জিল্লুর রহমান পলাশ: অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশুনার সময় শখের বসে লেখালেখি শুরু করি। আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি জেলা শহর থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক গণউত্তরণ’ পত্রিকা। ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত স্থানীয়, অঞ্চলিক ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত বেশ কিছু কাগজে উপজেলা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছি। কাজের ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে দৈনিক যায়যায়দিনে সংবাদ পাঠানো শুরু করি। সেই সময়ে নিজের মেধা, ইচ্ছে ও চেষ্টায় প্রতিদিন যা লিখেছি তাই পত্রিকার পাতায় প্রকাশ হয়েছে।
আমার পাঠানো প্রতিদিনের চলমান সংবাদ ছাড়াও সমস্যা, সম্ভাবনা-উন্নয়ন ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো বেশ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ হত। নিয়োগ নেই, আইডি কার্ড নেই এমনকি অফিসের সঙ্গে তেমন কোন যোগাযোগও নেই। তবুও টানা পাঁচ বছর কখনো কম্পিউটার, কখনো হাতে লিখে ফ্যাক্স বা কুরিয়ার যোগে যায়যায়দিন অফিসে সংবাদ পাঠিয়েছি।
২০১১ সালের জানুয়ারীতে অফিস থেকে সিভি নিয়ে আমাকে ডাকা হয়। অফিসে গিয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে চলে আসি। এর কিছুদিন পর এক হাজার টাকা সম্মানি উল্লেখ করে ছয় মাসের জন্য অস্থায়ী নিয়োগ পত্র হাতে পাই। নিয়োগ পত্র হাতে পেয়ে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। কারণ উপজেলা শহরে হাতে গোনা দুই-তিন জন সংবাদকর্মী ছাড়া জাতীয় দৈনিকে বেতনভূক্ত কোন সংবাদকর্মী ছিলেন না। তাছাড়া বলতে গেলে শুধু উপজেলা নয় জেলার মধ্যে আমি সবচাইতে অল্প বয়সের একজন সংবাদকর্মী। তাও আবার সাংবাদিকতা জগতে একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় পত্রিকার বেতনভুক্ত সংবাদকর্মী। এরপর থেকে আমাকে আর পিছু ফিরতে হয়নি।
২০১১ সালের জুন মাসের পর থেকে সবসময় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল অনলাইন সাংবাদিকতা জন্য। অনলাইনে উপজেলা সংবাদদাতা হিসেবে নয়। আমার স্বপ্ন ছিল আমি অনলাইনে জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করব। সব সময় স্বপ্ন দেখতাম দ্রুত গতির অনলাইন নিউজ পোর্টালে কাজ করার। তখন আমি প্রতিদিন অনেকগুলো অনলাইন নিউজ পোর্টাল পড়তাম এবং চার-পাঁচটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে জেলার সংবাদ পাঠাতাম।
২০১৩ সালের জানুয়ারীতে ছোট ভাই এসটি শাহীন জানায় দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমে গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি নিবে। তখন সবে মাত্র দ্য রিপোর্ট যাত্রা শুরু করেছে। আমি সিভি পঠানোর কয়েকদিন পরেই নিয়োগ পত্র হাতে পেয়ে শুরু করি অনলাইনে জেলা সাংবাদিকতা। শুরু থেকেই খাওয়া ও ঘুম হারাম করে ছুটে চলি সংবাদের পিছনে। প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য বিকেল বা সন্ধ্যার মধ্যে সংবাদ অফিসে পাঠালে চলে কিন্তু অনলাইনে বিকেল-সন্ধ্যা নির্ভর নয়। অনলাইন হলো ২৪ ঘণ্টার জন্য।
