সকল মেনু

ছিঁচকে চোর থেকে সিরিয়াল কিলারের তালিকায় রসু খাঁ

unnamed শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর: সংবাদপত্র ও প্রিন্ট মিডিয়ার বদৌলতে রসু খাঁ নামটি মোটমুটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মানুষের কাছে কম-বেশি পরিচিত। ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই নামের লোকটিকে নিয়ে মিডিয়ায় হুলস্থুল পড়ে যায়। পর পর বেশ ক’দিন সে মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রাখে। কারণ, এই নামের লোকটি বাংলাদেশের একজন সিরিয়াল কিলার হিসেবে মিডিয়ার কাছে চিহ্নিত হয়েছে। ১০১ জন মহিলাকে খুনের শপথ নিয়ে নেমে ১১ টি খুনের পর ছিঁচকে চোর হিসেবে এতদিন পরিচয়লাভকারী এই লোকটি মসজিদের ফেন চুরির ঘটনায় ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। তারপর তার জবানীতেই বেরিয়ে আসে তার বিকৃত মানসিকতা ও খুনের চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন তথ্য। গত ২২ মার্চ তাকে চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ অরুনাভ চক্রবর্তী একটি মামলায় ফাঁসির আদেশ তেবার পর পুনরায় আলোচনায় এসে গেছে সিরিয়াল কিলার রসু খাঁ। তার বিরুদ্ধে আরো ৮ টি মামলা চলমান। প্রান্তিক একটি কৃষক পরিবারে জন্ম নেয় আত্মস্বীকৃত এই খুনী রশিদ খাঁ ওরফে রসু খাঁ (৪৪)। তার বাবা আবুল হোসেন ওরফে মনু খাঁ ছিলেন একজন ক্ষেতমজুর। ফরিদগঞ্জ থানার সীমানা এলাকায় অবস্থিত চাঁদপুর সদর উপজেলার মদনা গ্রামের খাঁ বাড়ি তাদের। প্রায় ২৫  বছর আগে তার বাবা মারা যায়। মনু খাঁ’র মৃত্যুর কিছুদিন পর বাবার রেখে যাওয়া ৩০/৩৫ শতক জমি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয় প্রতিবেশীদের সাথে। সংসারে অভাব দানা বাধে। এলাকায় ছোট-খাট চুরির সাথে জড়িয়ে পড়ে সে।  এক পর্যায়ে বাবার মৃত্যুর ২/৩ বছর পর তার মা কিছু জমি বিক্রি করে ঢাকার টঙ্গীতে বসবাসরত বড় মেয়ে হাফছা বেগমের কাছে চলে যায়। ২ ভাই ২ বোনের মধ্যে রসু খাঁ দ্বিতীয়। অপর ভাই বসু খাঁ নিরুদ্দেশ। ছোট বোন জান্নাত বেগম জর্ডান প্রবাসী। টঙ্গী চলে যাওয়ার পর ভবঘুরে দিন কাটে তার। কখনো রিক্সা চালিয়ে, কখনো হোটেলে মেসিয়ারি করে, কখনো হাঁস-মোরগসহ ছিঁচকে চুরি করে জীবন কাটাতে শুরু করে। ২০ বছর আগে সে বিয়ে করে পার্শ্ববর্তী লাড়ুয়া গ্রামের বেপারী বাড়িতে। বিয়ের আগে ঘটক তাকে মেয়ে দেখতে দেয়নি। রসু খাঁ বলে, বাসর ঘরে ঢুকে দেখি বউয়ের ডান চোখ কানা। ২ বছর পর বউ গর্ভবতী হয়। এরপর ওই বউকে শ্বশুর বাড়ি রেখে শ্যালিকা রীনা বেগমকে নিয়ে চলে যাই টঙ্গী। দ্বিতীয় বিয়ের পর স্ত্রী রীনাকে নিয়ে বসবাস শুরু করে টঙ্গীর নিরাশপাড়ায়। সেখানকার বাবু কমিশনারের এলাকায় জনৈক বাবলু মিয়ার বাড়িতে ৫শ’ টাকায় বাসা ভাড়া নেয়। পরে স্ত্রী রীনাকে গার্মেন্টসে চাকুরি করতে দেয়। রসু খাঁ জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতের সাথে। চুরিদারি করাই ছিল তার শ্রধান পেশা হয়ে দাঁড়ায়। টঙ্গীর বিভিন্ন স্থানসহ মাঝে মধ্যে নিজ এলাকায় এসে চুরিদারি করে আবার টঙ্গী ফিরে যেত। রসু খাঁ’র বর্ণনা মতে, স্ত্রীর গার্মেন্টস্ চাকুরির সুবাদে বিভিন্ন গার্মেন্টস্ কর্মী মেয়েদের সাথে তার পরিচয় ঘটে। এরই এক পর্যায়ে কোহিনুর নামের এক গার্মেন্টস শ্রমিকের সাথে প্রেম হয় তার। ওই মেয়েটি একই সাথে এলাকার অন্য এক ছেলের সাথে প্রেমে জড়ায়। এতে রসু খাঁ বাধ সাধলে ওই মেয়ে তার