সকল মেনু

কপি টু পেস্ট, এক অদ্ভুত সাংবাদিকতা!

জিল্লুর রহমান পলাশ :Gaibandha-PALASH-1
একজন দক্ষ ও সত্যিকারের সংবাদকর্মী বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি ও ডিজিটাল যুগে বড় বেকায়দায় পড়েছেন। সাংবাদিকতার মধ্যে এখন চরম ধরণের পাইরেসি চলছে। কপি টু পেস্ট করে একটি রিপোটের্ই ঘুরছে সব মিডিয়ায়। প্রতিটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে লেখা থাকে (…২৪.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাডা ব্যবহার করা যাবে না)

কিন্তু কে শোনেন, কে বোঝেন আর কে মানে এ নীতি নির্দেশ। প্রথম শ্রেণির হাতেগোনা কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে রিপোর্ট আপলোড হয়েছে, ব্যাস এখন কপি করে শুধু ডেট লাইন আর হেড লাইনে পরিবর্তন করে নিজের নামের ফাইল পাঠাতে পারলেই হলো। ওই রিপোর্টটি পাঠানোর পর তাদের অনলাইনে আপলোড হলেই মস্ত বড় ‘বিশিষ্ট সাংবাদিক’ হয়ে গেলেন।

কিন্তু সহকর্মী আপনি একবার কি ভেবে দেখেছেন, যিনি রিপোর্টটি প্রথম করেছেন তিনি ঠিক তথ্যর ভিত্তিতে রিপোর্টটি করেছেন কি না? সাংবাদিকতায় দায়িত্বশীল ও প্রভাবশালী অনলাইনগুলোর প্রতিটি সংবাদকর্মী বা প্রতিবেদক সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিশ্চিয়তার বিষয় ও তাদের বক্তব্য নিয়ে রিপোর্ট তৈরী করে থাকেন। কিন্তু এখানে ওই সকল সংবাদকর্মী বা সাংবাদিক বিষয়টি তুচ্ছ মনে করে একই রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন তাদের অনলাইন পোর্টালে।

কিছু দিন ধরেই লক্ষ করছি সাংবাদিকদের মধ্যে চলছে এখন কপি পেস্ট প্রতিযোগিতা। মুলত সাংবাদিকতার জগতে কপি পেস্ট করাকে আমি মনে করি ‘চুরির সাংবাদিকতা’! কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে আমারও তো সম্মান বা দায়িত্বরোধ রয়েছে যে ‘সংবাদকর্মী বা সাংবাদিক গোষ্টির ইজ্জত রক্ষা করার’।

আমি মফস্বল এলাকার সংবাদকর্মী। অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকমে গাইবান্ধা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করি। দ্য রিপোর্টের শুরু থেকে এক বছর কাজ করে আমি বর্সসেরা প্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছি। এছাড়া আমি যায়ায়দিনের উপজেলা প্রতিনিধি ছিলাম। আমার ইচ্ছে না থাকা সত্বেও যায়যায়দিনের কর্তৃপক্ষ আমাকে গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন। শখের বশে ১৯৯৯ সালে সাংবাদিকতা শুরু করি।

গত ১৬ বছরে অনেক বাঁধা বিপত্তি উপেক্ষা করতে হয়েছে। লেখার ব্যাপরে কখনো পিছপা হইনি। এখনো দিনরাত ছুটে চলি সংবাদের পিছনে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ডেইলি রিপোর্ট তৈরী তা পাঠাতে ব্যস্ত থাকতে হয়। আর রাত থেকে কখন যে ভোর হয় নিদিষ্ট বিষয়ের উপর ফিচার প্রতিবেদন তৈরীতে। সংবাদের ক্ষেত্রে কখনো কারও উপর নির্ভরশীল ছিলাম না। নিজে যা পাই, যেভাবে পাই, ঠিক সেভাবেই আজো কাজ করে চলছি।

জেলার প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাধর্মী রিপোর্টগুলোর পরিপূর্ণ তথ্য সংগ্রহে সরেজমিনে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে এসে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দ্য রিপোর্টে পাঠাই। এছাড়া ফিচার-প্রতিবেদনের জন্য সরেজমিনে অনেক বেশি সময় দিতে হয়। তবে ঘটনার উপরেই নির্ভর করে একজন সংবাদকর্মীকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা। ঘটনাধর্মী নিউজের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা, লাশ উদ্ধার, মাদক উদ্ধার, সংঘর্ষ, হামলা, মামলা, গ্রেফতার, অগ্নিকা- ইত্যাদি রিপোর্টগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট পাওয়া তথ্য উপর পুলিশ, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ  সংশ্লিষ্টদের নিকট ফোন করে নিশ্চিত হতে হয়। তারপরেই রিপোর্টটি পাঠাই অনলাইনে।

