সকল মেনু

অয়নের পৃথিবী দেখা

indexমোহাম্মদ রাজীব আহমেদ
রাতে স্নিগ্ধ চাঁদ উঠেছে। মিষ্টি আলোতে আলোকিত হয়ে উঠেছে সারা গ্রাম। অয়নদের বাড়ীর উঠানের বামপাশে বেশকিছু আম ও লিচুগাছ। গাছের ডালে ডালে নানাপাখির নিবাস। প্রভাতে ও গোধূলীবেলায় পাখিগুলো কলকাকলীতে পরিবেশ মুখরিত করে তোলে।
এত পাখির ভীড়ে বুঝা কষ্ট কোন্ কোন্ পাখি ডাকছে কোথায়। তবে অয়ন খুব সচেতন, একটি পাতা ঝরার শব্দও তার এড়ায় না। অয়নের একটি ছাগল আছে। সব সময় সে সেই ছাগলটাকে আগলে রাখে। ‘রিনি’ তার নাম। নাম ধরে ডাক দিলেই সে হাজির হয়।
সামনে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা অয়নের। পড়তে বসেছে শাহ-উল কবীর অয়ন। বাংলা বইয়ের একটি গল্প পড়ছে। ছাগলটি তার পাশে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট শিং দিয়ে, মাথা দিয়ে বা পেট দিয়ে গা ঘেঁষে আদুরে ভাবপ্রকাশ করছে। এতে অয়নের পড়ার কোনো ব্যাঘাত ঘটে না।
ছাগলের মাথাতে হাত বোলাতে রিনি নামক ছাগলটি বলে ওঠে, ‘একি তুমি তো পড়ছ না! অন্য দিকে এত খেয়াল করো না। তোমাকে মা বকবে।’ অয়ন সচেতন হয়ে ওঠে, পড়াতে মন দেয়।
ছাগলের দিকে আর খেয়াল করে না। কিন্তু ছাগলটি তখন বেশ খিদে পেয়েছে। তবুও সে অয়নের পিছ ছাড়ে না। অতঃপর মা আসেন, বলে অয়ন খেয়ে নে। অয়নের পাশে ছাগলটি বসে থাকতে দেখে তিনি ছাগলটি ডেকে কলার খোসা খেতে দেন মা পরম আদরে।
অয়ন অবাক হয়ে ভাবে, ছাগলটি কেবল তার সাথে বা তার মতো ছোট-ছোট মানুষের সাথেই কেবল কথা বলে। বড়দের সাথে কোনো কথা বলে না, কেবল ‘ম্যাঁ-ম্যাঁ’ বা ‘ম্যাঁহাহাহা-ম্যাঁহাহাহা’ করে। অয়ন ভাবে, ছাগলটি বড় অদ্ভুত।
পরদিন সন্ধ্যায়ও ছাগলটি পায়ে পায়ে অয়নের সাথে পড়ার ঘরে গিয়ে বসে। অয়নকে যথারীতি আদর জানাতে থাকে। অয়ন বলে, ‘তুমি কেন পড়ালেখা কর না? কেন শুধু আমাকে পড়তে বল?’ ছাগল-ছানা রিনি, দাঁত কেলিয়ে হাসে। বলে, ‘আমরা পড়ালেখা করতে পারলে কি আর তোমাদের গোয়ালে বাস করতাম? আমরা পারি না বলেই তো, তোমাদের কথা মেনে আমাদের চলতে হয়। আমাদের জীবনটা ক্ষণিকের। এই ধরো আমরা বড় হলে যে কোনো দিন আমাদের মরতে হবে।…’
এদিকে অয়নের বিরবির করে কথা বলতে দেখে মা রান্নাঘর থেকে হাঁক দেন, ‘অয়ন কার সাথে কথা বলিস? জোরে জোরে পড়।’ অয়ন আবার পড়াতে মন দেয়।
সকালে অয়ন স্কুলে যায়, দুপুরে বাড়ী ফেরে। সেই সকাল থেকেই যেন ছাগল-ছানাটি অয়নকে খুঁজে ফেরে। আজ দুপুরে ছাগল-ছানাটি অয়ন ফিরলে নালিশ করে, ‘জানো, আমার মা না আমাকে দূরে যেতে দেয় না। বলে তুমি হারিয়ে যাবে, যেও না। বলত, আমি আর কবে বড় হব?’ অয়ন সমবেদনা জানিয়ে বলে, ‘আমার মা-ওতো আমাকে এভাবে বারণ করে। আমিও বলে ছোট!’
অয়ন কিছুক্ষণ ভেবে বলে, আচ্ছা সুমনচাচ্চু আছে না তার সাথে না হয় আমরা একবার গোলাকার পৃথিবীটা দেখে আসব, ঠিক আছে?’ রিনি খুশী হয়ে বলে, ‘ঠিক আছে।’
বিকালেই অয়ন তার চাচ্চুকে রাজী করতে চেষ্টা করতে থাকে। সুমনচাচ্চু অবাক হয়ে বলে, ‘পুরো পৃথিবীটা তুই একদিনে দেখতে চাস? তাও আবার সাথে রিনিকেও দেখাতে চাস!’
