সাহিত্য ডেস্ক: সবাই কাছের মানুষ হন না, কেউ কেউ হন। মানুষের মানবিক সর্ম্পকের সূক্ষ্ম টানাপোড়েনে জীবনের সমীকরণ পাল্টে যায়। জীবন জটিল এবং জটিল থেকে জটিলতর- এ উপলব্ধি মানুষ মাত্রই বহুমাত্রিক আলোকে বুঝতে শেখে। সবাই কাছের মানুষ হতে পারে না, যদিও সে জন্য কোন সাধনা করতে হয় না ঠিক, কিন্তু হৃদয়ের দিগন্ত প্রসারিত করে দুয়ার খুলে দিতে হয়, ভালোবাসতে হয় মানুষকে। মানুষকে উজাড় করে ভালোবাসলে ক্ষতি নেই, ক্ষতি শুধু ঘৃণা আর বিদ্বেষে।
সদ্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্য ছিলেন তেমনি একজন বাঙালি পাঠক ও লেখকদের কাছের মানুষ। ‘কাছের মানুষ’ তারই লেখা কালজয়ী উপন্যাস। এই উপন্যাসটি পড়ার মধ্য দিয়ে লেখিকার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে প্রথমেই অভিভূত হলাম তার অসাধারণ লেখনী শক্তি এবং চিত্রকল্প তৈরিতে অসম্ভব দক্ষতা দেখে। উপন্যাসটি পড়ার সময় মনে হয় চরিত্রগুলো যেন আমার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং আমাকে ক্রমশ আক্রান্ত করছে।
তিনি এ বছর ১২ মে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন অন্য ভুবনে। সংবাদটা পরের দিন সকালে ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারলাম। প্রচণ্ড ধাক্কা অনুভব করলাম। হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হলো। যতটুকু জানতে পেরেছি তিনি ছিলেন সদালাপী, নিরহংকার ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। সব সময় হাসি মুখে থাকতেন। প্রথম পরিচয়ে সবাইকে আপন করে নেয়ার একটা অদ্ভুত শক্তি ছিল তার।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য ১৯৫০ সালের ১০ জানুয়ারি ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পরে স্কুল, কলেজের পাঠ নেন দক্ষিণ কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। তিনি সাধারণ একটি চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে সরকারি চাকরি পান। কিন্তু সেটা শেষ করেননি। ২০০৪ সালে স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অবসর নেন পুরোদমে লেখালেখি করার জন্য। ঠিক এই কাজটি করেছিলেন আমাদের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। নিজের লেখালেখির উপর কী পরিমাণ আত্মবিশ্বাস থাকলে এভাবে চাকরি ছেড়ে দিয়ে হাতে কলম তুলে নেয়া যায় তা ভাবায় বৈকি!
ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল সুচিত্রা ভট্টাচার্যের। তিনি নব্বই-এর দশকে পুরোদমে লেখালেখি শুরু করেন। তবে এটা ঠিক তিনি সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। তার উপন্যাসের সংখ্যা ২৪টি এবং ছোটগল্পের সংখ্যা অসংখ্য। তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হলো : কাছের মানুষ, হেমন্তের পাখি, অলীক সুখ, দহন, পরবাস, নীলঘূর্ণী, ইচ্ছে, রামধনু, কাচের দেয়াল, ছেঁড়া তার, গভীর অসুখ, অন্য বসন্ত, রাঁই কিশোরী, রঙিন পৃথিবী, জল ছবি, তিন কন্যা ইত্যাদি। তিনি প্রথমত ছোটগল্প দিয়ে তার লেখক জীবন শুরু করেন।
১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি তিনি উপন্যাস লেখা শুরু করেন। তার প্রথম উপন্যাস ‘কাঁচের দেয়াল’। এই উপন্যাস দিয়েই তিনি পাঠক হৃদয়ে নাড়া দেন এবং ক্রমশ লেখালেখির জগতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তিনি ছোটদের জন্যও গল্প , উপন্যাস লিখেছেন। তার লেখা ‘আনন্দমেলা’ ডিটেক্টিভধর্মী উপন্যাস, যা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলে শিশু-কিশোর মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। তার শেষ উপন্যাস ‘দমকা হাওয়া’। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি সাহিত্যকর্মের জন্য বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে ‘দহন’ উপন্যাসের জন্য কর্ণাটকের শাশ্বতী সংস্থা থেকে পেয়েছেন ননজনাগুডু থিরুমালাম্বা জাতীয় পুরুস্কার (১৯৯৬), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী পদক, শরৎ সাহিত্য পুরস্কার, তারাশঙ্কর পুরস্কার, সাহিত্য সেতু পুরস্কার, দ্বিজেন্দ্রলাল পুরস্কার ইত্যাদি।
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের একাধিক গল্প, উপন্যাস নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। কালজয়ী পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ তার ‘দহন’ উপন্যাসটির চলচ্চিত্র রূপ দিয়েছেন। এটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। তার যে লেখাগুলো নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছিল সেগুলো হলো : ইচ্ছের গাছ, হেমন্তের পাখি, রামধনু, অলীক সুখ, আলোছায়া ইত্যাদি। তিনি কলকাতার ঢাকুরিয়ার নিজ বাড়িতে থাকতেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। পারিবারিক ডাক্তারের ভাষ্য মতে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখনির মূল বিষয় মানবিক সর্ম্পকের নানা জটিলতা এবং সূক্ষ্ম বোধের আত্মপ্রকাশ, যা সহজেই পাঠককে নাড়া দেয়। তিনি শুধু শহুরে জীবন নয়, গল্পের প্রয়োজনে গ্রাম্য জীবনের পটভূমির অবতারণা করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তার লেখনিতে রাজনীতি উঠে এসেছে অন্যমাত্রায়, একটু অন্যভাবে; এর মাধ্যমে বুঝতে পারা যায় তিনি কতটুকু রাজনীতি সচেতন ছিলেন। তবে তার উপন্যাসে নারী চরিত্রগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করতো, এ জন্য তার নামের সাথে নারীবাদের তমকা লেপ্টে দেয়া হয়েছিল। তিনি এটা আদৌ পছন্দ করতেন না। তার লেখা পড়লে যে কোনো নারী আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠার পাঠ পেত- এখানেই সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখনির সার্থকতা। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে প্রচন্ড আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন এবং নিজের বিশ্বাসের উপর ছিলেন নির্ভরশীল। আশাপূর্ণা দেবী ও মহাশ্বেতা দেবী ছিল তার অনুপ্রেরণার মূল উৎস। ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন সংগ্রামের প্রতিফলন পরবর্তীতে তার গল্প ও উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায়।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।