স্টাফ করেসপন্ডেন্ট,হটনিউজ২৪বিডি.কম,ঢাকা: ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাশের গোহালিয়া ইউনিয়নের তিন মৌজাতেই অনিক সিদ্দিকীর ১০০০ বিঘা জমি। এমন শত শত বিঘা জমির বেশির ভাগই দখল করা। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাশের গোহালিয়া ইউনিয়নের তিন মৌজাতেই অনিক সিদ্দিকীর ১০০০ বিঘা জমি। এমন শত শত বিঘা জমির বেশির সদ্য বরখাস্ত হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী ও ছেলের বিরুদ্ধে হাজার বিঘা জমি দখলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে লতিফের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তো দূরের কথা, নিজের জমি বাঁচাতে গিয়ে উল্টো জেলের ভাত খেতে হয়েছে জমির মালিককে। অভিযোগ রয়েছে, টাঙ্গাইলের বিভিন্ন স্থানে এমন অনেক জমি দখলসূত্রে জমিদার বনে গেছে লতিফ সিদ্দিকীর পরিবার। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। উপজেলার নাগবাড়ী ইউনিয়নের পশ্চিম পাকুটিয়া গ্রামের মজিদ ও রশিদের ১১৫ শতাংশ জমি দখল করে সেখানে গড়ে তুলেছেন রূপসী টেক্সটাইল কারখানা। এ কারখানার মালিক লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী। এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ তুলে ধরেছেন স্থানীয় ভূক্তভোগীরা। জানা যায়, টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় ছাতিহাটি-এলেঙ্গা সড়কের ঠিক পাশেই ছিল একটি গরুর খামার, সঙ্গে লাগোয়া বিশাল পুকুর, দুটি টিনশেড ঘর, নানা জাতের গাছগাছালি। ১১৫ শতাংশ আয়তনের এ জমির মালিক দুই ভাই আবদুল মজিদ (৬৫) ও আবদুর রশিদ (৫৮)। জমিটি কেনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই তৎপর ছিলেন তৎকালীন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। কিন্তু মজিদ আর রশিদ বাপ-দাদার জমি বিক্রি করতে রাজি হননি। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী নাছোড়বান্দা। শেষে দুই ভাইয়ের নামে দেন চুরি ও ছিনতাইয়ের মিথ্যা মামলা। সেই মামলায় পুলিশ রশিদ ও তাঁর ভাতিজা আনোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তারও করে। দুই দিন পরই অবশ্য জামিন পান তাঁরা। কিন্তু ফিরে এসে দেখেন তাঁদের খামার, ঘর, গাছগাছালির চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সব। পুকুরটাও ভরাট করে ফেলা হয়েছে। তার ওপর অপকর্মের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুলডোজারটি। এক রাতের মধ্যে জমিটি দখল করে ফেলেন লতিফ সিদ্দিকী। রশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মন্ত্রী তাঁর ক্ষমতার জোরেই আমাদের জমি দখলে নিয়েছেন। জমির সব বৈধ কাগজপত্র আমাদের কাছে আছে। জমির দাম দেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো আমাকে ও আমার ভাতিজাকে চুরি ও ছিনতাইয়ের মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছিলেন। আমরা জেলে যাওয়ার পর জমি দখলে নেয় মন্ত্রীর লোকজন। দুই দিনের মধ্যে সেখানকার সব স্থাপনা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। পুকুর ভরাট করে ফেলে। মালামালও লুট করে নিয়ে গেছে। শুধু মজিদ কিংবা রশিদ নয়, একই গ্রামের ইদ্রিস আলী, সবুর আলী, ইউসুফ আলী ও শাহাজাহান আলীসহ পাঁচ পরিবারের ১২৫ শতাংশ জমির মালিকও এখন লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী। নামমাত্র মূল্যে বসতবাড়িসহ তাদের জমি স্ত্রীর নামে কিনে নিয়েছেন লতিফ সিদ্দিকী। কেবল বায়নার টাকা দিয়েই জমির দখল নিয়েছেন তিনি। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী প্রতি শতাংশ জমির মূল্য দুই থেকে তিন লাখ টাকা। কিন্তু তাদের দেওয়ার কথা ছিল এক লাখ ১০ হাজার টাকা করে। সেই টাকারও পুরোটা দেওয়া হয়নি।শাহাজাহান আলী বললেন, ‘আট বছর সৌদি আরবে ছিলাম। দেশে ফিরে নিজের জমিতে নতুন ঘর তুলেছিলাম। কিন্তু থাকার ভাগ্য হলো না। জমিটি বিক্রির জন্য চাপ দিতে থাকে লতিফ সিদ্দিকীর লোকজন। একপর্যায়ে বিক্রি করতে বাধ্য করে। জমির দাম ২০ লাখ টাকারও বেশি। অথচ দিয়েছে মাত্র ১০ লাখ টাকা। ভয়ে মুখ খুলতে পারিনি।’এভাবে দখল ও নামমাত্র মূল্যে পশ্চিম পাকুটিয়া গ্রামের অর্ধশতাধিক লোকের কাছ থেকে ৪০০ বিঘার (স্থানীয়ভাবে ৩৩ শতাংশে এক বিঘা) বেশি জমির মালিক হয়েছেন লতিফ সিদ্দিকীর স্ত্রী লায়লা সিদ্দিকী। ছাতিহাটিতে তার নামে লতিফ সিদ্দিকীর হয়ে জমি কিনেছেন নাগবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মিল্টন সিদ্দিকী, সুধির কুমার দত্ত, হিরু সরকার ও আবুল কাশেম।অনুসন্ধানে দেখা গেছে, লায়লা সিদ্দিকীর নামে পাকুটিয়া মৌজায় গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল তাঁতশিল্প কারখানা। প্রায় ১২০ বিঘা জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে কারখানাটি। বাকি প্রায় ৩০০ বিঘা জমি এখনো পতিত পড়ে আছে।স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাস্তার পাশের এক শতাংশ জমির মূল্য দুই থেকে তিন লাখ টাকা। একটু ভেতরের দিকে জমির দাম ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা শতাংশ। পাকুটিয়া মৌজায় লায়লা সিদ্দিকীর নামে আছে ৪০০ বিঘারও (১৩ হাজার ২০০ শতাংশ) বেশি জমি। শতাংশের মূল্য গড়ে এক লাখ টাকা করে হলেও ১৩ হাজার ২০০ শতাংশ জমিন মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৩২ কোটি টাকা। ১২০ বিঘার ওপর তাঁত কারখানার পাঁচটি ইউনিট নির্মাণ করতে আরো খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।সে হিসাবে লায়লা সিদ্দিকী এখন প্রায় ১৮২ কোটি টাকার মালিক। অথচ ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামায় লতিফ সিদ্দিকী জানিয়েছিলেন, তাঁর স্ত্রীর নামে নগদ আছে মাত্র ৪১ হাজার টাকা। সম্পদ হিসেবে আছে ২০ ভরি স্বর্ণ, ৯.২৮ একর জমি ও দুটি দালান। আর গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামায় দেখা গেছে দুটি ব্যাংকে লায়লা সিদ্দিকীর নামে নগদ ২৬ লাখ ৬০ হাজার ৬০৪ টাকা আছে।অথচ বাস্তবে তার জমিই আছে ৪০০ বিঘার বেশি। তাঁত কারখানা তো আছেই। শুধু লতিফ সিদ্দিকী দম্পতি নন, তাদের ছেলে অনিক সিদ্দিকীও ‘জমিদার’! কালিহাতীর ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাশের গোহালিয়া ইউনিয়নের পাঁচটি মৌজায় অনিকের নামে প্রায় এক হাজার ৬০০ (৫২ হাজার ৮০০ শতাংশ) বিঘা জমি রয়েছে। এর মধ্যে খাসজমি দখল আছে, স্থানীয়দের ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে কেনা জমিও আছে। সবই ধানিজমি। ইতিমধ্যে প্রায় ৬০০ বিঘা জমিতে মাটি ভরাট করে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। যোগারচর গ্রামে অনিক সিদ্দিকী গড়ে তুলেছেন ম্যাজিসটিকা হোল্ডিং লিমিটেড। তবে কী কারখানা হবে কেউ তা জানে না। অনিক মাঝেমধ্যে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে গিয়ে জমি দেখে চলে আসতেন। তার লোকজনই মূলত জমি দেখাশোনা করত। স্থানীয় যোগারচর গ্রামে অনিক সিদ্দিকীর হয়ে জমি কিনে দিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আবদুল হাই আকন্দ, আবু সাঈদ, মজিবুর রহমান ও কালিহাতী উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মোল্লা।