অয়ন কান্না ধরে, ‘না চাচু তোমাকে দেখাতেই হবে, দেখাতেই হবে…’
চাচু বাধ্য হয়ে বলে, ‘ঠিক আছে কাল শুক্রবার খুব ভোরে উঠবি, আমি তোকে পৃথিবীটা দেখাতে নিয়ে যাব।’ অয়ন খুব খুশী হয়, সে অপেক্ষায় থাকে কখন এই বিকেল ও রাতটা দ্রুত কাটবে।…
খুব ভোরে মা অয়নকে হাসতে হাসতে ডেকে দেয়, বলে, ‘যা তোর চাচ্চুর সাথে পৃথিবীটা দেখে আয়।’ অয়ন মায়ের হাসির কারণ বুঝতে পারে না। তবে সে উৎফুল্ল, কারণ আজ সে পৃথিবীটা গোটায় দেখবে! সে রিনির গলায় একটা হালকা দড়ি পরিয়ে সাথে করে নিয়ে বের হয়ে— চাচ্চুকে ডাকতে থাকে। চাচ্চুও প্রস্তুত ছিল, তিনিও হাসতে হাসতে বের হন। এর আগে অয়ন দু’একবার নানাবাড়ী গেছে— কিন্তু প্রথমে গরুগাড়ী ও পরে বাসে যাওয়ার কারণে তেমন বুঝতে পারেনি পৃথিবীটা কেমন। তবে সে তার বাড়ীর চারপাশ দেখেছে, তাতে অনুমান করে গোটা পৃথিবীটা একপ্রকার খারাপ হবে না!
সুমনচাচ্চু গাঁয়ের পথ ধরে অয়ন ও রিনিকে নিয়ে হাঁটতে থাকে। পথে পথে থেমে থেমে— গাছ-গাছালী, পশু-পাখি, পুকুর-জলাশয় দেখাতে থাকেন। দেখাতে থাকেন— বিস্তৃত ফসলের ক্ষেত। যেখানে বিভিন্ন রকম শাক-সব্জি ও খাদ্যশস্য চাষ করা হয়েছে।
চাচ্চু কেবল হাঁটেন তা নয়, সুবিধাজনক জায়গা বেছে-বেছে তিনি গাছের ছায়াতে ছায়াতে বসে বিশ্রাম নেন ওদেরকে নিয়ে— আবার গল্পও করেন, নানা বিষয়ে জানান। তবে, চাচ্চু সন্দেহ রিনি নামক ছাগলটি আনন্দ নিতে পারছে না। চাচ্চু বিশ্রামের সময় মায়ের দেওয়া টিফিনবক্স থেকে নানাপ্রকার খাবার একটু একটু করে বের করে— তিনি নিজে খান আবার অয়নকেও দেন। রিনিকে আশপাশের গাছ থেকে পাতা বা ডাল ভেঙ্গে দেন খেতে।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে এক সময় দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে। যদিও বার বার বিশ্রাম নেওয়া হয়েছে, তারপরও অয়নের সারা শরীরে ক্লান্তি ভর করে। সে সময় তারা এক নদীর কাছে এসে পৌঁছায়। স্বচ্ছ পানির নদী, সুন্দর ঢেউ, নৌকা বয়ে চলেছে, জেলেরা মাছ ধরছে, মানুষজন পারাপার হচ্ছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য, যা কিনা অয়ন আগে কখনো দেখেনি।
কিন্তু তারা এত ক্লান্ত যে আর এগোনো সম্ভবও নয়। চাচ্চু একটা গরুগাড়ী ডেকে থামান। অয়নকে বলেন, ‘আজ আর আমরা পৃথিবী দেখা বাদ দি, কি বলিস অয়ন?’ অয়ন ক্লান্তি নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, চাচ্চু আমি আর হাঁটতে পারব না। তা চাচ্চু আমরা পৃথিবীর কতভাগ দেখলাম?’ চাচ্চু বলেন, ‘আমরা আমাদের পুরো হাসানপুর গ্রামটার চারপাশ ঘুরে কেবল দেখতে পারলাম।’
অয়ন কথা শুনে থেমে ফের বলে, ‘তা বুঝলাম, এটা কি পৃথিবীর অর্ধেক হবে, চাচ্চু?’ চাচ্চু বলে, ‘তোমার কাছে এটা পৃথিবীর অর্ধেক হবে। আমার কাছে সেটা আরও বড়।’
মাঝে-মাঝে ছোটচাচ্চু বা সুমনচাচ্চু বেশ জটিলভাবে কথা বলে, ঠিক অর্থ বুঝা কষ্টকর হয়। এটাও অয়নের কাছে তেমন লাগে। চাচ্চু থেমে ফের বলেন, ‘তুমি যখন বড় হবে, তখন পৃথিবীটাও বড় হবে— বুঝেছ অয়নবাবু।’
অয়ন এবার কিছুটা বুঝতে পেরে খুশী হয়। তাই তো আমরা বড় হচ্ছি, পৃথিবীটাও তো বড় হবে— এটাই স্বাভাবিক!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top