সকল মেনু

সৈয়দপুরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ অর্থাভাবে থমকে গেছে

indexমো. আমিরুজ্জামান, নীলফামারী  ০৬ ডিসেম্বর: মহান মুক্তিযুদ্ধের ৪৪ বছরেও আজও নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে একাত্তরের স্মৃতিস্তম্ভ ও গোলাহাট বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ হয়নি। একাধিকবার এসব নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হলেও অর্থ, স্থান সঙ্কট ও সংশি¬ষ্টদের সমন্বয়হীনতার কারণে কাল ক্ষেপনের পর অবশেষে গেল বছর দুটার কাজ শুরু হলেও অর্থাভাবে এখনও শেষ হয়নি।  ফলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের বর্বরতা ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্মারক চিহৃগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে। বর্তমানে এসব হত্যাস্থান দেখিয়ে বা বলে না দিলে নতুন কোন লোক জানতেই পারেন না যে, এই জায়গাটিতে মাতৃভূমির জন্য প্রাণ দিয়েছেন একসাথে শত শত লোক।
উত্তরাঞ্চলের অবাঙ্গালি (উর্দুভাষী) অধ্যুষিত সৈয়দপুর শহরে ৭১’এর মহান মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যপট ছিল দেশের অন্যান্য শহরের তুলনায় একেবারে ভিন্ন। সেই ৪৭’এর দেশ বিভাগের পর থেকে এই সৈয়দপুর শহরে বিপুল সংখ্যক অবাঙ্গালি এসে আস্তানা গড়ে। মুক্তিযুদ্ধে অবাঙ্গালিদের সংগঠিত করতে সেসময় নেতৃত্ব দেন তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শহীদ ডা. জিকরুল হকসহ আরও অনেকে। পাক হানাদার বাহিনী বাঙ্গালিদের আটকিয়ে রেখে বিমানবন্দরে মাটি কাটার কাজে লাগিয়ে দেয় এবং বাঙ্গালিদের উপর চরম জুলুম, নির্যাতন চালানো হয়।
এসময় শহরের বাঙ্গালিরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সেদিন সৈয়দপুর শহরের পার্শ্ববর্তী চিরিরবন্দর থানার আলোকডিহি ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহতাব বেগ তার একমাত্র বন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বাঙ্গালিদের উদ্ধারে। কিন্ত শহরে ঢোকার প্রাক্কালে হানাদার বাহিনী মিস্ত্রিপাড়া এলাকায় তাকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। তিনিই মূলতঃ এই অঞ্চলের প্রথম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাসে এখানে পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসররা নির্মমভাবে হত্যা করে বিভিন্ন পেশার ও বয়সের মানুষকে। স্বাধীনতাকামী ঠিক কতজন মানুষ সৈয়দপুরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তার সঠিক হিসাব না থাকলেও বিভিন্ন সূত্রমতে এ সংখ্যা সহস্রাধিক। শুধুমাত্র ’৭১ এর ২৩ মার্চ একদিনেই পাক বাহিনী হিন্দু ও মাড়োয়ারী পরিবারের ৩শ’ ৫০জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এসব মানুষকে ভারতে পৌছে দেয়ার কথা বলে সৈয়দপুর রেলওয়ে ষ্টেশনে একটি বিশেষ ট্রেনে তুলে শহরের অদূরে গোলাহাট এলাকায় নিয়ে যায়। এরপর ট্রেনের দরজা জানালা বন্ধ করে দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সদস্যরা। ট্রেনের বগিতে আটকা থাকা অবস্থায় এক এক করে নারী, পুরুষ ও শিশুদের বের করে নাঙ্গা তলোয়ার ও বেয়নট দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে হত্যা করা হয়। সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুও এদিন তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।
নির্মম হত্যাযজ্ঞ থেকে ট্রেনের বগির জানালা ভেঙ্গে পালিয়ে রক্ষা পেয়েছিলেন মাত্র তিনজন। ইতোধ্যে তাদের দুইজন স্বর্গীয় হয়েছেন। বর্তমানে একমাত্র বেঁচে আছেন কালঠু দাস। সেইদিনের স্মৃতি মনে করতে গিয়ে আঁতকে উঠেন তিনি। ওই হত্যাযজ্ঞের নির্মমতা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে বিজয়ের একদিন পরও তথা ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত অবাঙালীরা শহরের আটকাপড়া বাঙালীদের নিধন করে। সারাদেশে বিজয়ের পতাকা ১৬ ডিসেম্বর উড়লেও সৈয়দপুরে বিজয়ের পতাকা উড়ে ১৮ ডিসেম্বর। এদিনও হানাদারদের দোসর অবাঙালী রাজাকারদের গ্রেনেড হামলায় নিহত হন স্বাধীনতাকামী ডা. মোবারক আলী। সৈয়দপুর শক্রমুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। সবমিলে সৈয়দপুর শহরে প্রায় দুই হাজার বাঙালীকে হত্যা করে পাকিস্তানি দোসর অবাঙালীরা।
বর্তমান সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর গত বছর ১৩ জুন গোলাহাট বদ্ধভূমিতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। স্মৃতিসৌধের পাশে মন্দির, পার্ক, পুকুর, রেস্ট হাউস নির্মাণেরও সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য ব্যয় ধরা হয় এক কোটি টাকা। কিন্ত সাধের ঘরে সাধ্যের বাতি নিভে যেতে বসেছে। নীলফামারী-৪ আসনের সংদ সদস্য ও বিরোধী দলীয় হুইপ আলহাজ্ব শওকত চৌধুরী ব্যক্তিগত অর্থ ও তার বরাদ্দকৃত চাল ও গমে প্রায় ৯ লাখ টাকা খরচ করার পর সরকারের আর্থিক সহায়তা না মেলায় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ আটকা পড়ে গেছে।
অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট সড়কের ডাকবাংলোর বিপরীতে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ফলক গেল বছর উম্মোচন করা হয় ঘটা করে। পরবর্তীতে সেখানেও কিছুদিনের মধ্যে ভিত্তি স্থাপনের সাইনবোর্ড চুরি যায়। স্থানীয় এমপি আলহাজ্ব শওকত চৌধুরীর আর্থিক সহযোগিতা ও পূবের্র সংগৃহিত অর্থে মাটি ভরাট ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু হলেও বর্তমানে স্মৃতিসাতম্ভটি হাফ ডাউন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আর এ কারণে বার বার থেমে যাচ্ছে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ।
এদিকে স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত না হলেও প্রজম্ম-৭১ ছোট্ট পরিসরে জিআরপি মোড়ে স্মৃতি স্থান নির্মাণ করেছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ শিশুপার্কে নিজস্ব অর্থায়নে শহীদ স্মৃতি ফলক ও রেলওয়ে কারখানায় অভ্যন্তরে স্মৃতিস্তম্ভ  নির্মাণ করে প্রশংসিত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top