সকল মেনু

স্বজনেরা ঈদের দিনেও দেখতে আসেনি

bs31437329377গাজীপুর প্রতিনিধি : ঈদে পেয়েছেন নতুন কাপড়, ভালো খাবার। কিন্তু বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের অধিকাংশ বাসিন্দা তাদের আত্মীয়-স্বজন বা প্রিয় মানুষটির দেখা পাননি।

অধীর আগ্রহে প্রহর গুনেছেন কেউ হয়তো দেখা করতে আসবেন। ঈদের পরের দিনও অনেকের আশা ছিল, স্বজনেরা আসবেন। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। দেখা না পেয়ে তারা মনকে সান্ত্বনা দিয়েছেন- বৃষ্টির কারণে হয়তো স্বজনেরা আসতে পারেননি। আশায় আছেন- পরে আসবে।

মহিলা নিবাসী

নিবাসীদের অনেককে আবার তার স্বজনেরা বাড়ি নিয়ে গেছেন ঈদ উদযাপন করতে।

ঈদের পরদিন রোববার গাজীপুর সদর উপজেলার মনিপুরে বিশিয়া কুড়িবাড়ী এলাকায় বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের নিবাসীদের সঙ্গে আলাপ করে এমন কথা জানা গেছে। কথা বলার সময় আপনজনের কথা স্মরণ করে অনেকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। অনেকে আবার ক্ষোভে-দুঃখে স্বজনদের নাম বলতে চাননি।

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রিফাইতপুর গ্রামের মৃত সুলতান আহমেদ খানের ছেলে জিয়ার রহমান (৬১)। একসময় তিনি ব্যবসা করে সংসার চালাতেন। তখন তিনি ভালোই চলতেন। তিনি জানান, তার দুই সংসারে তিন মেয়ে, এক ছেলে। প্রথম পক্ষে দুই মেয়ে এবং দ্বিতীয় পক্ষে এক ছেলে, এক মেয়ে। প্রথম স্ত্রী ২০১৩ সালে মারা গেছেন। ওই পক্ষের প্রথম মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। দ্বিতীয় মেয়ে সরকারি চাকরি করে। আর দ্বিতীয় স্ত্রী তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঢাকার নাখালপাড়ায় থাকেন। এখন কাজ করতে পারেন না, তাই তার খোঁজ কেউ নেয় না। তার এক বন্ধুর মাধ্যমে ২০ দিন আগে তিনি এ কেন্দ্রে আসেন।

তিনি জানান, ঈদের দিন কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষ নতুন পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি দিয়েছে। সকালে সেমাই-মুড়ি, খিচুড়ি, দুপুরে ও রাতে পোলাও, গরুর মাংস দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের খাবার, নতুন কাপড় পেয়ে তিনি খুবই খুশি। এর জন্য তিনি কেন্দ্রের মালিকের প্রতি শুকরিয়া আদায় করেন।

মনোয়ারা বেগম

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ‘আশা করেছিলাম ঈদে হয়তো ছেলেমেয়েরা কেউ আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আসেনি। এটাই শুধু আক্ষেপ।’

পাঁচ মাস আগে ওই কেন্দ্রে আসেন আলী হোসেন (৭২)। তিনি ঢাকার দোহার উপজেলার সুতারপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তার তিন মেয়ে এবং এক ছেলে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে রবিউল তাকে এই কেন্দ্র দিয়ে গেছে। তিনি চট্টগ্রামে কর্ণফুলী পেপার মিলে ওয়াল্ডার মিস্ত্রি হিসেবে প্রায় ২০ বছর চাকরি করেছেন। সেখান থেকে চাকরি করতে ওমান যান। চার বছর সেখানে কাজ করেন। এ সময় উপার্জিত অর্থ স্ত্রীর কাছে পাঠাতেন। ওই স্ত্রী টাকাপয়সা নিয়ে অন্য এক লোকের সঙ্গে চলে গেছেন। এতে তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। এখন ছেলে তার ভরণপোষণ দেয় না। খোঁজখবরও নেয় না।