রাত-দিন সব সময় সর্তক ও নিউজ তৈরীতে প্রস্তুত ছিলাম। কারণ কখন কোথায় কি ঘটল। কিছু মিস করলাম নাকি। নিউজটি যেন সবার আগে অফিসে পাঠাতে পারি। আমার সংবাদটি যেন আগে আপলোড হয়। অফিসে পাঠানো নিউজে কিছু ভূল করেছি কি না। অফিস থেকে কখন কে ফোন করে এ ধরণের অনেক চিন্তা-চাপের মধ্যে থাকতে হয়। তবুও অবিরাম গতিতে কাজ করে চলছিল।
জুন মাসে ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় গেলাম। সুযোগ করে একবার যায়যায়দিন অফিসে যাই। অফিসে বর্তমান মফস্বল সম্পাদক শামীম হোসেন ভাইয়ের সঙ্গে কথা হল। তিনি আমাকে জানালেন জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম বাবু ভাই আর যায়যায়দিনে কাজ করবেন না। বিষয়টা শুনে খুব বিস্মত ও দু:খ পেলাম। (আরিফুল ইসলাম বাবু ভাইয়ের প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ)।
এরপর শামীম ভাইয়ের কথা মতো জেলার ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো অফিসে পাঠানো শুরু করলাম। আমার পাঠানো জেলার সংবাদগুলো সাদুল্যাপুর (গাইবান্ধা) সংবাদদাতা হিসেবে প্রকাশ হত। ২০১৪ সালের জুলাই-আগষ্টে যায়যায়দিনে বিভিন্ন জেলায় নতুন করে প্রতিনিধি নিয়োগ দেওয়া হয়। আমাকেও উপজেলা থেকে পদোন্নতি দিয়ে জেলা প্রতিনিধির দায়িত্ব দিলেন সম্পাদক, প্রকাশক মহোদয়। নিয়োগ আইডি কার্ড হাতে পেয়ে কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দিলাম।
যায়যায়দিন ও দ্য রিপোর্টে জেলা প্রতিনিধি হয়ে কাজের সুযোগ পাওয়ায় সম্পাদক, প্রকাশক ও অফিসের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ। এছাড়া জেলা পর্যায়ের অনেক সহকর্মীর সহযোগিতা পেয়েছি। আমি তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ। যায়যায়দিন ও দ্য রিপোর্টে কাজ করে আমার সাংবাদিকতার অনেক পরিবর্তন, লেখার ধরণ, সংবাদ সংগ্রহে কৌশল জানতে পেরেছি। এছাড়া প্রতিদিন নতুন নতুন অভিজ্ঞতা থেকে গুছিয়ে একটি স্বয়ংসম্পর্ণ নিউজ লেখা শিখতে পেরেছি।
এরপর দায়িত্ববোধ থেকে সবার আগে সঠিক ও নিভূল সংবাদ যায়যায়দিন ও দ্য রিপোর্টে পাঠাচ্ছি। গত এক বছরে দ্য রিপোর্টে কাজ করে বর্ষসেরা প্রতিনিধির মধ্যে দ্বিতীয়স্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। পাশাপাশি যায়যায়দিন ও দ্য রিপোর্টে কাজ করে দেড় বছরে জেলা সদরসহ ছয় উপজেলার সাংবাদিক, বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সাধারণ জনগন আমাকে চেনেন ও জানেন।
জেলার অনেক সংবাদকর্মী আমার লেখা সংবাদগুলো ‘কপি টু পেষ্ট’ করে তাদের অনলাইন পোর্টালে আপলোড ও স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পত্রিকায় পাঠাচ্ছেন। পরদিন একই সংবাদ পত্রিকাগুলো হুবহু প্রকাশ হয়। আবার অনেক টিভি/প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদকর্মী সকাল দুপুর রাতে যখনেই কোন ঘটনা ঘটে তখনেই আমার কাছে ফোন করে বলেন তুমি ঘটনাটা জান বা নিউজটা করছ নাকি? আমার প্রতি আস্থা থাকায় নিউজটা তাদের মেইলে চেয়ে বসেন।
এছাড়া জেলার অনেক সাংবাদিক আছেন যারা আমার নাম জানেন কিন্তু আমাকে কখনো দেখেননি। কিন্তু অল্প সময়ে যায়যায়দিন ও দ্য রিপোর্ট আমাকে দিয়েছে নীতি-নৈতিকতা, শিক্ষা, আদর্শ, সততা, নিষ্ঠা আর দায়িত্ববোধ। সেই সঙ্গে যায়যায়দিন ও দ্য রিপোর্টের কারণে জেলাজুড়ে সংবাদকর্মী হিসেবে নিজেকে আতœপ্রকাশ করতে পেরেছি। এটা আমার আনন্দের বিষয়।
