রাজধানীর পূর্বাচলে গাড়ি চাপায় বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় মামলা নিতে অসহযোগিতার অভিযোগ করেছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া আসামিপক্ষের আইনজীবীর বিভ্রান্তিকর মন্তব্য ও গণমাধ্যমে ‘হতকাণ্ড’কে দুর্ঘটনা বলে প্রচার করে মামলার মোড় ঘোরানোর চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেন তারা।
শনিবার (২১ ডিসেম্বর) বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এমন অভিযোগ করেন। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত বিচারের দাবিতে বিকেল সাড়ে চারটায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর ৫ দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি জমা দেবেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা বলেন, ২০ ডিসেম্বর রাতে বুয়েটে একটা প্রোগ্রাম চলাকালীন আমরা কয়েকজন শিক্ষার্থী একত্রে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলাম। এমতাবস্থায় আনুমানিক রাত তিনটার পর আমরা পূর্বাচল নীলা মার্কেটের সামনে ৩০০ ফিট রাস্তায় আমাদের তিন বন্ধু, বুয়েট সিএসই (২০২১) ব্যাচের ছাত্র মোহতাসিম মাসুদ (নজরুল হল), অমিত সাহা (আহসানুল্লাহ হল) এবং মেহেদি হাসান খাঁনের (নজরুল হল) একটি দুর্ঘটনার খবর জানতে পারি। একজন পথচারীর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, আমাদের তিন বন্ধু গুরুতর আহত এবং একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে শিক্ষার্থীরা মাসুদ, অমিত এবং মেহেদির শরীর অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায় উল্লেখ করে বলেন, তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে থাকা ফায়ার ব্রিগেডের সাহায্যে আমরা তাদের তিনজনকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক মাসুদকে মৃত ঘোষণা করেন। বাকি দুজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।
শিক্ষার্থীরা বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা শুনে এবং ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে আমরা যা জানতে পারি, তা হলো—অমিত, মাসুদ এবং মেহেদিকে পূর্বাচল ৩০০ ফিট নীলা মার্কেট মোড়ের ওপরের টার্নিংয়ে ডিউটিরত পুলিশ পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য দাঁড় করায়। এ সময় পেছন থেকে একটি প্রাইভেট কার বেপরোয়া গতিতে এসে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেল-সহ তিনজনকে আঘাত করে। এর ফলে তারা তিনজন সড়কের বিভিন্ন জায়গায় ছিটকে পড়ে।
প্রাইভেট কারটি মুবিন আল মামুন (সাদমান) চালাচ্ছিলেন এবং তার সঙ্গে ছিলেন মিরাজুল করিম ও আসিফ চৌধুরী। চালকের পরিচয় দিয়ে তারা বলেন, চালক সাদমান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহ আল মামুনের সন্তান। শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে চালকের বাবাকেও সেখানে উপস্থিত দেখতে পায়। পরবর্তী সময়ে তাদের প্রাইভেট কার পর্যবেক্ষণ করে আমরা অ্যালকোহল এবং মদজাতীয় নেশাদ্রব্যের উপস্থিতি পাই।
মামলা নিতে অনীহা প্রকাশের অভিযোগ
রূপগঞ্জ থানায় দায়িত্বরত উপপরিদর্শক (এসআই) মামলা নিতে অনীহা প্রকাশের অভিযোগ করে তারা বলেন, ঘটনার পরে পুলিশ প্রাইভেট কারের চালকসহ তিনজনকে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রথমে রূপগঞ্জ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায় এবং পরবর্তী সময়ে তাদের রূপগঞ্জ থানায় নেওয়া হয়। এসময় শিক্ষার্থীরাও তাদের সঙ্গে থানায় পৌঁছায়। থানায় ঘটনার বিবরণ জানার পরে কর্তব্যরত এসআই মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করেন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসহযোগিতামূলক আচরণ করতে থাকেন।
এ সময় আমরা আমাদের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং আনুমানিক সকাল আটটায় আরও একদল শিক্ষার্থী বুয়েটের কতিপয় শিক্ষক, চিফ সিকিউরিটি অফিসার এবং হেড গার্ডসহ থানায় উপস্থিত হন। তখন থানায় কোনো ওসি উপস্থিত ছিলেন না এবং তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি বিলম্ব করতে থাকেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ওসি থানায় উপস্থিত হন এবং শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
অভিযুক্তদের মামলার ঘটনাপ্রক্রিয়া প্রভাবিত করার চেষ্টার অভিযোগ
অভিযুক্তদের পরিবার মামলার ঘটনাপ্রক্রিয়া প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন অভিযোগ করে বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলেন, এ সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং চালকের পরিবারের লোকজন বিভিন্নভাবে মামলার ঘটনাপ্রক্রিয়া প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তের মা নানাভাবে শিক্ষার্থীদের মামলা থেকে দূরে থাকতে ক্ষতিপূরণ প্রদানের কথা জানান। এক পর্যায়ে তার সন্তান মদ্যপ অবস্থায় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলো শুনে তিনি বলেন, তার সন্তান ড্রাঙ্ক হলেও ওরা এত রাতে ওখানে কী করছিল! এরকম অনভিপ্রেত মন্তব্য এবং প্রভাব খাটানোর চেষ্টায় বুয়েটের আপামর শিক্ষার্থী অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়।
শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে মামলার ড্রাফট লেখার কাজ শুরু হয় জানিয়ে তারা বলেন, সড়ক আইন ২০১৮, ১৯৮ এবং ১০৫ ধারায় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর নিহত মাসুদের মরদেহ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানো হয়। একই সময়ে কতিপয় শিক্ষার্থীসহ অভিযুক্তদের ডোপ টেস্টের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে (ভিক্টোরিয়া) পাঠানো হয়। রূপগঞ্জ থানা-পুলিশ গাড়িচালকসহ গ্রেপ্তার এই তিনজনকে পাঁচ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠান। বিচারক আগামী রোববার (২২ ডিসেম্বর) রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করে শুক্রবার সন্ধ্যায় তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়েছেন। আমরা আশা করছি রোববার শুনানির মাধ্যমে বিচারপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে চলতে থাকবে।
‘হত্যাকাণ্ড’ প্রমাণিত দাবি
সব ঘটনার সারমর্ম টেনে বুয়েট শিক্ষার্থীরা এটিকে প্রমাণিত ‘হত্যাকাণ্ড’ দাবি করে বলেন, এটি সুস্পষ্ট যে এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়। বরং চালক নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে আমাদের একজন সহপাঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং দুজনকে গুরুতর আহত করে। আমরা এ হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। ইতোমধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, অভিযুক্তদের আইনজীবী গণমাধ্যমে বিভিন্ন রকমের বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। একইসঙ্গে কিছু সংবাদমাধ্যমেও এই হত্যাকাণ্ডকে দুর্ঘটনা বলে অপপ্রচারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আমরা এই অপপ্রচারের তীব্র নিন্দা জানাই এবং দ্রুততম সময়ে এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানাই।
সংবাদ মাধ্যম ও আইনজীবীর প্রতি অভিযোগ
সংবাদ মাধ্যমে ও আইনজীবীর প্রতি অভিযোগ করে বুয়েট শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা আগেও দেখেছি প্রভাবশালী পরিবারের সদস্যরা কোনো অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকলে বা সিভিয়ার অফেন্সে যুক্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে প্রভাব খাটিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া থেকে তাদের নিস্তার লাভের দৃষ্টান্ত। আমরা এ ক্ষেত্রেও সেই ধরনের কাহিনি ঘটবে বলে আশংকা করছি। শুরু থেকেই মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে টালবাহানা এবং হত্যাকারীর পরিবারের বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য নিউজমিডিয়ায় দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা আমাদের শংকিত করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশে এই খুনের ন্যায়বিচার অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হবে, আমরা মাসুদ, অমিত, মেহেদির সহপাঠীরা তাদের সুবিচার প্রাপ্তির ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
পাঁচ দফা দাবি
তারা পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে বলেন, আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি, সড়কের নিরাপত্তা আইন জোরদার করুন, দেশের বিচারব্যবস্থাকে একটি গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করুন। আর কোনো প্রাণ যেন এভাবে সড়কে কোনো মাতাল, নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির হাতে না ঝড়ে, আর কোনো পরিবার যেনো নিজেদের সন্তানকে না হারান, কোনো মায়ের কোল যেন আর খালি না হয় এই ব্যাপারে দৃষ্টি প্রদানের দায়িত্ব সাধারণ জনগণের পাশাপাশি সরকারেরও। এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দেশে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। অপরাধী যে পরিবারেরই সদস্য হোক না কেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন, এই ব্যাপারটি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হোক।
তাদের দাবিগুলো হলো
১. যেকোনো মূল্যে এই হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতকরণ।
২. আহতদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার অবশ্যই বিবাদীপক্ষকে বহন করতে হবে।
৩. নিহত মাসুদের পরিবারকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বিবাদীপক্ষকে বাধ্য করতে হবে।
৪. তদন্ত কার্যক্রমে বাধাপ্রদানের চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৫. সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আর কারো প্রাণ যেন না যায় এবং সড়কে নিরাপত্তা যেন নিশ্চিত হয়, সেই ব্যাপারে যথোপযুক্ত ভূমিকা রাখতে সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।