প্রেমিকের সহযোগিতায় ৫/৬ জন ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী দিয়ে ১টি পাঁচতলা ভবনের ছাদে তুলে বেদম মারধর করে তাকে। সেদিনই সে প্রতিজ্ঞা করে, ১০১ জন নারীকে ধর্ষণ শেষে খুন করবে। তারপর দরবেশ বনে মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়াবে। সে অনুযায়ী সে অপেক্ষাকৃত তরুণ মেয়েদের সাথে প্রেমের ভাব গড়া শুরু করে। এদের মধ্যে গার্মেন্টস্ কর্মীই বেশি। এক পর্যায়ে সে টাকার বিনিময়ে ভাড়াটিয়া খুনি হিসেবেও কাজ করতে থাকে। তার এসব খুনের নিয়মিত কোনো সহযোগী ছিলো না বলে সে জানায়। তবে ২/৩ ঘটনার সাথে ইউনুছ (৩৬) ওরফে হক সাহেব নামের একজন জড়িত ছিলো। প্রত্যেকটি খুনের সময় কোনো না কোনো সহযোগী তার সাথে ছিল। খুনের আগে সে নিজে ধর্ষণ করতো। পরে সুযোগ দিতো সহযোগীদের। তবে তার মাধ্যমে ধর্ষণ ও খুনের শিকার প্রায় প্রত্যেকটি লাশেরই পরিচয় অজ্ঞাত থাকতো। ফরিদগঞ্জ, পার্শ্ববর্তী হাইমচর উপজেলা ও চাঁদপুর থানার ভেতরে তার হাতে খুন হওয়া লাশগুলোর ১১টিই অজ্ঞাত হিসেবে আঞ্জুমানে খাদেমুল ইনসানের মাধ্যমে দাফন হয়েছে। এসব খুনের ঘটনায় ফরিদগঞ্জ থানায় ৬টি, চাঁদপুর মডেল থানায় ৪টি এবং হাইমচর থানায় একটি খুনের মামলা দায়ের হয়। এর মধ্যে ৮টি মামলারই ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়। মাত্র ১টি মামলার চার্জশীট হয়। রসু সেই মামলার আসামী। কিন্তু পুলিশের খাতায় রসুর মৃত্যু হয়েছে এমনটি উল্লেখ ছিল। ধরা পড়ার পর ওইসব মামলাগুলো পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এমন একটি মামলায় গার্মেন্টস্ কর্মী শাহিদা হত্যার দায়ে গত বুধবার তার ফাঁসির আদেশ হয়। পুলিশ ও সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদে রসু খাঁ বলে, খুন করা নারীদের কারো নামই সে জানে না। তার হাতে খুনের শিকার ১১টি লাশই উদ্ধার করা হয় নদী, খাল বা ডোবার পাশ অথবা পানি থেকে। বেশির ভাগ হত্যাকান্ডের আগে অথবা পরে সে ওই মহিলাদের হাত ও পা বেঁধে পানিতে ফেলে দিতো। মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত সে তাদের পানিতে চেপে ধরে রাখতো। কখনো মুখে কাপড় গুঁজে গলা টিপে হত্যা করতো। কোনো গৃহবধূর পারিবারিক বিরোধের ফলে অথবা অন্য কোনো নারী/মেয়েকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে এমনি প্রস্তাব বা সুযোগ পেলেই সে ওই সুযোগ গ্রহণ করতো। খুনের বিনিময়ে সে টাকাও নিয়েছে। তার এমনি খুনের হাত থেকে তার শালার বউও বাঁচতে পারেনি। প্রায় ১০  বছর আগে তার শালা আঃ মান্নান তাকে বলে যে, তার গার্মেন্টস্ কর্মী বউ অন্য ছেলেদের সাথে দৈহিক মেলামেশা করে। এদের মধ্যে একটি হিন্দু ছেলেও আছে। এজন্যে শালার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এরপর দুজনে মিলে ফরিদগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে আসার নাম করে ১৯ জুন ২০০৭ খ্রিঃ তারিখে শালার বউকে ফরিদগঞ্জের ৯নং ইউনিয়নের ভাটিয়ালপুর গ্রামে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে একটি হিন্দু বাড়ির কাছে নিয়ে যায়। তারপর দুজনে মিলে ফুসলিয়ে নদীর পাড়ে তাকে ধর্ষণ শেষে মুখে কাপড় গুঁজে দিয়ে হাত-পা বেঁধে নদীর পানিতে চুবিয়ে ও গলা টিপে হত্যা করে। হত্যা শেষে দুজনে ফিরে যায় ঢাকা। আরেকটি ঘটনায় টঙ্গীর জনৈক বাড়িওয়ালা শাহীন ও সহযোগী ইউনুছের প্ররোচনায় ও সহযোগিতায় এক পতিতাকে টঙ্গী থেকে এনে ফরিদগঞ্জের হাঁসা গ্রামে একইভাবে