উজ্জ্বল রায়,নড়াইল জেলা প্রতিনিধিঃ নড়াইলে এক সময় এ দেশে জমিদারি শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। শোষণ, লুণ্ঠনের পাশাপাশি অনেক জমিদার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন। ওই শাসন ব্যবস্থায় স্থানীয়ভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ছিলেন জমিদার। মূলত জমিদারকে ঘিরেই আবর্তিত হতো স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এবং শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় জমিদাররা এদেশে নির্মাণ করেছিলেন সুরম্য অসংখ্য অট্টালিকা। সুরম্য এসব কারুকার্যময় অট্টালিকার প্রধান আকর্ষণ ছিল প্রবেশদ্বারের ‘নহবতখানা’। বাদ্যযন্ত্রের সম্মিলিত সুর-ঝংকারের অন্যরকম আকর্ষণ ছিল নহবতখানা। জমিদারি বিনোদনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এই নহবতখানা। আমাদের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়ের পাঠানো তথ্য ও ছবির ভিত্তিতে জানা যায় এরকমই একটি নহবতখানা কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে নড়াইলের লোহাগড়ার ঐতিহ্যবাহী ইতনা গ্রামে। এলাকার প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জমিদারবাড়ির বিশাল অট্টালিকার প্রবেশমুখে নহবতখানা নির্মাণ করা হতো।
নহবতখানা ছিল সুউচ্চ, যা কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা হতো। কাঠের তৈরি নহবতখানার পাশাপাশি ইটের তৈরি সুরক্ষিত নহবতখানা নজর কাড়তো। দৃষ্টিনন্দন ও নানা কারুকার্য খচিত নহবতখানা ঘিরে গড়ে উঠেছিল বাদ্যকর শ্রেণি। নহবতখানা ও বাদ্যকররা ছিল একে অপরের পরিপূরক। হিন্দু সম্প্রদায়ের পাশাপাশি মুসলমান সম্প্রদায়ের বাদ্যকররা সহশিল্পী হিসেবে বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। বাদ্যকরদের কাজ ছিল সকাল-সন্ধ্যা নানা বাদ্যযন্ত্রের সংমিশ্রণে রাগ-রাগিনীর সুর ঝংকারে জমিদারসহ প্রজাদের মনোরঞ্জন করা। বাদ্যকররা পূজা-পার্বনসহ বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতামূলক সুরের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতেন। এজন্য জমিদার কর্তৃক তাদের বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হতো। অট্টালিকার আশেপাশেই এসব বাদ্যকর পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন। জমিদাররা বাদ্যকরদের বেতন ভাতাসহ সব ধরনের ব্যয়ভার বহন করতেন।
এখনও এদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাদ্যকর সম্পদায়ের অস্তিত্ব ও উপস্থিতি দেখা যায়। জমিদারি শাসন ব্যবস্থায় গণবিনোদনের ক্ষেত্রে নহবতখানার গুরুত্ব ও অবদান ছিল সর্বজন স্বীকৃত। সানাই, বাঁশি, ঢাক, ঢোল, খোল, তবলা, হারমোনিয়াম, করতাল, প্রেমজুড়ি, ম্যান্ডলিন, ক্লাইনেটসহ অন্যান্য দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্রের সমাহারে নহবতখানা মুখরিত থাকতো। যে জমিদারের ঐশ্বর্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি ছিল, সে জমিদারের নহবতখানা ছিল বেশি জৌলুসপূর্ণ। শুধু যে জমিদাররাই নহবতখানা নির্মাণ করতেন তা নয়। তাদের পাশাপাশি রাজা, মহারাজা, জোতদার, গাতিদার, তালুকদারসহ ধনাঢ্য ব্যক্তিরাও এটি নির্মাণ করতেন। বংশীয় আভিজাত্যের বিকাশ ঘটানোর জন্য অনেকে নহবতখানা নির্মাণ করতেন। জমিদারি শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নহবতখানার অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে।
রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে নহবতখানাগুলো জৌলুস হারিয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়ে। এরকম একটি নহবতখানা আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ইতনা গ্রামে। নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার কুন্দশী চৌরাস্তা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে মধুমতি নদীর পাড়ে ব্যানার্জি বাড়ির প্রবেশমুখে নহবতখানার অবস্থান। ইটের তৈরি নহবতখানায় রয়েছে শৈল্পিক নানা কারুকার্য। নহবতখানার মালিক ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী বাসুদেব ব্যানার্জি বলেন, ‘আমার দাদা মন্মথনাথ ব্যানার্জি রানি রাসমণির স্টেটের অধীনে ‘গাতিদার’ ও ‘তালুকদার’ ছিলেন। সে সময়ে তিনি নিজের এবং এলাকাবাসীর মনোরঞ্জনের জন্য বাড়ির সামনে একটি কারুকার্যময় নহবতখানা নির্মাণ করেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর নহবতখানাটি সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে। পরে নহবতখানা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করানোর জন্য আমি এর সংস্কার করেছি। এখনও দুর্গাপূজাসহ বাড়ির অন্যান্য উৎসব অনুষ্ঠানে এই নহবতখানা থেকে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হয়ে থাকে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।