সকল মেনু

শতভাগ কাজ করে না এনজিও সংস্থা, বদলায়নি হাকালুকি হাওরের জেলেদের জীবন

15এম শাহজাহান আহমদ, হাকালুকি থেকে ফিরে : হাওর-বাওরের দেশ বাংলাদেশ। বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওর এ উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় ও বৈচিত্রপূর্ণ বলে খ্যাত।এ হাওর তীরের মানুষরা তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে মৎস্য ও হাওর সম্পর্কিত জীবিকাই বেছে নিয়েছে।হাকালুকি তীরের জেলে পরিবারের মধ্যে বিকল্প জীবিকায়ন প্রকল্পের নামে একটি বেসরকারি এনজিও সংস্থা ‘প্রচেষ্টা’ মার্চ ২০১৩ থেকে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলা এবং সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলা এলাকায় তাদের কার্যক্রম শুরু করে। আর সেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে চলতি ২০১৫ সালের জুন মাসে। কিন্তু সত্যি কি প্রচেষ্টার চেষ্টায় সেই সব হতদরিদ্র হাওর তীরের জেলেদের জীবনমানের কোনো পরিবর্ত হয়েছে?জেলার কুলাউড়া উপজেলার ভূকশিমইল ইউনিয়নের জেলে পাড়া অধ্যুষিত ৯নং সাদিপুর ওয়ার্ডে ৩০ জন ও ৪০ জনের ৬টি সমিতি করে এনজিওটি কাজ শুরু করে। এছাড়াও বরমচাল ইউনিয়ন ও ভাটেরা ইউনিয়নে তাদের কর্ম এলাকা রয়েছে। ইতোমধ্যে ভাটেরা এলাকায় তাদের প্রজেক্টের কাজ শেষ হয়েছে মর্মে চেয়ারম্যানের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে গেছে এনজিওটি। সংস্থাটি এ পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম প্রায় শতভাগ সম্পূর্ণ ও সফল দাবি করলেও বাস্তবে পাওয়া যায় ভিন্ন চিত্র।মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায় ১২শ পরিবার এবং সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জের শরীফগঞ্জ ও উত্তর বাদে পাশা গ্রামে ৮শ পরিবারের মধ্যে তাদের কর্মপরিধি থাকলেও বাস্তবে কতজন লোক উপকৃত হয়েছে তা দেখার বিষয়।হাওর তীরের ৫ উপজেলার ২ লাখের ও বেশি মানুষ জীবন-জীবিকার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ হাওরের ওপর নির্ভরশীল। হাওর তীরের মানুষ অতিমাত্রায় হাওরের ওপর নির্ভরশীল। তাই এর উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য যেমন হুমকিতে পড়েছে তেমনি এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকিতে। অকাল বন্যা আর দীর্ঘ খরায় প্রতি বছরই ক্ষেতের ফসল হারিয়ে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ফলে সরকার ১৯৯৯ সালে হাকালুকি হাওরসহ দেশের ৮টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া, ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করে।
সরেজমিনে, কুলাউড়া উপজেলার ভূকশিমইল ইউনিয়নের মীরশংকর-সাদিপুর, বাদে ভূকশিমইল, বরমচার ইউনিয়নের আকিলপুর ও ভাটেরা ইউনিয়ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এখানকার জীবনমান উন্নয়নতো দূরের কথা অর্ধাহারে অনাহারে মানবেতর দিনযাপন করে যাচ্ছেন দরিদ্রপীড়িত জনসাধারণ।সাদিপুরের মৎস্যজীবীরা জানায়, বছরের ৩ থেকে ৪ মাস হাওরে মাছ মারা হয়। ৮ থেকে ৯ মাস তাদের বেকার সময় পার করতে হয়।এছাড়া আরো কয়েকজন মৎস্যজীবী জানায়, বছর দু’য়েক আগে প্রচেষ্টা এ এলাকায় তাদের নিয়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সমিতি গঠন করে। এসব সমিতির মাধ্যমে সমিতির সদস্যদের বিনা সুদে ঋণ, বিনামূল্যে ধানের বীজ, বিশুদ্ধ পানির জন্য নলকূপ, হাঁস-মুরগি পালন, মৎস্য চাষ, সবজি চাষের জন্য সহায়তা এবং বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি পায়খানা, নারীদের ধাত্রী প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। কিন্তু তা করা হয়নি।তারা অভিযোগের সুরে আরো জানায়, সমিতি গঠনের পর তাদের নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণের জন্য মিটিং ডেকে কর্মকর্তারা সহায়তার আশ্বাস ছাড়া কার্যত আর কিছুই দিতে পরেননি। এমনকি তাদের ছবি ও আইডি কার্ডও বিভিন্ন সময় নিয়েছেন।সমিতিগুলোর সভাপতি-সম্পাদকরা অভিযোগ করে জানায়, এ পর্যন্ত তাদের সমিতিগুলোর মধ্যে তিন জন করে সদস্যদের বিনা সুদে ৫ হাজার টাকা করে ঋণ দেয়া হয়েছে। যার বেশিরভাগ ইতোমধ্যে তারা পরিশোধ করেছেন।অনেকে অভিযোগ করে জানায়, এ ঋণ নিয়ে তাদের কোনো কাজে আসেনি বরং ক্ষতি হয়েছে। ৬টি সমিতির মধ্যে মাত্র ১২টি পায়খানা বিতরণ করা হয়েছে এবং কিছু কিছু ধানবীজ দেয়া হয়েছে। এলাকায় প্রতিটি ঘরে খোলা পায়খানা চোখে পড়ে। বিশুদ্ধ পানির প্রচুর সংকট থাকলেও দেয়া হয়নি কোনো টিউবওয়েল।