আবার ওই একই রিপোর্ট ডেট লাইন, হেড লাইন, শব্দ, ছন্দ ও তথ্যর সংযোগ, বিয়োজন, পরিবর্তন করে পাঠাতে হয় যায়যায়দিনে। একটি রিপোর্ট তৈরী করতে একজন সংবাদকর্মীকে অনেক ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। তথ্য সঠিক কিনা যাচাই-বাছাই তার পরে কম্পিউটারে মাথা খাটিয়ে রিপোর্ট তৈরী করতে হয়।

আর আমার পরিচিত অনেক সংবাদকর্মী আরাম আয়েসে বসে থাকেন কখন দ্য রিপোর্টে কোন নিউজ আপলোড হলো। অনলাইন মিডিয়ায় আপলোড হলেই ‘কপি টু পেস্ট’ হয়ে অন্য কোন ‘বিশিষ্ট’ সাংবাদিকের নামে একই নিউজ, একই হেডলাইনে, একই শব্দে, একই ছন্দে তাদের মিডিয়ায় পাঠাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হলো, এসব সংবাদকর্মী যে ভাবে রিপোর্টটি পাঠালেন ঠিক সেইভাবেই রিপোর্টটি আপলোড করলেন সংশ্লিষ্ট অনলাইনের ডেক্সের দায়িত্বরতরা। রিপোর্টারের পাঠানো রিপোর্ট এ কোথায় ভুল বানান, কেথায় শব্দের পরিবর্তন বা সংযোজন হবে তাও লক্ষ করেন না ডেক্সের দায়িত্বরতরা।

এসব অনলাইনে যারা কাজ করেন তারা আবার ফেসবুকেও রিপোর্টটি পোস্ট করতে অভ্যস্ত। অনলাইনের পাঠক ও ফেসবুকের বন্ধুরাও ওই রিপোর্টটি পড়ে, বুঝে নিতে বাধ্য, যে আহা বেচারা সংবাদিক কত ভালো না রিপোর্ট করেছেন। আবার আপলোড হওয়া রিপোর্টটি দেখার জন্য অন্য সংবাদকর্মীদের ফোন করে আনন্দের সঙ্গে জানান, আজকে আমার অনলাইন দেখেন আমার পাঠানো রিপোর্টটি কত বড় আর যতœ সহকারে আপলোড করেছে।

ওই সকল সংবাদকর্মীদের কাছে আমার প্রশ্ন রইল? আপনারা একবারও ভেবে দেখেছেন কি, ঘটনা ঘটার পর যিনি প্রথম (সংবাদকর্মী) রিপোর্টটি তৈরী করেছেন তার একটি লাইন লিখতে কতবার ভুল হয়েছিল, কতবার তাকে লাইনের শব্দ পরিবর্তন সংযোজন করতে হয়েছে। আর কতবারেই বা সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত ও বক্তব্য নেওয়ার জন্য মোবাইলে কল করতে হয়েছে। আমি দেখেছি অনেক সময় তথ্য পাওয়ার পর রিপোর্ট তৈরী করে আমার অনলাই পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু একটু পর জানতে পারলাম আমার পাঠানো তথ্যটি অনেক ভূল রয়েছে। এরপর রিপোটর্টি ওই মুহুর্তে অনলাইনে আপলোডও হয়েছে।

চাকরী হারানোর ভয়ে অনেক সময় সংশোধনী না দিয়ে পরবর্তীতে সম্ভব হলে ফলো আপ রিপোর্ট করি। আর আপনারা খোঁজখবর না দিয়ে আপলোড হওয়া ওই ভূল রিপোর্টটি কপি করে অন্য অনলাইনে পাঠাচ্ছেন। এটা কতটুকু ঠিক, একবার ভেবে দেখবেন? এছাড়া অনেক সময় একটি ঘটে যাওয়া ঘটনার রিপোর্ট তৈরীতে তথ্য পাওয়া কষ্টকর হয়, স্থানীয় বা সংশ্লিষ্টদের কাছে ফোন করেও তেমন কোন তথ্য বা বিষয়টির পুরিপূর্ণ নিশ্চিয়তা দিতে পারেন না। এরকম রিপোর্ট তৈরী করতে কতবার যে পরিবর্তন সংযোজন আবার কতবার যে কম্পিউটারের কি বোর্ড এবং মাউসে হাত ফেলতে হয় তারও হিসেব থাকেনা।

