সকল মেনু

চাঁদপুরে সিরিয়াল কিলার রসু খার ফাঁসির আদেশ

unnamed শাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর: সিরিয়াল কিলার হিসেবে খ্যাত রসু খাকে বুধবার দুপুরে চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ অরুনাভ চক্রবর্তী  একটি হত্যা মামলায় ফাঁসির আদেশ দিয়েছে। আদালত তার রায়ে মামলা তদন্তে অবহেলার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার জন্যও জেলা পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে। চাঁদপুর সদর উপজেলার মদনা গ্রামের ছিঁচকো চোর হিসেবে পরিচিত রসু খাঁ ফরিদগঞ্জ উপজেলার একটি মসজিদে ফেন চুরির ঘটনায় ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর ওই থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এই চুরির মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে জানায়, সে ইতিপূর্বে ১১ জন নারীকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছে। সাধারণত ঢাকার গাজীপুরের টঙ্গি এলাকা থেকে মহিলাদের এনে ধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করে তাদের হত্যা করে লাশ নদী বা খালে ফেলে যেতো। হত্যার শিকার ১১ জন মহিলার মধ্যে একমাত্র পারভীন আক্তার ছিল চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ এলাকার পালতালুক গ্রামের। রসু খাঁ তার নিজের জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে, সে মহিলাদের সাথে প্রেমের অভিনয় করে  বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে চাঁদপুর নিয়ে আসতো এবং অজপাড়াগাঁয়ে নিয়ে তাদের হত্যা করতো। টঙ্গিতে গার্মেন্টস কর্মী পেয়ারা বেগম  এর সাথে পরকিয়া করতে যেয়ে ধরা পড়ে  মার খেয়ে সে শপথ নিয়েছিল, ১০১ জন নারীকে হত্যা করে তারপর  মাজারে যেয়ে অবস্থান নেবে। পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর রসু খার বিরুদ্ধে মোট ১০ টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলা বিচারের জন্য চট্রগ্রামের বিশেষ ট্রাইবুনালে পাঠানোর পর সেখানে একটি মামলায় স্বাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আদালত তাকে খালাস প্রদান করে। পরে বাদ বাকি সব মামলা বিচারের জন্য পুনরায় চাঁদপুরের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেসব মামলার মধ্যে বুধবার খুলনা জেলার দৌলতপুর উপজেলার কথিত কলমচর গ্রামের গার্মেন্টস কর্মী  শাহিদা আক্তার হত্যা ও ধর্ষণ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এই মামলায় মোট ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহন করা হয়। এই মামলাটি প্রথম দায়ের করা হয়েছিল চাঁদপুর সদর মডেল থানায় ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর। তখন ওই মামলায় এফআরটি প্রদাণ করা হয়েছিল। রসু খাঁ পরিদগঞ্জ থানা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে ২০০৯ সালের ১২ অক্টোবর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করা হয়। এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিল চাঁদপুর সদর থানার তৎকালীন এসআই নজরুল ইসলাম। ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর চাঁদপুর সদর উপজেলার সোবহানপুর গ্রামের ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে জনৈক আবিদ মালের বাড়ির পাশ থেকে শাহিদার মৃতদেহ হাত-পা বাধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এসময় আনুমানিক ১৯ বছর বয়সী ওই তরুণীর পরনে লাল শাড়ি, লাল পেটিকোট ও লাল ব্লাউজ ছিল। তার হাত ও পা পেছনের দিক থেকে কালো বোরখা দিয়ে বাঁধা ছিল। ধরা পড়ার পর রসু খাঁ বিচার বিভাগীয় তৎকালীন ম্যাজিষ্ট্রেট আঃ রহমানের কাছে দেয়া জবানবন্দিতে জানিয়েছিল, শাহিদা পেশায় পতিতা ছিল। তাকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখিয়ে চাঁদপুরে আবিদ মালের বাড়ির কাছে এনে ধর্ষণের পর পানিতে ডুবিয়ে হত্যা করে। সে আরো জানায়, গভীর রাতে নদী পার করার কথা বলে সে শাহিদার হাত ও পা বেঁধেছিল।
রায় উপলক্ষ্যে সকাল ন’টায় রসু খাঁকে কড়া পুলিশের প্রহরায়  জেলা ও দায়রা জজ কোর্টের হাজতখানায় নিয়ে আসা হয়। বেলা  ১১ টার দিকে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। সাদা লুঙ্গি. প্রিন্টের সার্ট ও টুপি পরিহিত ক্লিনড শেভ রসু খাঁ’কে এসময় বেশ ফুরফুরে ও দুশ্চিন্তামুক্ত বলে হয়। বেলা ১১ টা ২৫ মিনিটে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ অরুনাভ চক্রবর্তী আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন। তিনি দিনের অন্যান্য কাজ শেষ করে বেলা ১১ টা ৪৯ মিনিটে রসু খার বিরুদ্ধে দায়ের করা শাহিদা হত্যা মামলার রায় পড়া শুরু করেন। টানা প্রায় ১ ঘন্টা রায়ের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে দুপুর ১২ টা ৪৯ মিনিটে তিনি রসু খার বিরুদ্ধে মূল রায় ঘোষণা করেন। আদালত তার রায়ে খুন ও হত্যার  ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় রসু খাঁকে বাংলাদেশ দন্ডবিধির ৩০২ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসি এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং দন্ডবিধির ২০১ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ৭ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো ১ বছরের কারাদন্ডের আদেশ দেন। আদালত তার দীর্ঘ রায়ে মামলা তদন্তে বিভিন্ন অসঙ্গতির চিত্র তুলে ধরে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ভৎসনা করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য জেলা পুলিশকে নির্দেশ দেন। আদালত রায়ে, রসু খাকে একজন বিকৃত যৌনাচারী, পেশাদার খুনী হিসেবে উল্লেখ করে তার যথোপযুক্ত শাস্তি মৃত্যুদন্ড বলে উল্লেখ করেন। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো রসু খাকে এসময় বিড় বিড় করে কিছু আওড়াতে দেখা যায়। রায় ঘোষণার পর পরই রসু খাঁকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় তাকে নিশ্চুপ ও দুঃশিন্তাগ্রস্থ বলে মনে হয়। রায় শোনার জন্য আদালত প্রাঙ্গণে প্রচুর উৎসুক জনতার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া আদালত কক্ষ ছিল আইনজীবী, সাংবাদিক ও নিরাপত্তা কর্মীতে ঠাঁসা। রায় ঘোষণার পর পরই বিচারক খাস কামড়ায় চলে যান।
সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন চাঁদপুরের অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট সাইয়েদুল ইসলাম বাবু। তিনি মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তার সাথে ছিলেন অতিরিক্ত আরেকজন পিপি অ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান ভ’ঁইয়া, জেলা অইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম।  অপরদিকে রসু খাঁর পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাঈমুল ইসলাম রায়ে অসন্তোতাষ প্রকাশ করে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ঘোষণা দেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top