ধর্ষণ শেষে দু’ পায়ের সাথে দু’ হাত বেঁধে গলা টিপে হত্যা করে খালের পানিতে ফেলে দেয়। ঘটনাটি ২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতের। অপর এক ঘটনায় টঙ্গী নিরাশপাড়ার মানিক নামে রসুর এক মুদি ব্যবসায়ী বন্ধুর বউ মিলে টঙ্গীর এক গার্মেন্টস্ কর্মীকে ফরিদগঞ্জের হাঁসা গ্রামের একটি বিলে এনে ধর্ষণ শেষে একইভাবে হত্যা করে পার্শ্ববর্তী ডোবায় লাশ ফেলে দেয়। এজন্যে বন্ধুর বউ তাকে নগদ ৫ হাজার টাকাও পুরস্কার দেয়। এ হত্যাকান্ডের পেছনে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে, বন্ধু মানিক এ গার্মেন্টস্ কর্মীর সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। সে তাকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। তাদের এ মেলামেশা বন্ধুর বউর কানে গিয়ে পৌঁছে। পরে বন্ধুর বউয়ের অনুরোধে বন্ধুকে রাজি করিয়ে এ কাজ করায় সে। এভাবে কখনো কোনো মেয়ের সাথে নিজে প্রেম করে চাপে পড়ে অথবা ভাড়ায় খেটে একের পর এক খুন করে ১১ নারীকে। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই সে থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে সে হয়ে ওঠে এক দুর্ধর্ষ কুখ্যাত খুনী। এমনিভাবে ২০০৯ সালের ৭ জুলাই ২০০৯ তার সর্বশেষ খুনের শিকার তিন সন্তানের জননী পারভিন আক্তার। স্বামী পরিত্যাক্তা চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের পালতালুক গ্রামের এই মহিলা ভিক্ষা করতো। তার সঞ্চিত টাকা নেবার জন্য রসু তাকে খুন করে। পরের দিন নিজেকে রিক্সাচালক পরিচয় দিয়ে নিজ বাড়িতে বিরোধ আছে এমন দুজনের নাম বলে পারভিনের খুনের সাথে তারা জড়িত বলে ফরিদগঞ্জ থানার ওসিকে জানায়। পরে মোবাইল থেকে সিম কার্ড খুলে ফেলে। পরে পুলিশ ওই দুজনকে ধরলেও মামলার কোনো ক্লু উদ্ঘাটন করতে পারেনি। ওই দু’ ব্যক্তিকে কোর্টেও চালান করা হয়। তারা ২/৩ মাস হাজত বাস করে জামিনে বেরিয়ে আসে। এদিকে রসু খাঁ ২০০৯ সালের জুলাই মাসে কোন এক রোজার রাতে ফরিদগঞ্জ উপজেলার গাজীপুর বাজারের কাছের একটি মসজিদের ১২টি ফ্যান চুরি করে পালিয়ে যাবার পথে এক আখ ব্যবসায়ীর হাতে ধরা খায়। লোকজন এসে গণধোলাই দিয়ে তাকে থানায় সোপর্দ করে। এতে সে চুরির মামলায় হাজত খেটে জামিনে বেরিয়ে যায়। ওদিকে ফ্যান চুরিতে ধরা খেলে আখের ব্যবসায়ী তার কাছ থেকে মোবাইল ও ওই সিম কার্ডটি রেখে দেয়। পরে সেটি জনৈক যুবক ব্যবহার শুরু করলে পারভিনের মামলার তদন্তকারী এস আই মীর কাশেম ওই সিম নম্বরে কল দিয়ে কথা বলতে শুরু করে। এরপর সিম কার্ডের সূত্র উদ্ঘাটন করে শনাক্ত হয় এ কুখ্যাত খুনি রসু খাঁ। পুলিশ সোর্সের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর টঙ্গীর বাসা থেকে রসু খাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে ফরিদগঞ্জ থানায়। এরপর কৌতূহলবশত ফরিদগঞ্জের অজ্ঞাতনামা অপর ৫টি খুনের সাথে তাকে দায়ী করে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। সেও অবলীলায় ফরিদগঞ্জের ৬টি, হাইমচরের ৩টি ও চাঁদপুরের ২টি ঘটনার স্থান ও সময়ের বর্ণনা দেয়। এ বর্ণনার সাথে ৩টি থানার অজ্ঞাতনামা ১০টি লাশের রেকর্ড হুবহু মিলে যায়। তার বর্ণনায় হত্যাকান্ডের শিকার সব ক’টি মেয়ের নাম বলতে না পারলেও ২৩ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে কোহিনূর ও ১৩ মার্চ ২০০৯ তারিখে মেহেদী নামের দুজনের নাম প্রকাশ করে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top