সকল মেনু

আদমপুরে মণিপুরী মহারাসলীলা ও মেলা এলাকায় সাজ সাজ রব

 মৌলভীবাজার প্রতিনিধি: “দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ” বৃহত্তর সিলেটের ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যতম বিশ্বনন্দিত সাংস্কৃতিক ধারক মণিপুরী সম্প্রদায়ের  বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব “রাসলীলা” প্রতি বছর কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়াম-প ও আদমপুর সানাঠাকুর ম-পে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। রাতভর রাধাকৃষ্ণের প্রণয়োপখ্যানের সে রাসলীলা উপভোগ করতে সারাদেশ থেকে ছুটে আসেন হাজারো নারী-পুরুষ,শিশু-কিশোর, কবি-সাংবাদিক, দেশি-বিদেশি পর্যটকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষজন। বর্ণাঢ্য আয়োজন ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আজ বৃহষ্পতিবার সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজারের সীমান্তবর্তী কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হবে মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা। রাসোৎসব উপলক্ষে উভয় স্থানে বসছে মেলা। এ উপলক্ষে মণিপুরী সম্প্রদায়ের মাঝে বিরাজ করছে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসুচী গ্রহণ করা হয়েছে। রাসোৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে লাখো মানুষের ঢল নামবে বলে আয়োজকরা জানান। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর (শিববাজার) জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মনিপুরীরা ১৭২তম বার্ষিকী এবং আদমপুর ইউনিয়নের তেতইগাঁও সানাঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গনে রাসোৎসব উদযাপন কমিটির উদ্যোগে মনিপুরী মৈ-তৈ সম্প্রদায়ের লোকজন ২৪ তম এ রাসোৎসব উদযাপন করবে। উৎসব উপলক্ষে উভয় স্থানে বসবে বিরাট মেলা। মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার লোকজন মেতে উঠবে আনন্দ উৎসবে। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞাণী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠবে গোটা উৎসব অঙ্গন। মণিপুরী সম্প্রদায়ের পূণ্যস্থাণ হিসাবে বিবেচিত মাধবপুর ও আদমপুরে রাসোৎসবের জন্য তৈরী সাদাকাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলো এই একটি রাত্রির জন্য হয়ে উঠবে লাখো মানুষের মিলনতীর্থ। মণিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুন নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের। মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের সভাপতি এ্যাড. চাঁদ মুরারী সিংহ স্বপন, সাধারণ সম্পাদক নৃপেন্দ্র কুমার সিংহ, মণিপুরী ললিতকলা একাডেমীর গবেষণা কর্মকর্তা প্রভাস সিংহ জানান, কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়া মন্ডপ প্রাঙ্গনে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে গৌড়িয় বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী (বিষ্ণুপ্রিয়া) মণিপুরী সম্প্রদায়ের ১৭২তম শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরন উৎসব উপলক্ষে কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে বৃহষ্পতিবার সকাল ১১টা থেকে গোধূলীলগ্ন পর্যন্ত রাখাল নৃত্য (গোষ্ঠলীলা), সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত গুণীজন সংবর্ধনা, আলোচনা সভা ও  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নট সংকীর্তন, রাত ১১ টা থেকে পরদিন শুক্রবার ঊষালগ্ন পর্যন্ত শ্রী শ্রী কৃষ্ণের মহারাসলীলানুসরণ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন এমপি, সাবেক চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি, শামসুন নাহার বেগম এমপি, ভারতীয় দূতাবাসের ডেপুটি হাই কমিশনার সন্দীপ চক্রবর্তী, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক, জনতা ব্যাংক লিঃ পরিচালনা পর্ষদ এর পরিচালক সৈয়দ বজলুল করিম, মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ প্রশাসক আজিজুর রহমান, জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান, পুলিশ সুপার তোফায়েল আহমদ, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী অফিসার শহীদ মোহাম্মদ ছাইদুল হক ও স্বদেশ লাইফ ইন্সুরেন্স কো: লি. এর চেয়ারম্যান নুরুল আলম চৌধুরী। অপরদিকে রাসোৎসব উদযাপন কমিটি ২০১৪ এর আহবায়ক থোঙাম চন্দ্রকীর্তি সিংহ ও সদস্য সচিব কে ব্রজকিশোর সিংহ জানান, আদমপুর তেতইগাঁও উন্মুক্ত মঞ্চে মৈতৈ মণিপুরী সম্প্রদায়ের রাস উৎসবে কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে বৃহষ্পতিবারসকাল ১১ টায় রাখাল নৃত্য, সন্ধ্যা ৬টায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা, সন্ধ্যা ৭টায় মণিপুরী কালচারাল কমপ্লেক্সের শুভ উদ্বোধন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আলোচনা সভা, রাত ৮টায় ভারতের মণিপুর থেকে আমন্ত্রিত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার গুণী শিল্পীবৃন্দের অংশগ্রহণে মণিপুরী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাত ১০টায় নটকীর্তন অধিবাস ও রাত ১১ টা থেকে মহারাস লীলা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ভারতীয় দূতাবাসের ডেপুটি হাই কমিশনার শ্রী সন্দীপ চক্রবর্তী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান, আদমপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাব্বির আহমদ ভুঁইয়া। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শ্রী শশী কুমার সিংহ।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও অগ্রহায়ণের পূর্ণিমা তিথিতে জাকজমকপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মনিপুরী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মাহরাসলীলা উৎসব। মনিপুরী অধ্যূষিত মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুরে ও মাধবপুরে আশ্বিন মাসের শেষ ভাগেই উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। উপজেলার মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকের সঙ্গে অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও মেতে ওঠে একদিনের এ আনন্দ উৎসবে। মণিপুরী সম্প্রদায়ের অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘু মৈতৈ ও বিষ্ণুপিয়া মনিপুরীদের আয়োজনে কমলগঞ্জের আদমপুর ও মাধবপুরের রাসোৎসবের জন্যে তৈরী মন্ডপগুলো ঐ একটি রাত্রির জন্যে হয়ে উঠে হাজারো মানুষের মিলন কেন্দ্র। সাদা কাগজের নকশায় সজ্জিত মন্ডপগুলোতে দূর-দূরান্ত থেকে আগত শিশু নৃত্য শিল্পীদের সুনিপুণ অভিনয় যেন মন্ত্র মুগ্ধ করে রাখে দর্শনার্থীদের। রাসোৎসবের দিন যতোই ঘনিয়ে আসছে ততোই রাসোৎসবের আকর্ষণ বাড়ছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উৎসবে দর্শনার্থীর সমাগম। তুমুল হৈচৈ, আনন্দ উৎসাহ ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল আর শঙ্খ ধ্বনীর মধ্য দিয়ে হিন্দু ধর্মের অবতার পুরুষ শ্রী কৃষ্ণ ও তার সখি রাধার লীলাকে ঘিরে এই একটি দিন বছরের আর সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসে কমলগঞ্জবাসীর জন জীবনে। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়,  ১৭৭৯ সালে  মনিপুরের মহারাজা ভাগ্যচন্দ্রস্বপ্নদৃষ্ট হয়ে যে নৃত্যগীতের প্রর্বতন করেছিলেন  তাহাই রাসোৎসব। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী রাজাগনের বেশরিভাগই ছিলেন নৃত্যগীতে পারদর্শী এবং তারা নিজেরাও রাসনৃত্যে  অংশগ্রহন করতেন। এর ফলে মণিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে এ কৃষ্টির ধারাবাহিকতায় কোন ছেদ পড়েনি। অতীতের সেই ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই  কোন রুপ বিকৃতি ছাড়াই কমলগঞ্জে উদযাপিত হয়ে আসছে মনিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শ্রী কৃষ্ণের মহা রাসলীলা। তুমুল হৈ-চৈ, আনন্দ-উৎসাহ, ঢাক, ঢোল, মৃদঙ্গ, করতাল এবং শঙ্খ ধ্বনির মধ্যদিয়ে রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে  ঘিরেই আজকের দিনটি বছরের অন্য সব দিন থেকে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আসবে  কমলগঞ্জ উপজেলাবাসীর জীবনে। রাসলীলায় মনিপুরী নৃত্য শুধু কমলগঞ্জের নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের তথা সমগ্র বিশ্বের নৃত্য কলার মধ্যে একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। ১৯২৬ সালের সিলেটের মাছিমপুরে মনিপুরী মেয়েদের পরিবেষ্টিত রাস নৃত্য উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে কবিগুরু কমলগঞ্জের নৃত্য শিক্ষক নীলেশ্বর মুখার্জীকে শান্তি নিকেতনে নিয়ে প্রবর্তন করেছিলেন মণিপুরী নৃত্য শিক্ষা। কমলগঞ্জে প্রায় এক মাস আগ থেকেই চলছে রাসোৎসবের প্রস্তুতি। মনিপুরী সম্প্রদায়ের বাড়ি বাড়ি কুমারী কিশোরদের রাস লীলায় অংশগ্রহণ করার জন্যে নৃত্য ও সংগীতের তালিম নেয়ার ধুম পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে তাবৎ বাড়িতে রাসধারী ও রাস লীলার উস্তাদ এনে শিক্ষা দেয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। আনুমানিক ৪০/৫০ জন কিংবা ততোধিক সংখ্যার কিশোরী এ রাস লীলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top