সকল মেনু

নাম বদলে ফেলেন চাঁদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়ূব শেখ

indexশাহ মোহাম্মদ মাকসুদুল আলম, চাঁদপুর: মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা জীবন বাজি রেখেছেন, ছেড়েছেন ঘর-সংসার, মা-বাবা ও ভাই-বোনের স্নেহ-ভালোবাসা। দেশকে ভালোবেসে স্বাধীন করতে আর মাতৃভাষাকে নিজের করে নিতে পিছ পা হননি সেদিন। তাঁরা কেউ শহীদ হয়েছেন রণাঙ্গনে আর কেউ কেউ বেঁচে আছেন-তাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাঁরা এদেশের সূর্য সন্তান। লাল-সবুজের অংশিদার। যাঁরা পাকিস্তানী শোষন-নিস্পেষণের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়ে নিজের নাম পর্যন্ত বদলে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করেন নি; এমনই এক মুক্তিযোদ্ধা আয়ূব আলী শেখ। তিনি ১৯৩৯ সালের ৩ এপ্রিল চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার শেখ বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার বাবার রাম মোঃ দেওয়ান আলী শেখ ও মা সরুফা খাতুনের দুই ছেলে, তিন মেয়ের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ।
১৯৫৪ সালে তৎসময়ের ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পরের বছরেই সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে যোগদান করেন আয়ূব আলী শেখ। সৈনিক জীবনের ১৫ বছর পার না হতেই বেজে উঠল মুক্তিযুদ্ধের দামামা। শুরু হলো পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা কামীদের বিরোধ। ’৭১-এর মার্চ মাসে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানী তথা বাঙালি নিধনের গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষনের পর উত্তাল হয়ে উঠে গোটা বাংলা, জেগে উঠে বৃদ্ধ, যুবা, আবাল-বণিতার রক্ত। স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির লক্ষ্যে। সেনাবাহিনীর হাবিলদার মেজর আয়ুব আলী শেখ সে সময় করাচী অবস্থান করছিলেন। নানান ঘাত-প্রতিঘাত, বাঙালিদের উপর খান সেনাদের জুলুম, ব্যক্তিগত জীবনে পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টে দু’-দু’বার শারীরিকভাবে নিগৃহীত আয়ুব আলী শেখ দেশের টানে, স্বাধীনতার ডাকে কর্মস্থল থেকে পালিয়ে আসেন পূর্ব পাকিস্তানে। সৈনিক জীবনের লব্দ অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশ মাতৃকাকে শত্রু মুক্ত করার প্রত্যয়ে অস্ত্র হাতে ছুঁটে যান রণাঙ্গনে। চাঁদপুরের মতলবের তৎকালীন গণ-পরিষদ সদস্য ফ্লাইট ল্যাঃ এ.বি সিদ্দিকী ফরিদগঞ্জের অলি উল্যাহ্ নওজোয়ান, হাজীগঞ্জের ডাঃ আবদুস সাত্তারসহ আরো অনেকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা আয়ুব আলী শেখকে হাজীগঞ্জে একটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প গঠন করার নির্দেশ দেন। তাঁদের নির্দেশ ও সহযোগিতায় ৫৫ জন প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে আয়ূব আলীর নেতৃত্বে গড়ে উঠে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আয়ূব আলী শেখ জানান, ওই ক্যাম্পে সৈনিক হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন বর্তমান সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রম, সাবেক আইনমন্ত্রী আঃ মতিন খসরু, অ্যাডঃ কাজী জাফর মঈনুদ্দিন (অ্যাডঃ নুরজাহান বেগম মুক্তা এমপি’র বাবা), শাহরাস্তির হাবিলদার মনির হোসেন, বাবুরহাটের চেয়ারম্যান আঃ মান্নান মাল, হাজীগঞ্জের কমান্ডার আবু তাহেরসহ আরো অনেকে। বার্ধক্যজণিত কারণে স্মৃতি হতে মুছে গেছে আরো অনেকের নাম।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন দিদারুল আলমের নেতৃত্বে তিনি যুদ্ধে যোগদানের পর তার নির্দেশে কুমিল্লার বুড়িচং, রাজাপুরা রেল স্টেশন, ফকিরা বাজার, জঙ্গল বাড়িসহ বহুস্থানে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন। তৎসময়ের সহযোদ্ধাদের নাম জানতে  চাইলে তিনি জানান, বর্তমান চাঁদপুর জেলা কমান্ডার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এম.এ ওয়াদুদ, সার্জেন্ট আবিদ আলী, সিপাহী ফজলুল হক, আবদুল জাব্বার, আবদুল মালেকসহ আরও অনেকের নাম। তিনি আরোও জানান, পাকিস্তানীদের সীমাহীন শোষন, নিপীড়ন-নির্যাতনসহ অধিকতর শাসনাধিকার প্রয়োগ করার কারণে জেনারেল আইয়ুব খানের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণার কারণে নিজ নাম আইয়ূব আলী শেখকে পাল্টে আয়ুব আলী শেখ লেখা শুরু করেন।
তিনি ১৯৬০ সালে ফিরোজা আক্তারকে বিয়ে করে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। দীর্ঘ জীবনে তাঁদের সংসারে এসেছে দু’ ছেলে দু’ মেয়ে। যাদের একজন চাঁদপুরের বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডঃ জাহাঙ্গীর আলম। যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলায় আবারো তিনি যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৮৫ সালে  সিনিয়র ওয়্যারেন্ট অফিসার হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলী। সহ-ধর্মিণী পরবাসে চলে যওয়ার পর নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করছেন তিনি। বয়স, অসহায়ত্ব, অতীত স্মৃতি ও বতর্মান দেশের প্রেক্ষাপট সব মিলে হতাশা, ব্যঞ্জনা আর ক্ষোভ নিয়ে কাটছে তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত। আমার জীবনটা যেভাবে গেছে, তাতে  আন্দোলন-সংগ্রাম, যুদ্ধ, বিজয়, আনন্দ-বেদনা, মিশ্রিত ছিলো। শেষ বেলায় এসে মুহ্যমিত জীবনের শ্রোতধারায় শরিক হচ্ছেনা ক্ষমতাসীনরা। মনে হয় আজ আমি খুব অবহেলিত। অর্থ চাইনা, খাদ্য-পথ্য চাইনা-দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ পাগল লোকটির পাশে কেউ আসুক, খোঁজ-খবর রাখুক-এমন দাবি কিংবা আবদার করাটি কি অধিক চাওয়া? দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সাধারণ জণগণের শিক্ষা, বাসস্থান, খাদ্য, ঔষধসহ নিরাপদ জীবন-যাপনের সার্বিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করলেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার শান্তি আর জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা অক্ষুন্ন থাকবে, এমন আশাবাদ আয়ূব আলী শেখের।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top