ঢাকা, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৫, নিরাপদনিউজ : কৃষিজমি সুরক্ষায় একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার। আবাদি কৃষিজমি বিনষ্ট করলে আইনে জেল-জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আইনের খসড়ায় ভূমি জোনিং করে কৃষিজমির মানচিত্র তৈরির কথাও বলা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনে।
অকৃষি জমিতে আবাসন-স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমির উর্ধ্বমুখী ব্যবহারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন, ২০১৫’ নামে আইনটির খসড়া প্রণয়ন করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
এই আইন অমান্য করলে অনুর্ধ্ব দুই বছর জেল এবং সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুণতে হবে। কৃষিজমি সুরক্ষার পাশাপাশি ভূমির যথেচ্ছা ব্যবহার রোধে এ আইন বলে জানিয়েছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
খসড়ার উপর মতামত নিয়ে তা অনুমোদনের জন্য দ্রুতই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শফিউল আলম।
আইনের খসড়ায় বলা হয়, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে আবাসন, শিল্প-কারখানা বা রাস্তাঘাট নির্মাণের জন্য প্রতিনিয়তই ভূমির প্রকৃতি ও শ্রেণিগত ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষিজমি, বনভূমি, টিলা, পাহাড় ও জলাশয় বা জলমহাল বিনষ্ট হয়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ছে। ঘটছে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয়।
অপরিকল্পিত উন্নয়ন রোধ করে ভূমির শ্রেণি বা প্রকৃতি ধরে রেখে পরিবেশ ও খাদ্যশস্য উৎপাদন অব্যাহত রাখা এবং কৃষিজমি ও কৃষিপ্রযুক্তির প্রায়োগিক সুবিধার সুরক্ষাসহ ভূমির পরিকল্পিত এবং সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য।
‘কৃষিজমি’ বলতে ফসলী জমি, বনভূমি, গোচারণ ভূমি, খড় উৎপাদনের ভূমি, পশুখাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ব্যবহৃত ভূমি, চা বাগান, ব্যক্তিগত বনভূমি, ফলদ উদ্ভিদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত ভূমিকে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও ফলফুল, শাক-সবজি, মসলা, ডাল, তেল জাতীয় খাদ্য, ওষুধি, সুগন্ধি, প্রাকৃতিক রঙ, বাঁশ, বেত, হোগলা-গোলপাতা ও অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদন করা হয়; এমন ভূমি, মাছ চাষের পাশাপাশি ফসল উৎপাদনের জলাশয়- কৃষিজমির অন্তর্ভুক্ত হবে।
কৃষিজমি সুরক্ষা
আইনের মাধ্যমে কৃষিজমি সুরক্ষা করতে হবে এবং কোনভাবেই তার ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। কোন কৃষি জমি নষ্ট করে আবাসন, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোন অকৃষি স্থাপনা নির্মাণের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনুর্বর, অকৃষি জমিতে আবাসন, বাড়িঘর, শিল্প-কারখানা স্থাপনের কথা বলা হয়।
যে কোনো শিল্প-কারখানা, সরকারি-বেসরকারি অফিস ভবন, বাসস্থান এবং অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে ভূমির উর্ধ্বমুখী ব্যবহারকে গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য থাকবে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা।
কৃষিজমি যে কেউ ক্রয়-বিক্রয় করতে পারলেও তা আবশ্যিকভাবে শুধু কৃষিকাজেই ব্যবহার করতে হবে এবং ব্যত্যয় ঘটলে জমির মালিকানা সরকারের উপর ন্যস্ত হবে।
একাধিক ফসলি জমি সরকারি-বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য কোন অবস্থাতেই অধিগ্রহণ করা যাবে না। কৃষিজমি চিংড়ি মহাল হিসেবে ঘোষণা করাও যাবে না।
কৃষিজমি ছাড়া অন্য জমির সুরক্ষা
ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যে সব জমি বনভূমি, টিলা-পাহাড় শ্রেণির, জলাভূমি, চা বাগান, ফলের বাগান, রাবার বাগান ও বিশেষ ধরনের বাগান হিসাবে পরিচিত; তাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ভূ-প্রকৃতিগত কোন পরিবর্তন আনা যাবে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপচয় রোধে জমির অধিগ্রহণ ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে হবে এবং অধিগ্রহণকৃত জমির অপব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। অধিগ্রহণকৃত জমি বেদখলে থাকলে তা অনুসন্ধান করে মুক্ত করতে হবে।
ভূমির অপচয় রোধে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে একাধিক প্রতিষ্ঠানকে একই এলাকায় নিবিড়ভাবে স্থান সংকুলানের উপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে আইনে।
কৃষি জমিতে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ফসল (যেমন- তামাক) উৎপাদনও করা যাবে না।
সায়রাতমহাল সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধার
