সকল মেনু

‘আমার মেয়ে কবরে একা কীভাবে ঘুমাবে?’

বান্ধবীর সঙ্গে সেলফিতে কাজী নেহলিন বিনতে আকবর (পেছনে) l ছবি: সংগৃহীত‘আম্মু, তুমি রোজা রেখেছ। কষ্ট করিও না। আমার জন্য ডিম সেদ্ধ করে রাখ। তা দিয়েই দুপুরের খাবার খেয়ে নেব। এখন আমি গাড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব।’ গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মা ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় কাজী নেহলিন বিনতে আকবরের।কে জানত, এটিই হবে মায়ের সঙ্গে নেহলিনের শেষ কথোপকথন! এর মিনিট দশেক পরই নেহলিনকে বহনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ির দুর্ঘটনায় পড়ার খবর পান ফরিদা ইয়াসমিন। তৎক্ষণাৎ ছুটতে থাকেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগে পথেই পান জীবনের নির্মম সংবাদ, ‘আদরের নেহলিন আর নেই’।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) ছাত্রীদের বহনকারী বাসের সঙ্গে উল্টো দিক থেকে আসা ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে মারা যান ইংরেজি বিভাগের সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্রী কাজী নেহলিন বিনতে আকবর। চিকিৎসক বাবা কাজী আলী আকবর ও মা ফরিদা ইয়াসমিনের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে নেহলিন ছোট। নগরের সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাসা।
মেয়ের মৃত্যুর পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্বামী ও ছেলেকে নিয়ে একই আবাসিক এলাকার বি-ব্লকে বাবার বাসায় চলে যান ফরিদা ইয়াসমিন। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ৫৯/এ নম্বর বাড়ির দোতলার বাসায় গিয়ে দেখা যায়, একের পর এক আত্মীয়স্বজন আসছেন। সান্ত্বনা দিচ্ছেন মেয়ে হারানো ফরিদা ও আলী আকবরকে।
পটিয়ার একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমার মতো তারও (নেহলিন) শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা ছিল। তাই স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়। স্বপ্ন পূরণের আগেই কোথায় হারিয়ে গেল মেয়েটি।’
মেয়ের হাসিমাখা মুখ কিছুতেই ভুলতে পারছেন না ফরিদা ইয়াসমিন। ‘বকা দিলে শুধু হাসত। একটুও প্রতিবাদ করত না। আমার ফুলের মতো মেয়ে। এখন আমার মেয়ে কবরে একা কীভাবে ঘুমাবে?’ এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
একপর্যায়ে পাশের একটি কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন নেহলিনের বড় ভাই কাজী রিয়াসাত আলভী। ছবি তুলে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। আলোকচিত্রী বড় ভাইয়ের এসব অর্জনে সব সময় উচ্ছ্বসিত ছিলেন নেহলিন। আদরের ছোট বোনকে হারিয়ে নির্বাক আলভী। দৃষ্টিতে রাজ্যের শূন্যতা। মিনিট দু-এক থাকার পর আবার কক্ষে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন।
গত শুক্রবার দুপুরে নগরের মিসকিন শাহ মাজার কবরস্থানে দাফন করা হয় নেহলিনকে। এর আগে হাজী মুহম্মদ মুহসীন কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত জানাজায় হাজির হয় শত শত মানুষ।
অাদরের ছোট মেয়ে নেই, মানতেই পারছেন না নেহলিনের মা ফরিদা ইয়াসমিন। ছবিটি গত শুক্রবার সন্ধ্যায় নগরের সুগন্ধার বাসা থেকে তোলা l জুয়েল শীলনেহলিনের এভাবে চলে যাওয়া মানতে পারছেন না তাঁর বান্ধবী সুমাইয়া মাহবুব ও তাসনীয়া নওশীন। বৃহস্পতিবার একসঙ্গেই ক্লাস করা, গল্প করতে করতে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হয়ে আসা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে উঠে ছবি তোলার পরিকল্পনা, তিনজন তিন গাড়িতে উঠে পড়া—এসব টুকরো টুকরো ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে দুজনের স্মৃতিতে।
প্রাণবন্ত ও চঞ্চল নেহলিন আর কখনো শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন না, মাতিয়ে রাখবেন না আড্ডা, সেলফিপাগল মেয়েটি ফেসবুক পাতায় তাঁর হাসিখুশি ছবি পোস্ট করবেন না—এসব আর ভাবতেই পারছেন না তাঁরা। নেহলিনের প্রসঙ্গ তুলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই বান্ধবী। শুধু এইটুকু বলেন, ‘এ কী হলো। সে এভাবে চলে যাবে?’
আইআইইউসির ইংরেজি বিভাগের সভাপতি মো. ইফতেখার উদ্দিন বলেন, ‘সে সহজেই আপন করে নিতে পারত মানুষকে। তার হুট করে চলে যাওয়া আমাদের মনে বিশাল শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।’
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের বান্ধবী বা শিক্ষক নয়, নেহলিনের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না ছোটবেলার বান্ধবীরাও। সামিরা সাফা ও মাবিয়া আফরোজ বলেন, ‘অন্য রকম এক মেয়ে ছিল নেহলিন। সারাক্ষণ হাসি লেগে থাকত মুখে। আড্ডা দিতে খুব পছন্দ করত। সে-ই কিনা আমাদের ছেড়ে চলে গেল।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top