নিরাপদনিউজ ডেস্ক, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ : জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করছে জার্মানি ও ফ্রান্স। এই দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা আজ আসছেন। তারা দেশের দক্ষিণাঞ্চল সফর করে জলবায়ু পরিবর্তনের নানা দিক দেখবেন। সফর উপলক্ষে এই দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যৌথভাবে লেখা নিবন্ধটি প্রকাশিত হলো।
জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর আমাদের ‘সন্তান ও নাতি-নাতনিদের’ জন্য দূরবর্তী কোনো ব্যাপার নয়। এটা আমাদের জন্য জরুরি চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিনই বিশ্বের কোথাও না কোথাও আঘাত হানছে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, ধ্বংস হচ্ছে বাড়িঘর, স্কুল। খরার কারণে ফসলহানি ঘটছে, পানিস্বল্পতা সৃষ্টি হচ্ছে। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বজুড়েই উপকূলীয় অঞ্চলগুলো বিপদের মুখে পড়ছে। ভয়াবহ বন্যার কারণে হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। আর মূল্যবান কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এগুলো শুধুই ‘পরিবর্তন’ নয়। এ কারণে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে, আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা, গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টেনে ধরার জন্য বৈশ্বিকভাবে নানা চেষ্টা চালানো হচ্ছে, সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ বছরের ডিসেম্বরে বিশ্বনেতারা ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (ইউএনএফসিসিসি) আওতায় নতুন চুক্তি করার জন্য প্যারিসে মিলিত হবেন। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির গড় হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এ লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জনে আমরা এ যাবৎ যত সুযোগ পেয়েছি, তার মধ্যে এটিই সেরা। আমাদের একটি বাস্তব অথচ উচ্চাভিলাষী ও সমন্বিত আইনি চুক্তিতে আসতে হবে, আর সেটা করতে হলে সব দেশেরই সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
আজ বাংলাদেশে এসে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনবিরোধী লড়াইয়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছি। ভৌগোলিক কারণেই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকা দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। বৈরী আবহাওয়ার কারণে ইতিমধ্যে লাখ লাখ বাংলাদেশি তীব্র চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, যার কারণে অবকাঠামো ও কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে।
এসব চ্যালেঞ্জের মানে হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের ভারসাম্যপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। একদিকে, আমাদের বিশ্বজুড়ে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ খুব দ্রুত ও ব্যাপক হারে কমাতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়। অন্যদিকে, অভিযোজন নীতির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য প্রভাব সামাল দিতে হবে, যেটা ইতিমধ্যে অনুভূত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় যথার্থ কর্মসূচি নিতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশকে তার দায়িত্ব, অগ্রাধিকার ও বিকাশমান পরিস্থিতি অনুসারে অভিযোজন ও প্রশমন-এ দুটি ব্যাপারকেই ভারসাম্যপূর্ণভাবে আমলে নিতে হবে।
গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন দ্রুত কমাতে উন্নত দেশগুলোকে নেতৃত্ব দিতে হবে। গত জুনে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত জি-৭-এর বৈঠকে উন্নত দেশগুলো নিজেদের সংকল্পের কথা জানিয়েছে। সেখানে বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলো ‘এ শতকজুড়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে কার্বনমুক্ত করার’ ব্যাপারে একমত হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ২৮টি সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে জার্মানি ও ফ্রান্সও নিজেদের দায়িত্ব নিয়েছে। ইইউ ২০৩০ সালের মধ্যে নিজেদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ১৯৯০ সালের তুলনায় ৪০ শতাংশ কমাতে রাজি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং আরও ৩০টি দেশ নিজেদের ‘জাতীয় ভূমিকার’ পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে এসেছে। অর্থাৎ, ২০২৫ ও ২০৩০ সালের মধ্যে তারা যে কর্মসূচি নেবে, সেটা জানিয়েছে। বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশ কী করবে, প্যারিস সম্মেলনে তারা এর রূপরেখা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর মধ্যে আমরা আশা করি, তাদের ‘অবদানের’ মধ্যে বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ চলে আসবে। প্যারিসে আমরা যে চুক্তিতে আসব বলে আশা করছি, তার ভিত্তি হবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সত্যিকারের বৈশ্বিক কর্মসূচি।
লক্ষ্য নির্ধারণ ও নীতি প্রণয়ন করাই যথেষ্ট নয়, যদি সেটা বাস্তবায়ন করার মতো ক্ষমতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর না থাকে। জি-৭-এর নেতারা তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন, তারা ২০২০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার তুলবেন। এই প্রতিশ্রুতি গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া সব আর্থিক প্রবাহের গন্তব্য হওয়া উচিত নিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী ও স্থিতিস্থাপক অর্থনীতির দেশগুলো। সরকারের অর্থায়ন এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে এ কারণে যে এর গতিমুখ বেসরকারি অর্থায়নের গতিমুখ নির্ধারণ করবে, সেটাকে নিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী শিল্পে বিনিয়োগের ব্যাপারে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে। আর সরকারি অর্থায়ন এটাও নিশ্চিত করবে যে সবচেয়ে অরক্ষিত দেশগুলো যাতে অর্থ পায়, বিশেষ করে অভিযোজনের জন্য।
বাস্তব ক্ষেত্রে জলবায়ুর ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্যকর সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। আজ আমরা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল সফর করে নিজ চোখে দেখব, সেই অঞ্চলগুলো কীভাবে আবহাওয়ার চরমভাবাপন্নতার বিরুদ্ধে লড়ছে, দীর্ঘমেয়াদি কী পরিবর্তন সেখানে ঘটছে। পটুয়াখালীতে আমাদের সহযোগিতায় স্থানীয় মানুষের সহনক্ষমতা বাড়াতে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র বানানো হয়েছে। যে ভবনগুলো আমরা উদ্বোধন করছি, তার উদ্দেশ্য দ্বিমুখী: এক. প্রয়োজনের সময় মানুষকে আশ্রয় দেওয়া; দুই. সেগুলোকে বছরের অন্যান্য সময় স্কুল হিসেবে ব্যবহার করা। এতে বোঝা যায়, দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন অগ্রাধিকার ত্যাগ না করে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে পারে; আর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জনস্বাস্থ্য ও সম্পদের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা-সংক্রান্ত কর্মসূচির পার্শ্ব সুবিধা লাভ করতে পারে।
বাংলাদেশকে নিজের প্রচেষ্টায় পূর্ণ সহযোগিতা করবে জার্মানি ও ফ্রান্স। দেশ দুটি বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সহযোগী। স্বল্পোন্নত সব দেশ ও পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে আমরা প্যারিসে এক উচ্চাভিলাষী ফলাফল পাওয়ার চেষ্টা করব। হুমকিকে অগ্রাহ্য করা যাবে না, সুযোগ নিতে হবে।
ফ্রাংক-ওয়াল্টার স্টেইনমায়ার: জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী
লরাঁ ফাবিউস: ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।