খাল-বিল, হাওর-বাওর ও ঝিলসহ যে কোন ধরনের সায়রাতমহালের বা জলাভূমির কোন শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না।
হাটবাজার, বালুমহাল, পাথরমহাল, বাগান মহাল, প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকারও শ্রেণি পরিবর্তন ঘটানো যাবে না।
অন্যান্য ভূমি সুরক্ষা
নদ-নদী, বনভূমি, টিলা-পাহাড়, খেলার মাঠ, সড়ক ও জনপথ, রেললাইন ও তার সংলগ্ন ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বলেও আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে। তবে অপরিহার্য ক্ষেত্রে অনুমতি নিয়ে বনভূমি ও টিলা পাহাড় ব্যতীত কাঙ্খিত পরিবর্তন করা যাবে।
ভূমি জোনিং
সরকার ভূমির বিদ্যমান বহুমাত্রিক ব্যবহার, প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ও অন্তর্নিহিত ক্ষমতা এবং গুণাগুণ অনুযায়ী কৃষি, মৎস্য, পশু-সম্পদ, বন, চিংড়ি চাষ, শিল্পাঞ্চল, পর্যটন, প্রত্নতাত্বিক এলাকা এবং প্রাকৃতিক জীব-বৈচিত্র্য এলাকার ক্ষেত্রে ভূমির পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সারা দেশে পর্যায়ক্রমে ভূমি জোনিংয়ের ব্যবস্থা করবে।
ভূমি জোনিং সরকারের একটি ‘পরিকল্পনা হাতিয়ার’ হিসাবে বিবেচনা করা হবে- যার মাধ্যমে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ভূমির বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহারভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহায়তা নেওয়া হবে।
কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ; আবাসন; নদী, সেচ ও নিষ্কাশন নালা, পুকুর, জলমহাল ও মৎস্য এলাকা; বনাঞ্চল; সড়ক ও জনপথ এবং রেলপথ; হাটবাজার, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা; চা, রাবার ও হর্টিকালচার এলাকা; উপকূলীয় অঞ্চল; পর্যটন এলাকা; চরাঞ্চল ও পরিবেশগতভাবে বিপন্ন এলাকা এবং অন্যান্য ভূমির জোনিং করা হবে।
বিভাগীয় শহর, জেলা শহর এবং উপজেলা শহরে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস অবকাঠামো ঊর্ধ্বমুখী নির্মাণ করতে হবে।
ভূমি অধিগ্রহণ
অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তঃমন্ত্রণালয় যোগাযোগ এবং সমন্বয়ের বিধান অনুসরণ করা হবে। নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণ করার আগে অধিগ্রহণকৃত জমি পূর্ণ ব্যবহার না করে অধিগ্রহণ করা যাবে না।
ভূমি জোনিং মানচিত্র
সব পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়নে ভূমির ব্যবহার ও গুণাগুণভিত্তিক এলাকা চিহ্নিত করে ভূমি জোনিং মানচিত্র প্রস্তুত করতে হবে। অধিক ঘনবসতিপূর্ণ এবং পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার মানচিত্র অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে প্রস্তুত করার কথা বলা আছে।
দেশের সব জমির জন্য ভূমি জোনিং করতে হবে। ভূমি জোনিং মানচিত্র মৌজা বা ইউনিয়ন, ওয়ার্ডভিত্তিক করতে হবে। ভূমির বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সম্পর্কিত তথ্য ভূমি জোনিং মানচিত্রে উল্লেখ থাকবে।
সকল ভূমি জোনিং মানচিত্র রঙিনভাবে মুদ্রিত হবে এবং তা প্রতিবেদনসহ ওয়েবসাইটে উম্মুক্ত রাখা হবে।
ভূমি জোনিং মানচিত্রের পরিমার্জন
ভূমি জোনিং মানচিত্র জাতীয় প্রয়োজনে বড় ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন; প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা নদীপথের গতি পরিবর্তন বা সীমানা নির্ধারণজনিত কারণে যৌক্তিক বিবেচিত হলে, ভূমি জোনিং মানচিত্রে প্রকৃত ভুল ধরা পড়লে মানচিত্রের পরিবর্তন করা যাবে।
ভূমি জোনিং বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণে জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা এবং পৌরসভায় কমিটি থাকবে।
অপরাধ, বিচার ও দণ্ড
আইনের বিধান কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অমান্য করলে অনুর্ধ্ব পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বনিম্ন এক লাখ টাকা হতে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আইনের অধীনে অপরাধ আমলযোগ্য, জামিন অযোগ্য ও আপোষযোগ্য হবে এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা সংশ্লিষ্ট যে কোন বিভাগের কর্মকর্তা মামলা দায়ের করতে পারবেন। মামলাকারী অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলে তাকে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে।
এই আইনের অধীনে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচার হবে, তবে জরুরি প্রয়োজনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে পারবেন। এ বিষয়ে কোন অভিযোগ থাকলে জনসাধারণ সরাসরি অভিযোগ বা মামলা দায়ের করতে পারবেন।
আইন জারির পর ভূমি ব্যবহার, কৃষিজমি সুরক্ষা এবং ভূমি জোনিং সংক্রান্ত ইতোপূর্বে আইন, বিধিমালা, প্রজ্ঞাপনের কার্যকারিতা আর থাকবে না।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।