নিজস্ব বার্তা পরিবেশক, চাঁদপুর: পাওনা টাকা নিয়ে বিরোধের জের হিসেবে চাঁদপুর শহরে এক মহিলা অপর আরেক মহিলাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে খুন করেছে। যিনি খুন হয়েছেন তিনি ৩ ছেলের মা আর যে খুন করেছে সে দুই মেয়ের মা। খুনি শুধু কুপিয়েই ক্ষান্ত হয়নি মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য গলাও কেটেছে। ঠান্ডা মাথায় খুন করে বাসা থেকে বের হয়ে খুনি নয়ন বেগম প্রথমে শহরের তালতলা এলাকায় তার বড় বোনের বাসায় আশ্রয় নিতে যায়। বোন আশ্রয় না দিলে সেখান থেকে সে অন্যত্র পাড়ি দেয়। আর এই লোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটেছে ২২ আগস্ট দিবাগত রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে চাঁদপুর শহরের রহমতপুর আবাসিক এলাকাস্থ ভূঁইয়া বাড়িতে। খুনী নয়ন বেগমকে এখনো পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে নি। নয়নের দুই মেয়ে সোমবার চাঁদপুরের একজন বিচার বিভাগীয় ম্যজিষ্ট্রেটের কাছে ওই হত্যাকান্ডের বিষয়ে তার মা’র জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
চাঁদপুর শহরের রহমতপুর আবাসিক এলাকার ৯০ নম্বর বাসায় কুহিনুর বেগম (৪৬) স্বামী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন। তার স্বামী আবদুল মান্নান সৌদি প্রবাসী। ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১৫ আগস্ট তিনি দেশে আসেন। কুহিনুর বেগমের তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে রিপন কাতার প্রবাসী, মেঝো ছেলে শিপন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ পড়ছে, আর ছোট ছেলে তানজিল চাঁদপুর আল-আমিন একাডেমী স্কুল এন্ড কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র। কুহিনুর বেগমের বাসার অবস্থান হচ্ছে রহমতপুর আবাসিক এলাকা জামে মসজিদের সামনে। এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, খুনি নয়ন বেগম স্বামী পরিত্যক্তা। তার প্রথম স্বামী ইসহাকের সাথে অনেক আগে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। স্বামী থাকা অবস্থায় নয়ন পরকীয়াসহ নানা অপকর্মে জড়িত হয়ে যাওয়ায় মূলত স্বামীর সাথে তার তালাক হয়ে যায়। এরপর শাহরাস্তির সূচীপাড়া এলাকার ব্রিকফিল্ডের মালিক জনৈক আলমগীর হোসেন ফারুক তার কথিত স্বামী হিসেবে ছিলো। এছাড়া অনেক পুরুষের সাথেও তার অবৈধ সম্পর্ক ছিলো। নয়ন বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা এনে সুদের ব্যবসা করতো বলে জানা গেছে। তেমনি কুহিনুর বেগমের কাছ থেকেও সে টাকা আনে। এই টাকা আনতে গিয়েই কুহিনুর নয়নের হাতে খুন হন। তবে কতো টাকা নয়নের কাছে কুহিনুর বেগম পাওনা ছিলেন তা সঠিক জানা যায়নি।
সরজমিন কুহিনুর বেগমের বাসার এলাকায় গিয়ে দেখা যায় অনেক মানুষের ভিড়। অনেক মানুষ আসছে আর হায় আফসোস করছে এমন নৃশংস খুনের ঘটনায়। সবাই হতবাক। নিহত কুহিনুর বেগম মহিলা আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলো। এছাড়া তিনি নানা সামাজিক কাজসহ মানুষের বিপদ-আপদে এগিয়ে যেতেন। এ জন্যে সকলের সাথে তার বেশ সুসম্পর্ক ছিলো। কুহিনুর বেগমের স্বামী আঃ মান্নানকে দেখা গেছে মসজিদের সাথে আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, তার দু চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। তিনি যেনো হতবিহবল। কথা হয় মসজিদে থাকা কুহিনুর