ময়না বিবি

প্রায় এক বছর এ কেন্দ্রে আছেন শয়ীরতপুরের আবদুল কাদেরের স্ত্রী ময়না বিবি (৯০) (তিনি পুরো ঠিকানা বলতে পারেননি)। স্বামী মারা গেছেন প্রায় ২০ বছর আগে। তার তিন ছেলে এবং দুই মেয়ে আছে। বড় ছেলে আবদুল কুদ্দুস সৌদিপ্রবাসী। অপর দুই ছেলে তোতা মিয়া এবং দুলাল পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। কোনো ছেলেই তার ভরণপোষণ করতে চায় না। তাই তিনি একা একা এখানে এসেছেন। মাঝেমধ্যে ছেলেমেয়েরা দেখা করতে আসে।

ঈদে কেউ দেখা করতে এসেছিল কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজ রোববার আসার কথা ছিল। বৃষ্টি না থাকলে হয়তো আসত।

৯০ বছরের এই বৃদ্ধা বলেন, ছেলেমেয়েদের জন্য মন কাঁদে। তিনি সব রোজা রেখেছেন। রোজা রেখে নামাজ শেষে ছেলেমেয়ে এবং এই কেন্দ্রের মালিকের জন্য দোয়া করেছেন।

তিনি জানান, এই কেন্দ্রের একটি রুমে তারা ১০ জন থাকেন। এরাই এখন তার আত্মীয়। এখানে থাকতে ভালো লাগে।

চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ এলাকার আবদুল মান্নান মাস্টারের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম (৭০)। তিনি প্রায় ১১ বছর এ কেন্দ্রের নিবাসী। তিনি জানান, প্রায় ২০ বছর আগে স্বামী মারা গেছেন। তার কোনো সন্তান নেই। তারা এক ভাই, এক বোন। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি ভাই আবদুল আজিজের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটী থাকতেন। ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি স্বামীর বাড়ি সন্দ্বীপ চলে যান। সেখানে এক মাস অবস্থান করলেও স্বামীর স্বজনেরা তার খোঁজখবর নিতেন না। পরে তিনি ময়মনসিংহের তাড়াইল উপজেলার শিমুলহাটি গ্রামে বাপের বাড়িতে চলে আসেন। এখানেও কেউ তার ভরণপোষণ করত না। উপায় না পেয়ে অন্য এক লোকের মাধ্যমে এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসেন।

আলী হোসেন

তিনি জানান, এ পর্যন্ত কেউ তার খোঁজখবর নেয়নি। কেউ খোঁজ নেবেন, এখন তিনি এমন আশাও করেন না।

বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রটি স্থাপন করেছেন গিভেন্সি গ্রুপের চেয়ারম্যান খতিব আবদুল জাহিদ মুকুল। এখানে রয়েছে পুরুষ এবং নারীদের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা।

বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. আবু শরিফ জানান, এই কেন্দ্রে বর্তমানে ১৯৩ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন। এদের মধ্যে ৮৯ জন পুরুষ এবং ১০৪ নারী। এবারের ঈদে ৩০ জন পুরুষ এবং ৩০ নারী ১০ দিনের ছুটিতে রয়েছেন। ঈদ উদযাপন করতে তাদের স্বজনেরা নিয়ে গেছেন। কেন্দ্রের মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে।

জিয়ার রহমান

তিনি জানান, ঈদে পুরুষদের পাঞ্জাবি, ফতুয়া, লুঙ্গি এবং নারীদের শাড়ি,  ব্লাউজ ও পেটিকোট দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো জানান, এ কেন্দ্রের নিবাসীদের দেখাশোনার জন্য ৫৩ জন স্টাফ রয়েছেন। চারজন চিকিৎসক এবং একজন নার্স রয়েছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top