৬০০ বিঘা জমি ভরাট করা হয়েছে, বাকি এক হাজার বিঘার বেশির ভাগ রেজিস্ট্রি করে কেনা হয়েছে। কিছু জমি কেনা হয়েছে বায়না সূত্রে। এসব জমির প্রতি শতাংশের দাম ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। সে হিসাবে এক হাজার ৬০০ বিঘা জমির গড় মূল্য প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা।
যোগারচর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, এক হাজার বিঘা জমি পড়েছে গোহালিয়া ইউনিয়নের কদিম হামজানি, কুশাবেনু ও গোবিন্দপুর মৌজায়। আলীপুর ও বেইলতা মৌজায় পড়েছে বাকি প্রায় ৬০০ বিঘা জমি।
স্থানীয় গ্রামবাসীর অভিযোগ, জমি বিক্রি করতে না চাইলেও অনিকের ক্যাডার বাহিনী এসে ভয় দেখিয়েছে, জমি বিক্রি না করলে জোর করেই নাকি নিয়ে যাবে। অনেকের জমি শুধু বায়না করেই মাটি ফেলে ভরাট করে দখলে নিয়েছে। শুধু নামমাত্র মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে। যোগারচর গ্রামের আশিফ হোসেন বলেন, ‘মন্ত্রীর পোলায় জমি কিনবে, তাঁর কথার ওপর না করার ক্ষমতা কার আছে? জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছে, আর আমরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছি, কিছুই করার ছিল না।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমার জমি রাস্তার পাশে ছিল, ইচ্ছা ছিল নিজেই সেখানে তাঁত কারখানা দিব, কিন্তু মন্ত্রীর ছেলে জমি ভরাট করে ফেলেছেন। পরে বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করে টাকা নিয়েছি।’
লতিফ সিদ্দিকীকে বহিষ্কার করা হচ্ছে শুনে এখন পশ্চিম পাকুটিয়া গ্রামের অনেকেই মুখ খুলতে শুরু করেছেন। ষাটোর্ধ্ব আনছার উদ্দিন আহামেদ বললেন, ‘মনে যা চাইত লতিফ সিদ্দিকী তা-ই করত। জমি বিক্রি করতে না চাইলেও জোর করে কিনে নিছে। মামলা দিয়ে হলেও জমি নিছে।’
লায়লা সিদ্দিকীর তাঁত কারখানার পাশেই রফিক মিয়ার চায়ের দোকান। সেখানে বসা ছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আমির আলী। বললেন, ‘মন্ত্রী হওয়ার পর কপাল খুলে গেছে লতিফ সিদ্দিকী ও তার পরিবারের। মন্ত্রী হওয়ার আগে তাদের অবস্থা কেমন ছিল সেটা এলাকার সবাই জানে। গ্রামের বাড়িতে এখনো আধাপাকা বাড়ি। কিন্তু স্ত্রীর নামে কোটি কোটি টাকায় কারখানা করতাছে।’
কারখানার ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করলে বাধা দেন নিরাপত্তাকর্মী আশরাফ আলী, ‘কারখানার ভেতরে যাওয়া একেবারে নিষেধ। ওপরের নির্দেশ আছে কাক-পক্ষীও যেন ভেতরে যেতে না পারে। পাগল ইসহাক নামের আরেক নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘এ কারখানা স্যারের স্ত্রীর (লায়লা সিদ্দিকী) নামে। স্যারের স্বপ্ন ছিল কালিহাতীতে সবচেয়ে বড় তাঁত কারখানা বানাইবো। কিন্তু বিদেশে কী একটা কথা কইছে, তার জন্য নাকি মন্ত্রী থেকে বাদ পড়তাছে। আর এই সুযোগে অনেকেই স্যারের সম্পর্কে খারাপ কথা কইতেছে।’
তাঁত কারখানার ব্যবস্থাপক সুধির কুমার দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণকাজ আমাদের ম্যাডামই (লায়লা সিদ্দিকী) দেখাশোনা করেছেন। উনার তত্ত্বাবধানেই সবকিছু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি চালুর পর থেকে আমি ম্যানেজার হিসেবে আছি। জমি কার কাছ থেকে কত দামে কিনেছে সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’
লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গেই লায়লা ও অনিক সিদ্দিকী নিউ ইয়র্ক সফরে গিয়েছিলেন। তাঁরা কবে ফিরবেন জানতে চাইলে সুধির বলেন, ‘ঈদের আগেই দেশে ফেরার কথা ছিল, কিন্তু এখন বুঝতেছি না কবে আসবেন। আর কারখানা ঈদের ছুটিতে বন্ধ থাকলেও এখন আবার চালু করা হবে কি না জানি না।’
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।