বরমচাল ইউনিয়নের আকিলপুর গ্রামের জোছনা বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় তার ঘর-দোর ভাঙা, খোলা পায়খানা অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন। স্বামী রশীদ আলী এখনো পাহাড় থেকে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। অথচ জোছনা বেগমকে অক্সফাম জার্নালে বিশ্বের ১০ জন কৃষাণী নারীর মধ্যে ৩ নম্বরে স্থান দিয়েছে।এলাকার মুরব্বি হাজি ঈসমাইল খান বলেন, ‘রশীদ আলী এখনো কাঠ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে অথচ এনজিওরা কীভাবে এদের স্বাবলম্বী বলে তা আমাদের বোধগম্য নয়। বাড়িতে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সালে শুধু একটি টিউবওয়েল স্থাপন করেছে।’জোছনা বেগমের স্বামী রশীদ আলী জানান, তার স্ত্রী বছর-দেড় বছর থেকে এনজিওর সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। এর আগে তার স্ত্রী বাড়ির কাজসহ তার সঙ্গে কৃষিকাজ করতো। তার স্ত্রীকে এনজিও সংস্থা কেন বেছে নিল তা তিনি জানেন না বলেও জানান। এ সময় তার স্ত্রীকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী জোসনা বেগম মিটিং করতে ঢাকায় চলে গেছেন।ভূকশিমইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও কুলাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম রেনু জানান, প্রচেষ্টা আসলে কোনো কাজই করেনি। শুধু ইউনিয়নে এসে বিভিন্ন সময়ে তার কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়েছে। মানুষের মাথাগুনে এনজিওরা যে টাকাটা আনে তা যেন তাদের কাজে লাগে। এ ব্যাপারে তিনি উপজেলা প্রশাসনের সভায় জোরালো বক্তব্যও রেখেছেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না।ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সিরাজ মিয়া বলেন, ‘প্রচেষ্টার কার্যক্রম নিয়ে আমার কাছে ধুম্রজালের সৃষ্টি হওয়াতে আমি এলাকায় কর্মরত প্রচেষ্টার লোকদের সঙ্গে অনেক তর্কাতর্কি করেছি কিন্তু তারা আমাকে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। আমার এলাকায় তাদের সমিতি থাকলেও কোনো কর্মকাণ্ড আমার চোখে পড়েনি বা কোনো কাজ তারা করেনি।’তিনি আরো বলেন, ‘গত বৎসরের ডিসেম্বর মাসে বা এ বৎসরের জানুয়ারি মাসে তাদের কর্মকাণ্ড শেষ হয়েছে বলে তার কাছ থেকে দস্তখত নেয়া হয়েছে। অনেকটা জোর করেই তার কাছ থেকে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। মানুষের জন্য আসা টাকা যেন সঠিক কাজে ব্যয় করা হয়।’ এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন। প্রচেষ্টার ‘হাকালুকি লাইভহুডস ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের (এইচএলডিপি) ম্যানেজার মো. ফেরদৌস আলম বলেন, ‘হাকালুকি হাওর তীরের মানুষদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কুলাউড়া উপজেলায় ভূকশিমইল বরমচাল ভাটের ইউনিয়নে হংকংয়ের অক্সফামের অর্থায়নে কাজ শুরু হয়। ২০১৩ সালের মার্চ মাস থেকে ২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত ‘বিকল্প জীবিকায়ন প্রকল্প’ নামে প্রচেষ্টা এসব এলাকায় ৩০টি সমিতির মাধ্যমে জেলে ও কৃষক পরিবারের ১২শ নারী-পুরুষ নিয়ে সংস্থাটি তাদের কার্যক্রম শুরু করে।’তিনি আরও বলেন, ‘এ পর্যন্ত তারা ৭০ শতাংশ কাজ সমাধা করেছেন। তাদের প্রজেজক্টের মধ্যে ৬৬ রকমের কাজ রয়েছে। সুদবিহীন ঋণ দিয়েছেন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, হাঁস-মুরগি পালন বাবদ ২৫ জনের মধ্যে ১ লাখ টাকা, মৎস্য পালনে ২ লাখ, ৫০টি পরিবারকে ২ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ২০১৪ সালে ৫টি টিউবওয়েল এবং ২০১৫ সালে ২টি টিউবওয়েল দেয়া হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে উপকারভোগীদের মধ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’প্রচেষ্টার নির্বাহী পরিচালক নবাব আলী নকী খান বাংলামেইলকে বলেন, ‘আমাদের প্রজেক্টের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। দু’একটি জায়গায় সামান্য ত্রুটি থাকতে পারে। আমরা সবসময় সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে থাকি।’
পরিবেশ অধিদপ্তর কুলাউড়া ন্যাচারাল রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট অফিসার বশির আহমদ জানান, প্রচেষ্টা তাদের সঙ্গে যৌথভাবে যে কাজটি করেছে তা ভালো করেছে। তবে অক্সফামের প্রজেক্টের সঙ্গে আমাদের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও তাদের কাজ সম্পর্ক কতটুকু সফল তা তিনি বলতে পারছেন না। কোনো এনজিও সংস্থাই শতভাগ কাজ করতে পারে না।’
এ ব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজমুল হাসান বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top