সকল মেনু

প্রতিরোধের মার্চ: অসহযোগ ও মুক্তিযুদ্ধে পার্বতীপুর

indexরাইসুল ইসলাম, পার্বতীপুর,দিনাজপুর: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে দীর্ঘ ৯মাস ধরে। অসহযোগ বা স্বাধিকার আন্দোলন হয়েছে এর আগে। তারও আগে দীর্ঘ ২৩বছর আন্দোলন লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে বাঙালিদের। দেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত রেল জংশনখ্যাত পার্বতীপুরে বাঙালি যুবকেরা অসহযোগ আন্দোলন করেছে অতুলনীয় ভূমিকায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে ভিন্ন মাত্রায়, স্বতস্ফূর্ত ও আবেগ তারিত হয়ে। ১৯৭১সালের ৭মার্চ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ জনতার সামনে এক ঐতিহাসিক ভাষনদান করেন। তার ভাষনটি ছিলো জাতির জন্য দিকনির্দেশনা মূলক ও বিশ্ব ইতিহাসের অনন্য ও অন্যতম এক শেষ্ঠ ভাষন। ওই ভাষনের সাথে সাথে সারা দেশে বাঙালিদের মধ্যে করনীয় ঠিক হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয় সবখানে।
দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন থানা পার্বতীপুরের শহর এলাকায় অবাঙালি বিহারীদের প্রধান্য ও তাদের নিয়ন্ত্রনে ছিলো সব ধরনের ব্যবসা বাণিজ্য। প্রসঙ্গতঃ দিনাজপুরের পার্বতীপুুরে রেল জংশন স্থাপিত হয় ১৮৭৯হ’তে ১৮৮৪ সালের মধ্যে। চার লাইনের রেল জংশন হওয়ায় সমগ্র ভারতবর্ষে এর পরিচিতি গড়ে ওঠে অল্প সময়ের মধ্যে। জানাযায়, বিহারীদের প্রাধান্য, একচ্ছত্র আধিপত্যের কারনে বাঙালিরা নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়ে। বাজার হাট করতে আসা অথবা নিত্যপণ্য বিক্রি করতে গিয়ে অনেক বাঙালি অবাঙালি বিহারীদের দ্বারা নানাভাবে লাঞ্চিত ও নির্যাতিত হন। এসব কারনে বহু আগে থেকে বাঙালিদের মধ্যে অবাঙালি বিহারীদের উপর ক্ষোভ ও ঘিনা জন্ম নেয়। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে বাঙালিদের মধ্যে সে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। অপরদিকে, বিহারীদের নেতা বাচ্চা খান, কামরুজ্জামান, শোয়েব ও ইকবাল কন্ট্রাক্টরদের অত্যাচার নির্যাতনে কমপক্ষে ২৫যুবক নির্যাতিত হন। তার মধ্যে মোঃ ইব্রাহীম, রোস্তম আলী, মোজাফ্ফর হোসেন, ডাঃ শামসাদ ও বুলবুল আহমেদের নাম জানা গেছে। মুক্তিযুদ্ধে পার্বতীপুর থেকে প্রায় ৮শ’ যুবক সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। তারা বাংলাদেশে এসে পার্বতীপুর ও পার্শবর্তী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধে পার্বতীপুরের কমপক্ষে ৫০ব্যক্তি শহীদ হন। এর মধ্যে আনোয়ারুল ইসলাম, আব্বাস আলী, ফাহির উদ্দিন, ইসমাইল হোসেন, আবেদ আলী, ফজলে রহমান, মফলেহ উদ্দিন, আব্দুল মজিদ, আজিজুল হক, আব্দুল জলিল, আব্দুল লতিফ, আবেদ আলী, শাহজাহান, আজির উদ্দিন ও জয়নাল আবেদিনের নাম জানা যায়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের কারনে যাদের নাম মানুষের মুখে মুখে ফিরে এসেছে তাদের মধ্যে মোঃ মোফাজ্জল হোসেন, মহরুম আব্দুল জব্বার মন্ডল, আব্দুল সাত্তার, অ্যাডভোকেট আব্দুল হাই, এটিএম রেজাউল ইসলাম বুলবুল, মোঃ আলাউদ্দিন, প্রফেসর আফজাল হোসেন, মহরুম আবু এহিয়া সরকার, শহীদুল ইসলাম, তমিজ উদ্দিন, নুরুজ্জামান চৌধুরী, তহুবার রহমান, আবু সাঈদ, আমিনুল ইসলা, ইলিয়াস আহমেদ, আমজাদ হোসেন, সিদ্দিক হোসেন, এনতাজুল ইসলাম, এরশাদুল হক ও জহুরুল হকের নাম উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযোদ্ধা মোঃ এনতাজুল ইসলাম পিতা মরহুম নাসিরউদ্দিন সরকার, মাতা আমেনা খাতুন। বাড়ি উপজেলার ৪নং পলাশবাড়ী ইউনিয়নের ধোবাকল গ্রামে। ১৯৭০ সালে এনতাজুল ইসলাম এসএসসি পাশ করেন। ৭১’ সালে আইএ প্রথম বর্ষে অধ্যায়নকালে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। এনতাজুল বলেন, পার্বতীপুর শহর ছিলো বিহারী অধ্যুষিত। এখানকার অবাঙালি বিহারীরা বাজার ঘাট করতে আসা বাঙালিদের উপর নানাভাবে নির্যাতন নিপীড়ন ও গালমন্দ করতো। এনতাজুল জানান, মে মাসের শেষের দিকে তাদের ৬০জন যুবকের একটি দল তেতুলতলী বাজার থেকে দুর্গাপুর, অচিতপুর হয়ে ভারতের কাটলা ইয়ুথ ক্যাম্প গমন করে। সেসময় ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন,  মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক অ্যাডভোকেট খতিবুর রহমান এমসিএ, আলহাজ মুহিউদ্দিন আহমেদ, ডাঃ খনিভূর্ষন মজুমদার ও সরকার কবীর উদ্দিন (বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী)। ৬০জন যুবকের এই দলে আরো ছিলেন, আবু মুছা, হাফিজার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, মোসলেম উদ্দিন, এরশাদুল হক, অহিদুল হক, আব্দুল কুদ্দুস, মোকারম হোসেন প্রমুখ। উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মোঃ মোফাজ্জল হোসেন পার্বতীপুর চিরিরবন্দর ও ফুলবাড়ি থানা নিয়ে গঠিত মুক্তিযোদ্ধা ওয়েল ফেয়ার কমিটির সীমান্ত এলাকার সুপারভাইজার ছিলেন। তিনি পার্বতীপুর শহরে ও পার্শবর্তী হাবড়া, ভবানীপুর, পূর্বশেরপুর, নূরুল হুদা ডাঙ্গার হাট, খকির বাজার, জমির হাট ও হুগলীপাড়ার অসহযোগ আন্দোলনের বিবরণ দেন। অপরদিকে, পার্বতীপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডার অ্যাডভোকেট আব্দুল হাই, ডেপুটি কমান্ডার সিদ্দিক হোসেন, সহকারী কমান্ডার এনতাজুল ইসলামসহ অন্যরা বলেন, পাকিস্তানীরা বাঙালিদের ২৩বছর শোষন করেছে। আর পার্বতীপুরের বাঙালিরা দীর্ঘদিন ধরে অবাঙালি বিহারীদের হাতে নানাভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েছে। এর ফলে এখানে অসহযোগ আন্দোলন এক ভিন্নমাত্রা পায়। আর সেকারনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণও ছিলো স্বতস্ফূর্ত এবং আবেগতাড়িত।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top