল। আবার মামা শ্বশুরের কাছ থেকে শুনেছি ঝালকাঠি, আর তার বোনেরা থাকে ঢাকার সাভারে। তাদের আসল বাড়ির বিষয়ে আমি সঠিক বলতে পারবো না। লাকীর একমাত্র ছোট ভাই সাগর সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে জানায়, আমার ভবিষ্যত বলতে আর কিছুই নেই। শখ ছিলো কলেজে ভর্তি হবো। এখন তো আর আমার মা-বাবা নেই, এ কথা বলেই সাগর অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলো। নিহত ইকবাল হোসেন বুলুর বয়স্ক পিতা সলেমান মিজি রক্তমাখা একটি গামছা হাতে নিয়ে কেঁদে কেঁদে বলছেন এই গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে কোন্ ডাকাতে আমার ছেলেকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে মারলো।
উল্লেখ্য, গত ১৯ এপ্রিল ভোর রাতের কোনো একসময় চাঁদপুর সদর উপজেলার ৫নং রামপুর ইউনিয়নের উত্তর কামরাঙ্গা মিজি বাড়িতে একমাত্র জামাতার হাতের অস্ত্রের আঘাতে গুরতর আহত হন শ্বশুর ইকবাল হোসেন বুলু আর শাশুড়ি মমতাজ বেগম এবং এই দম্পতির একমাত্র মেয়ে লাকী আক্তার শারমিন। ভোরে স্থানীয়দের সহায়তায় আহতদের হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদেরকে কুমিল্লা রেফার করে। এরই মধ্যে ইকবাল হোসেন বুলু মারা যান আর মমতাজ বেগম কুমিল্লা নেয়ার পরে মারা যান।
নিহত উভয়ের মাথার পেছনের অংশে বড় ধরনের আঘাতের বেশ কয়েকটি চিহ্ন ছিলো বলে হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসরা জানান। এই দুই মার্ডারের ঘটনায় কামরাঙ্গা এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। এ বিষয়ে তদন্তে আসেন জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ জেলা গোয়েন্দো পুলিশের দল। দিন শেষে ময়না তদন্তের পর স্বামী-স্ত্রীর লাশ বাড়ি আসার পরেই মিজি বাড়ির পাশে ইরি ধানের ফসলি জমিতে খোঁজ মিলে ঘাতক জামাই সুমন শেখের। মুহূর্তেই শত শত এলাকাবাসী জড়ো হয়ে সুমন শেখকে ধানের জমিতেই গণপিটুনি দেয়। ঘটনাস্থলেই সুমন শেখের মৃত্যু ঘটে। আর এভাবেই একদিনে ঝরে পড়ে তরতাজা ৩টি প্রাণ। নিহতরা সকলে পরিবারের জন্য রেখে যান ভয়াবহ দুঃসহ এক স্মৃতি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top