আমার দেখা ও পরিচিত অনেক সংবাদকর্মীর কথা জানি, শুধু নামে মাত্র একটি প্রিন্ট মিডিয়া বা অনলাইনের প্রতিনিধি হয়েছেন। সারাদিন ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকুরি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তিনি। বিকেল ৩-৪টার দিকে জেলা বা উপজেলা যারা প্রকৃত সংবাদকর্মী তাদের কাছে ফোন দিয়ে বলেন, হ্যালো ভাই আজ কি রিপোর্ট ছিল? আমার অনলাইনে সব পাঠাইছেন তো, আর পত্রিকাতেও একটু পাঠান আমি বাইরে আছি। আবার অনেকে ফোন জানতে চান ভাই আজ কি পাঠাইছেন? আমার মেইলে একটু দেন, আমি মেইলে বসে আছি, আমার অফিস নিউজ চাচ্ছে ইত্যাদি।

সম্প্রতি পরিচয় হওয়া আমার এক জুনিয়র সহকর্মী আমাকে একদিন বললেন, আমার নিউজ পাঠাতে কোন চিন্তা ও সমস্যা নেই। কারণ কি জানতে চাইলে সে জানান, আরে সমস্যা কি, দ্য রিপোর্ট আর বাংলানিউজ আছে না। ওখানে নিউজ আপলোড হলেই কপি করে আমার অনলাইনে পাঠাই।

কয়েকদিন আগে অন্য এক সহকর্মী আমাকে বললেন, ভাই আপনার লেখা রিপোর্টগুলো দ্য রিপোর্টকে খুব পড়ি, আমার খুব উপকার হয়। উপকার হয় মানে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনার দ্য রিপোর্ট থেকে রিপোর্টগুলো কপি করি তারপর কনভার্ট করে ঢাকার একটি অনলাইন ও একটি দৈনিক পত্রিকায় নিজের নামে পাঠাই।

এছাড়া অনেক সংবাদকর্মী আছেন যারা একটি লাইন রিপোর্ট তৈরী করতে পারেন না। তাদের গল্প আর ভাব দেখলে অন্যরকম অবস্থা মনে হয়। সকালে উঠে হকারের কাছে ২-৩টা পত্রিকা নিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত রেখে বেরিয়ে পড়বেন অফিস, আদালত, ব্যাংক বীমায়। সারাদিন এসব অফিস চষে বেড়িয়ে যার কাছে যা পান হাতিয়ে নিয়ে বাসায় ফেরা।

আবার জেলা ও উপজেলার বেশ কিছু সংবাদকর্মী রয়েছেন যারা মাসিক ভাড়ায় নিউজ লেখা ও পত্রিকায় পাঠানোর জন্য ‘সাংবাদিক’ নিয়োগ দিয়েছেন! আবার অনেকে একটি কম্পিউটার, ল্যাপটপ খুলে বসে আছেন, কে কখন কোন অনলাইন পোর্টালে নিউজ করল, মেইলে চেয়ে নিলেন না হয় অনলাইন থেকে কপি করলেন, হায়রে সংবাদকর্মী, হায়রে সাংবাদিকতা কি অদ্ভুদ ব্যাপার!

আমার এ লেখা পড়ে অনেকে আমাকে গালি দিবেন, অনেকে সমালোচনা করবেন। আবার কেউ বলবেন আমি নাকি খুব বড় সাংবাদিক হয়ে গেছি। আসলে না এধরণের লেখা লিখতে আমারও লজ্জা করে। কারণ আমরা তো সবাই একই গোষ্টির! কিন্তু কিছু বিষয় লক্ষ করে আর মেনে নিতে পারছিনা। আমার মনের রাগ আর যন্ত্রণা থেকে লেখাটি লিখলাম। আমি ওইসব সংবাদকর্মীদের বলব আপনারা যে যাই পারেন লেখা চেষ্টা করেন।

অন্যর লেখা কপি করে সাংবাদিকতা করবেন না। আপনারও তথ্য সংগ্রহ করুন, সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে মতামত নিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত হন। অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে সাংবাদিকতা করার চেয়ে দালালি করা অনেক ভালো হবে। আমার দক্ষ সাংবাদিক সহকর্মী ভাইদের কাছে ক্ষমা চাই এ কারণে যদি অযাচিত কিছু লিখে থাকি। তবে যারা কপি পেস্ট করে সংবাদকর্মী সেজেছেন তাদের কাছে নয়!

লেখক: জিল্লুর রহমান পলাশ, গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি, দৈনিক যায়যায়দিন ও দ্য রিপোর্ট টুয়েন্টিফোর ডটকম।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top