সকল মেনু

সিন্ডিকেটের কারণে চাঁদপুরে ইলিশের দাম কমছে না

imagesশাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর: বিগত যে কোন সময়ের চাইতে এবার চাঁদপুরে ইলিশের সরবরাহ বেশি হলেও শক্তিশালী  সিন্ডিকেটের কারণে চাঁদপুরে ইলিশের দাম কমছে না। প্রতিদিন শত শত মণ ইলিশ চাঁদপুর মাছঘাটে আসছে। বরফের অভাবে এগুলো পঁচে যাচ্ছে। পঁচা ইলিশ কেটে লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। অনেক সময় লবণের অভাবে পঁচা ইলিশ নদীতে পর্যন্ত ফেলে দেয়া হচ্ছে। তারপরও মাছের দাম কমানো হচ্ছে না। ফলে চাঁদপুরের আমজনতা ইলিশের স্বাদ নিতে পারছে না।
ইলিশের মৌসুম প্রায় শেষ। ১২ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন এবার ইলিশের প্রজনন সময় চলবে। কিন্তু তার আগে চাঁদপুর মাছঘাটে ইলিশের ব্যাপক আমদানিতে বরফ ও লবণ সঙ্কটে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যাহত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানান, গত দেড় যুগেও চাঁদপুর মাছঘাটে এভাবে এত মাছ আমদানি দেখা যায়নি। চাঁদপুর ঘাটে আসা অধিকাংশ ইলিশ সাগর ও উপকূলীয় অঞ্চলে জেলেদের জালে ধৃত হলেও চাঁদপুর সীমানার পদ্মা-মেঘনায়ও প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। তাছাড়া এ বছর ইলিশের সাইজও আকারভেদে অনেকটা বড়। সড়ক ও নদীপথে ইলিশের বড় বড় চালান আসায় দেশের অন্যান্য স্থানের মত সরগরম চাঁদপুর মাছঘাট। প্রতিদিনই প্রায় সাড়ে ৪ হতে ৫ হাজার মণ ইলিশ চাঁদপুর ঘাটে আসছে। সব আড়তই ভাটির আর লোকাল ইলিশে সয়লাব। মাছঘাটকেন্দ্রিক শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণেই এখানে ইলিশের দাম কমছে না। এ জন্য প্রশাসনের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন এখানকার ক্রেতা সাধারণ। ইলিশ নির্ভর অর্থনীতিতে এবার মাছঘাটসহ চাঁদপুরের অন্যান্য সেক্টর বেশ চাঙ্গা। শুধু ইলিশকে ঘিরে প্রতিদিন চাঁদপুরে লেনদেন হচ্ছে ২ থেকে ৪ কোটি টাকা এমন তথ্য জানালেন চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান কালু ভূঁইয়া। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁদপুরের ব্যাংক পাড়ায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে এ সময়টিতে লেনদেন বেড়েছে। অনেকে বিকাশেও টাকা লেনদেন করছে। এর ফলে গত ১ মাস যাবৎ চাঁদপুরের ব্যবসা বাণিজ্যে কিছুটা চাঙ্গাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে বলে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান। ইলিশের ব্যাপক আমদানি, চাঙ্গা অর্থনীতি, ব্যবসায়ী ও জেলেদের মুখে তৃপ্তির হাসি, এতো হৈ চৈ, প্রচারণা সব মিলিয়ে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনায় আহরিত ইলিশের দাম ক্রেতা সাধারণের নাগালের বাইরে। লোকাল বড় সাইজের ইলিশ ঘাটে আসে, কিন্তু ঘাটে আসার পর পরিমাণ কমে যায়। ঘাটে লোকাল ইলিশ যা-ই পাওয়া যায়, তখন অবাক করা দামের কারণে ক্রেতা সাধারণ সাগরের কিংবা উপকূলীয় অঞ্চলের আহরিত বিভিন্ন সাইজের ইলিশ কিনে নিচ্ছে। লোকাল ইলিশ যা পদ্মা-মেঘনার ইলিশ, তার কেজি সাইজ এখনও ১হাজার ২শ’ টাকা থেকে ১ হাজার ৪শ’ টাকা। এত ইলিশ আমদানি সত্ত্বেও এখানকার মেঘনা-পদ্মার ইলিশের দাম কমছে না কেন? অনুসন্ধানে জানা যায়, চাঁদপুর ঘাটে আসা অধিকাংশ ইলিশ সড়ক ও নদী পথে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে ইলিশ কুমিল্লা, ফেনী, ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, সাভার, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, ভৈরবসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন গড়ে ৪০ থেকে ৫০টি ট্রাক, মিনিট্রাক ও পিকআপ বোঝাই করে চালানের নামে পাচার করা হচ্ছে। চাঁদপুর মাছঘাটের ব্যবসায়ী শবে বরাত, মানিক জমাদার, দুলাল গাজী জানান, চাঁদপুর থেকে কোনো মাছ পাচার করা হয় না। ঢাকায় বিভিন্ন স্থান থেকে ইলিশ আসে। ইলিশ যেহেতু দীর্ঘসময় রাখা যায় না তাই অনেক সময় ওইসব বাজারে কম দামেও ইলিশ বিক্রি করতে হয়। খুচরা ব্যবসায়ী সিডু গাজী জানান, চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার ইলিশের শুধু চাঁদপুর ঘাটেই নয়, ঢাকাসহ সব জায়গাতেই দাম বেশি। কম দামে যেসব মাছ কেনা হচ্ছে তা কোনোমতেই পদ্মা-মেঘনার ইলিশ নয়। সাগরের কিংবা উপকূলের মাছকেই চাঁদপুরের ইলিশ বলে কম দামে চালিয়ে দিচ্ছে। তাছাড়া চাঁদপুরের লোকাল ইলিশ বেশি দামে বিক্রি করার কারণ হলো, চাঁদপুর ঘাটে যখন ইলিশ আসে তখন এখান থেকে আকার ভেদে ইলিশের সাইজ নির্ধারণ করা হয়। যে কারণে ইলিশের ছোট-বড় আকার ভেদে মাছের দামের হিসাব নির্ণয় করা হয়ে থাকে। চাঁদপুর শহরের গুণরাজদি এলাকার ট্রাক চালক হারুন গাজী ও মোফাজ্জল খলিফা জানান, তারা নিয়মিত এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মোকামে মাছ পরিবহন করে থাকেন। তারা জানান, চাঁদপুর ঘাট থেকে বিভিন্ন মোকামিরা ৪৪ কেজি মণ হিসেবে মাছ কিনে নেয়। এভাবে প্রতি ট্রাকে করে যদি ১শ’ মণ মাছ কিনে নেয় তাহলে ১০ মণ এখানে ওই মোকামি বাড়তি পায়। এই মাছটি তাদের লাভ। যে জন্যে বিভিন্ন অঞ্চলের বাজারে ক্রেতারা চাঁদপুরের চেয়ে কিছুটা কম দামে মাছ কিনতে পারছে। মাছঘাটের ট্রলার থেকে মাথায় বহন করে ইলিশ আড়তে নিয়ে আসা শ্রমিক রহিম দর্জি, মোস্তফা জমাদার জানান, জেলেদের আহরিত ইলিশ হাত বদল হয়ে বেপারীরা আড়তে নিয়ে আসে। আড়ত থেকে চালানীরা নিয়ে নেয়। চাঁদপুর মাছঘাটে যারাই আড়তদার তারাই চালানী এবং ফ্যাক্টরীতে মজুতদার। পুরো মাছ ঘাট সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত। যেসব মাছ ঘাটে আসে তা স্তূপ করে নিলাম ডাকা হয়। সংঘবদ্ধ চক্র সমুদয় ইলিশ কিনে বরফ দিয়ে ককশীটের বাক্সে এবং কাঠের বাক্সে প্যাকেট করে। সেই মাছই ট্রাকযোগে চাঁদপুর থেকে পাচার হয়ে যায়। আবার একটা অংশ চলে যায় বিভিন্ন ফ্যাক্টরীতে। যারা হিমাগার করে ইলিশ মজুদ রাখেন, ইলিশ রপ্তানি নিষিদ্ধ থাকার পরও দেখা যায় এখান থেকে ইলিশের চালান দেশের বিভিন্ন মোকামে যায় এবং সেখান থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় পার্শ্ববর্তী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার হয়। সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে দিনে কিংবা রাতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে পশ্চিমবঙ্গে, সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সুরমা নদী পার হয়ে এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ত্রিপুরা, আসামের গোহাটি, শীলচর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে শত শত মণ ইলিশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ জন্যে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সফিকুর রহমান প্রশাসনের পক্ষ থেকে মার্কেটিং স্টাডি করার পরামর্শ দেন।