বেগমের মেঝো ছেলে শিপনের সাথে। তিনি খবর পেয়ে ঢাকা থেকে এসেছেন। কী কারণে তার মা খুন হতে পারেন জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন, আমি শুনেছি ওই মহিলা (খুনি নয়ন) আমার মাকে ফোন করে তার বাসায় নিয়েছে। আমার মার গলায়, কানে, নাকে ও হাতে সোনার জিনিস পরা ছিলো। আমার বড় ভাই বিদেশ থেকে জিনিসগুলো পাঠিয়েছেন বিধায় মা সবসময় এগুলো পরে থাকতেন। এই সোনার জিনিসের জন্যই হয়তো খুনি আমার মাকে খুন করেছে। এদিকে এলাকাবাসী জানায়, নয়ন বেগম বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা এনে সুদের ব্যবসা করতো। তেমনি কুহিনুর বেগমের কাছ থেকেও সে টাকা নেয়। আর সে টাকা আনতে গিয়েই তিনি খুন হন।
নয়ন বেগম খুন করে তার দুই মেয়ে তিশা ও তন্বীকে বাসায় রেখেই পালিয়ে যায়। বড় মেয়ে তিশা চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী আর ছোট মেয়ে তন্বী পৌর শহীদ জাবেদ স্কুলের ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী। পুলিশ এই দু জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে থানায় নিয়ে আসে। তাদের কাছ থেকেও জানা গেছে, তাদের মা-ই খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। বড় মেয়ে তিশা জানায়, যখন এ ঘটনা ঘটে তখন তারা পাশের ফ্ল্যাটে পড়ছিলো। আর মুখোমুখি যে ফ্ল্যাটে খুনের ঘটনা ঘটে তখন ওই ফ্ল্যাটের টিভির ভলিয়ম অনেক জোরে বাড়িয়ে দেয়া হয়। এক পর্যায়ে তারা কয়েকটি চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পায়। তখন তারা ঘর থেকে বের হয়ে ওই ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে বললে তার মা তাদেরকে ধমক দিয়ে পড়তে যেতে বলে। এরপর আর কোনো সাড়া শব্দ পায়নি তারা। কিছুক্ষণ পর তারা ঘর থেকে বের হয়ে ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখে রক্তাক্ত অবস্থায় কুহিনুর বেগম ফ্লোরে পড়ে আছে। তখন তারা চিৎকার দিলে আশপাশের মানুষ এসে খুনের ঘটনা দেখতে পায়। তারপর মডেল থানায় খবর দিলে থানার অফিসার ইনচার্জ এ এইচ এনায়েত উদ্দিন পিপিএম ঘটনাস্থলে যান। তারা ওই ঘরের ভেতরে ঢুকে কুহিনুর বেগমের লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেন। সাথে একটি বটি দা ছিলো, যেটি দিয়ে ঘাতক কুহিনুরকে কুপিয়েছে। লাশের সুরতহাল রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, কুহিনুর বেগমের মাথার সামনে, পেছনে, হাতে ও গলায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। লাশের ময়না তদন্ত করে রোববার বিকেলে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হলে কুহিনুর বেগমের স্বামীর বাড়ি ফরিদগঞ্জের শোল্লায় তাকে দাফন করা হয়। আর এ ঘটনায় কুহিনুর বেগমের বড় ভাই আঃ মালেক বাদী হয়ে খুনি নয়ন বেগমকে প্রধান আসামি করে ছয় জনের বিরুদ্ধে মডেল থানায় মামলা (নং-৪১) দায়ের করেন।
এ দিকে খুনের ঘটনা ঘটিয়ে নয়ন শহরের তালতলাস্থ আঃ করিম পাটওয়ারী বাড়িতে তার বড় বোন মিজান পাটওয়ারীর স্ত্রী নাজমা বেগমের বাসায় যায় আশ্রয়ের জন্যে। কিন্তু সেখানে আশ্রয় না পেয়ে সে সেখান থেকে অন্যত্র চলে যায়। পুলিশ মিজান পাটওয়ারীর স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে থানায় নিয়ে আসে। এছাড়া খুনি নয়ন বেগমের ভাড়াটিয়া মোহামেডান ক্লাবের নৈশ প্রহরী আরিফ মিজিকেও পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।