শুধু সাংবাদিকতা নয় লেখালেখি নিয়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও মফস্বল পর্যায়ের সাংবাদিকদের সমন্নয়ে গড়া প্রেসক্লাব, রিপোর্টার্স ইউনিটি ও কয়েকটি সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলাম। মফস্বল সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষা, মুক্ত সাংবাদিকতার বিকাশ ও সর্বদা ঐক্যবদ্ধ রাখতে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে অনেকটা নেতৃত্বের ভুমিকা পালন করতে হয়েছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাঁধা, হুমকি, নির্যাতন ও বিপদ-আপদে সর্বদা প্রতিবাদে যথেষ্ট অন্তরিক ও সক্রিয় ছিলাম এবং ভবিষ্যতেও থাকব, ইনশআল্লাহ্। পাশাপাশি নিজের মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেও যখন যেভাবে পেরেছি সমাজের অসহায়-গরবী ও হতদরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সাধ্য মতো সাহয্যে-সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি ।
জেলা শহর ও অনান্য উপজেলায় সংবাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। সংবাকর্মীদের বিভক্তির কারণে জেলা ও উপজেলায় প্রেসক্লাবসহ একাধিক সংগঠন রয়েছে। কিন্তু সাদুল্যাপুর উপজেলায় ২০-২৫ জন সংবাদকর্মীর সমন্নয়ে গড়ে উঠা একটি মাত্র সংগঠন তা হলো ‘সাদুল্যাপুর প্রেসক্লাব’। প্রেসক্লাবটি ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে সাদুল্যাপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও আমার কাঁধে। এটাও আমার বড় পাওয়ায়।
শুধু সাংবাদিকতা বা সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম না। এ পর্যন্ত শিক্ষাগত যোগ্যতায় এম,এ ও এলএলবি সম্পর্ন্ন করেছি। চলমান ঘটনা, সমাজের নানা সমস্যা, অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র ও অনুসন্ধানী অভিযানে খবরের পেছনের খবর তুলে ধরতে গিয়ে অনেক বাঁধা আসলেও একদিনেও থেমে থাকেনি সাংবাদিকতা। এ যেন এক দু:সাহসি অভিযান। তাই আমি মনে করি ১৬ বছর ধরে মফস্বল পর্যায়ের সাংবাদিকতা আমার স্বপ্নকেও হার মানিয়েছে। সার্থক হয়েছে আমার সাংবাদিকতা জীবন।
তবে ১৬ বছরে সত্য ঘটনা প্রকাশ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার হোচট, হুমকি ও বাঁধাগুস্ত হয়েছিলাম। এক সঙ্গে কাজ করে অনেক সংবাদকর্মী অন্য পেশায় চলে গেছেন। কিন্তু এত ঝুঁকির পরেও মনোবল না হারিয়ে নীতি-নৈতিকতার কারণে নিজের একান্ত ইচ্ছেয় বারবার উঠে দাঁড়িয়ে অবিরাম গতিতে চলেছি। এটাই আমার সার্থকতা।
কেউ ভাববেন না আমি নিজের গর্ব বা প্রশংসার জন্য লেখাটি লেখেছি। আমি শুধু আমার সাংবাদিকতা জীবনের সঞ্চিত বাস্তত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছি। মফস্বল সংবাদকর্মীদের পাওয়া না পাওয়া ও সুখ-দু:খের খবর আমি জানি। সেকারণে নতুন প্রজন্মে এখন যারা মফস্বলে সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করছেন তারা হলুদ ও ‘কপি টু পেস্ট’ সাংবাদিকতা পরিহার করুন। মফস্বলের তরুণ প্রজন্মের সংবাদকর্মীরা তাদের নিজের লক্ষ ও উদ্দেশ্য ঠিক রেখে মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা দিয়ে সকল বাঁধা বিপত্তি মোকাবেলা করে এগিয়ে যাবেন এই প্রত্যাশা করি।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।