শেরপুর (বগুড়া)প্রতিনিধি: গেল রোপা আমন মৌসুমে উৎপাদিত ধানের দামে প্রচণ্ড মার খেয়েছেন কৃষকরা। সেই লোকসান কাটিয়ে নিতে ‘আপদকালীন’ফসল জিরাশাইল ও পারিজাত ধান চাষ করেন তারা। কিন্তু সেই স্বপ্নও কয়েক দফার বন্যায় অপূর্ণই থেকে যায়। এরপরও বেঁচে তো থাকতে হবে। তাই কৃষকের বসে থাকার উপায় নেই। শুরু করেন রবি মৌসুমের রকমারি সবজি চাষ। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! ঘাম ঝরানো কষ্টের সবজি ক্ষেতেই পচে নষ্ট হচ্ছে। বিক্রিও করা যাচ্ছে না। যতটুকু বিক্রি করা যায় তাও আবার পানির দামে। এতোসব বাঁধা পেরিয়ে প্রত্যেক কৃষক তার জমির মাটিটুকু বুকে আগলে রেখে ফসল ফলিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কোমর বেঁধে তারা নেমে পড়েছেন বোরোর মাঠে। কিন্তু জমিতে পা ফেলতেই যুক্ত হয়েছে আরেক বাঁধা। অবশ্য এটি প্রাকৃতিক কোনো বাঁধা বা দুর্যোগ নয়। সম্পূর্ণই মনুষ্য সৃষ্ট এক ভয়ঙ্কর দুর্যোগ। এ দুর্যোগের নাম ‘অবরোধের সঙ্গে ফ্রি হরতাল’। টানা অবরোধ আর হরতালের ভয়ঙ্কর থাবায় দিশেহারা কৃষক। বোরো চাষের শুরুতেই তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্নটুকুও লণ্ডভণ্ড হওয়ার পথে। কেননা এরই মধ্যে ইউরিয়াসহ সব ধরনের সার ও ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। এভাবে বারবার লোকসানে ফসল বিক্রি করে বা বাড়তি দামে কৃষিপণ্য কিনে ফসল চাষ করে আর কতোদিন টিকে থাকা সম্ভব-এমন প্রশ্ন অসংখ্য কৃষক পরিবারের।ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার সাধুবাড়ী, মামুরশাহী, তালতা, পালাশন, ভায়রা, শ্যামনগর, ফুলবাড়ী গ্রামে গিয়ে বোরো চাষে ব্যস্ত কৃষকদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এতে বর্তমান কৃষির এ করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। সাধুবাড়ী গ্রামের শহিদুল ইসলাম, মামুরশাহীর আব্দুল মজিদ, পালাশনের ইকবাল হোসেন, ভায়রার অমূল্য চন্দ্র, তালতার, আবু সাঈদ, ফুলবাড়ীর সাইফুল ইসলামসহ অনেক কৃষক জানান, বোরো চাষে নেমেই তারা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছেন। সরকার নির্ধারিত দরে কোথাও কোনো ধরনের সার মিলছে না। ডিজেলের দামও বেশি। টানা আবরোধ আর হরতালের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা এসব কৃষিপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কৃষকরা জানান, বর্তমানে প্রতিবস্তা ইউরিয়া সার ৮০০ টাকার স্থলে ৮৭০-৮৮০ টাকায়, টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) ১১০০ টাকার স্থলে ১১৯০-১২০০ টাকায়, এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) ৭৫০ টাকার স্থলে ৮২০-৮৩০ টাকায় ও ডিএপি (ডাই অ্যামোনিয়া ফসফেট) সার ১২৫০ টাকার স্থলে ১৪২০-১৪৩০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এছাড়া ৬৮ টাকা লিটারের ডিজেল ৭০ টাকায় কিনতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তারা। তারা জানান, অন্যান্য কৃষিপণ্য অপেক্ষাকৃত বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। গেল মৌসুমে সরকার নির্ধারিত দরে সারসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য কিনে ফসল ফলিয়েও লোকসান দিতে হয়েছে। আর এবার সবকিছু বেশি দামে কিনে চাষ করে কী পরিমাণ লোকসান গুণতে হবে তা একমাত্র ওপরওয়ালাই জানেন।