চাঁদপুরে ইলিশের বড় চালানী আঃ মালেক খন্দকার, বাবুল গাজী, আনোয়ার গাজী, মনসুর বন্দুকসী, মোস্তফা খালাসী, দুলাল গাজী, দেলু খাঁ, ভাগিনা ফারুক, ছিদ্দিক আলী, চন্দন বাবু, মানিক, মিজান শেখ, নান্টু কাদির, ইউসুফ বন্দুকসী, দাদন মিয়া, কুদ্দুছ খান, বড় সিরাজ, বিল্লাল কাজী, রব চোকদার, কৃষ্ণ বাবুসহ আরো অনেকে ইলিশ চালানির নামে চাঁদপুর থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন। তবে চাঁদপুর থেকে সরাসরি মাছ ভারতে পাচারের বিষয়টি কোনো ব্যবসায়ী স্বীকার করছেন না। এদিকে গত ৪/৫ মাস ধরে বরফ ও কাঁচা লবণ সঙ্কটে চাঁদপুর মাছঘাটে ইলিশ প্রক্রিযাজাতকরণ ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিদিন চাঁদপুরের ৭টি বরফ মিলের উৎপাদিত প্রায় ৫ হাজার ক্যান বরফেও সামাল দেয়া যাচ্ছে না এখানকার ইলিশ সংরক্ষণের কাজ। যদিও বরফের কোনো সঙ্কট নেই বলে দাবি করছেন বরফ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আরব আলী। বর্তমানে প্রচুর পরিমাণ পচা ও নরম ইলিশ অনেক ব্যবসায়ী কম দামে কিনে নিয়ে ডিম আলাদা করে ইলিশে লবণ দিয়ে লোনা ইলিশের স্তূপ করছেন। কিন্তু কাঁচা লবণেরও সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যার ফলে চাঁদপুর মাছঘাটে এখন নরম ও পচা ইলিশেরও স্তূপ দেখা যাচ্ছে। এত কিছুর পরও ব্যসায়ীদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এখানকার ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যার ফলে চাঁদপুরে ইলিশের ব্যাপক আমদানিতেও দাম কমছে না।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top