২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫, নিরাপদ নিউজ, ওবাইদুল হক আবু চৌধুরী,বিশেষ প্রতিবেদক: কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার তিন বছর পূর্ণ হয়েছে আজ। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আজকের এইদিনে ইতিহাসের বর্বর ধ্বংসলিলা চালানো হয়েছিল ধর্মীয় সম্প্রীতির লিলাভূমি এই জনপদে। এ ঘটনা দিয়ে শত বছরের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ফাটল ধরে।
তবে, সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে ইতোমধ্যে সেই ছিড় ধরা ধর্মীয় সম্প্রীতিতে আবারো জোড়া লাগা শুরু হয়েছে। হারনো ঐতিহ্যের স্থানে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সুরম্য অট্রালিকা।
অন্যদিকে তিন বছরের মাথায় এসেও মামলার চার্জশিট দাখিল নিয়ে রয়েছে চরম অসন্তোষ। বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগণ বলছেন এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে চিহ্নিত অনেক মানুষ মামলার আসামী নন। আবার একেবারে জড়িত নন এমন অনেকেই আসামী হয়েছেন। এক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে তাদের।
জানাযায়, এ ঘটনার পর কক্সবাজারের ৪ টি উপজেলায় ১৯ টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলা দায়ের কালিন সময় এসব মামলায় ১৫ হাজার ব্যক্তিকে আসামী দেখানো হয়। এজাহারে নাম উল্লেখ করা হয়েছে ৩৭৫ জনকে। এর মধ্যে শুধু মাত্র রামু উপজেলার ঘটনায় মামলা ছিল ৮ টি।
কক্সবাজার সদর থানায় ২ টি, টেকনাফ থানা ২ টি, উখিয়া থানায় ৭টি মামলা দায়ের করা হয়। ঘটনার ৩ বছরের মধ্যে এ ১৯ টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করেছে পুলিশ।
আদালত সূত্র জানা যায়, এ ১৯ মামলায় চার্জশিটে আসামী করা হয়েছে ৯৪৫ জনকে। এর মধ্যে রামু উপজেলার ৮ মামলায় অভিযুক্ত হলেন ৪৫৮ জন।
বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির রামু উপজেলা সভাপতি স্বপন বড়–য়া জানান, ঘটনার ৩ বছরের মধ্যে বৌদ্ধরা নিরাপত্তায় রয়েছে। কিন্তু মামলার প্রক্রিয়াটি আরো যাচাই বাছাই জরুরী। এতে যে সব নিরীহ লোক হয়রানী হচ্ছে তাদের বাদ দিয়ে প্রকৃতদের আসামী করে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি এ ঘটনার বিচার না হলে অপরাধিরা উৎসাহী হবে।
বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি (যুব) এর সভাপতি সুরেশ বড়য়া জানান, ঘটনার অনেক ছবি ও ভিডিও রয়েছে। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির তদন্তও হয়েছে। এতে চিহ্নিতদের অনেকেই মামলায় আসামী নন। আবার এমন অনেক ব্যক্তিকে মামলায় জড়ানো হয়েছে যারা কোনভাবেই এ ঘটনায় জড়িত নন। ফলে বিষয়টি জটিল হয়ে উঠেছে।
অন্যদিকে নতুন রূপে সেজেছে রামুর বৌদ্ধপল্লী। বদলে গেছে সবকিছু। ইতিহাসের জঘন্যবর্বর ধ্বংস জজ্ঞের কিছুই আর চোখে পড়েনা। ক্ষতিগ্রস্থ বিহারের ধ্বংস্তুপের মাঝেই তৈরী করা হয়েছে আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতে দৃষ্টি নন্দন বৌদ্ধ বিহার। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে মাত্র ১০ মাসে বিহার নির্মাণ কাজ শেষ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব বিহার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ভোধন করেন।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার ঘুরে দেখা যায়, এখানেও ওঠেছে তিনতলা সুরম্য ভবন । জানা গেল, ক্ষতিগ্রস্থ ১২টি বিহারের মধ্যে সবচে বেশী টাকা ব্যায় করা হয়েছে এই বিহারে ।
এছাড়াও শ্রীকুল গ্রামের লাল চিং,সাদা চিং,অপর্ণা চরণ চিং এবং মৈত্রী বিহারের চেহেরাও পাল্টে গেছে। সাদা চিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে বেশ কিছুদিন আগে । পাশের মৈত্রী বিহার এবং অপর্ণাচরণ চিংসহ একইস্থানে পাশাপাশি চারটি বিহারে এই কম্পাউনটিও অসাধারণ লাগছে।
রামু মৈত্রী বিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পলাশ বড়–য়া জানান, রামু সহিংসতার পর রাত-দিন পরিশ্রম করে সেনা বাহিনী অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে ক্ষতিগ্রস্থ বিহারগুলোর নির্মান কাজ করেছে। তবে হামলার ঘটনার সঠিক বিচার না হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশংকা থেকেই যায়।
স্থানীয় শিক্ষাবীদ নিলুৎপল বড়–য়া জানান, “আমরা চাই যেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ পল্লী ও বিহার পুন:র্নিমাণ হয়েছে-সেভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আগের মতো নির্মিত হোক। আমরা আগের অবস্থানে ফিরে যেতে চাই।”
“এটা আমরা প্রত্যাশা করছি যে, আগের মতো মিলেমিশে থাকবো। কোন রকম ভেদাভেদ থাকবে না। প্রতিশোধ মূলক কোন রকম বিষয় থাকবেনা আমাদের মনে।” যোগ করেন এই শিক্ষাবীদ।
কেন্দ্রীয় সীমা বৌদ্ধ বিহারের সহকারী অধ্যক্ষ প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু জানিয়েছেন, “সরকারী উদ্যোগে দেশবাসীর সহযোগিতায় পুনরায় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা গুলোতে বিহার নির্মাণ করা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ যোগ্য।
তিনি বলেন, “এ কাজটা করা না হলে সম্প্রীতি আর আস্থা দুটোতেই অনেক তফাৎ থেকে যেতো। এখন বিহার গুলো নির্মাণ আর বিচারের ধারা অব্যাহত রাখা-একাজ গুলো করাতে বৌদ্ধ সম্প্রদায় আগে যতটুকু হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, এখন ততটুকুতে ওরা নেই। ধীরে-ধীরে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে।”
প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু আরো বলেন, “বিহার নির্মাণ কর্মসূচী ভাল হয়েছে, পুজারীদের মনের খোরাক যোগ হয়েছে, আমরা আশা করছি -তাদের মনে সেই দাগ মুছে গিয়ে পুনরায় সম্প্রীতির ভাবটা আবারো জেগে উঠবে।”
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার শ্যামল কুমার নাথ জানিয়েছেন, পুলিশ তদন্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছেন। আদালত বিচার করে জড়িত এবং জড়িত নয় প্রমাণ করবেন। বিচার চলছে।
উল্লেখ্য ,রামুর উত্তম বড়–য়া নামের এক যুবকের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে পবিত্র কোরান শরিফ অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উগ্র ধর্মান্ধগোষ্ঠী রামুর বারটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারও ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় অরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার ও শতাধিক বসতঘরে ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়।
পরদিন উখিয়া-টেকনাফে আরো কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে একই ঘটনা ঘটে। প্রধান মন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনী ক্ষতিগ্রস্থ বিহার পূননির্মানের কাজ করে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।