বেশি দামে সার বিক্রির কথা অস্বীকার করে বিসিআইসির ডিলার মেসার্স বসাক ব্রাদার্সের সত্ত্বাধিকারী রামচন্দ্র বসাক জানান, সব ধরনের সার সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। তাই সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে তার চেয়ে বেশি দরে কোনো সার বিক্রি করার প্রশ্নই ওঠে না।
তবে রেজাউল করিমসহ একাধিক খুচরা বিক্রেতা জানান, অবরোধ ও হরতালের কারণে সারের সরবরাহ স্বাভাবিক নেই। এছাড়া পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে কয়েকগুণ। এসব কারণে ডিলারদের কাছ থেকে বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে। ফলে সেই দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তারাও খরচ বাদে প্রতিবস্তায় মাত্র ১০/২০ টাকা লাভে সার বিক্রি করছেন।
কিন্তু ডিলাররা কেন সারের দাম বৃদ্ধির কথা অস্বীকার করছেন তা খুচরা বিক্রেতারা জানাতে পারেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এ উপজেলায় বিসিআইসি অনুমোদিত ১২ জন ডিলার রয়েছেন। এছাড়া ১৮ জন বিএডিসি অনুমোদিত ও উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর কর্তৃক নিয়োগকৃত ১০টি ইউনিয়ন এবং পৌরসভায় মোট ৩৬ জন খুচরা সার বিক্রেতা রয়েছেন।
উপজেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় ২০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গেল মৌসুমে ২১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে রোপা-আমন ধান লাগানো হয়েছিল। সবজি চাষ করা হয়েছিল এক হাজার ৫৮০ হেক্টর, আলু দুই হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে ও রোপা-আউশ চাষ হয়েছিল পাঁচ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে।
উপজেলার উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণকারী কর্মকর্তা মাসুদ আলম জানান, জানুয়ারিতে সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ইউরিয়া সারের মধ্যে রোববার (১ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত সংশ্লিষ্টরা ১৭৪০ মেট্রিকটনের মধ্যে ১৫১১ মেট্রিকটন, টিএসপি ২৯১ মেট্রিকটনের মধ্যে ২৬৯ মেট্রিকটন, এমওপি ২৪৪ মেট্রিকটনের মধ্যে ২১৬ মেট্রিকটন ও ১৮০ মেট্রিকটনের মধ্যে ১৬০ মেট্রিকটন ডিএপি সার উত্তোলন করেছেন ডিলাররা।
এদিকে, জানুয়ারির বরাদ্দকৃত পুরো সার উত্তোলন করা না গেলেও ফেব্রুয়ারি মাস চলে এসেছে। ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য ইউরিয়া ১৮০০ মেট্রিকটন, টিএসপি ২১৫ মেট্রিকটন, এমওপি ১৮০ মেট্রিকটন ও ডিএপি ৩২ মেট্রিকটন বরাদ্দ রয়েছে। যা এখনও সংশ্লিষ্ট ডিলাররা উত্তোলন করতে শুরু করেননি। তবে সার উত্তোলন অব্যাহত রয়েছে বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানান, বরাদ্দ অনুযায়ী সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। এছাড়া জানুয়ারির শেষ ও ফেব্রুয়ারির শুরু পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান লাগানো হয়েছে।
দাম বৃদ্ধির প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা জানান, সারের দাম বেশি নেওয়ার কোনো সুয়োগ নেই। তারপরও হয়রানি এড়াতে রশিদমূলে কৃষকদের সার কেনার পরামর্শ দেন তিনি।
এতে যদি কোনো ব্যবসায়ী সরকার নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করেন, আর কেউ যদি সেই রশিদ দেখাতে পারেন তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সবমিলিয়ে বোরো চাষে কোনো সমস্যা হবে না বলে দাবি করেন কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রহিম।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।