সাতক্ষীরা প্রতিনিধি: সাতক্ষীরার মাটির তৈরি টালি শুধু বিদেশীদের নজর কাড়েনি, ঘুরিয়েছিল দেশের অর্থনীতির চাকাকেও। টালি হয়েছিল সাতক্ষীরার এক নম্বর অর্থনৈতিক খাত। ইতালিয়দের রুচি ও চাহিদার সাথে তাল মিল রেখে তারা টালির ডিজাইন করত। রেক্ট্যাঙ্গগুলার, স্কয়ার, এ্যাঙ্গ্গুলার, ব্রিকস শেপড-এসব বিভিন্ন আকার ও ডিজাইনের টালি তৈরি ও রপ্তানি করে থাকত।চিংড়ী শিল্পের পাশাপাশি কোন মেশিন বা যন্ত্র ছাড়াই সম্পূর্ণ হাতের তৈরি টালি দখল করে নিয়ে ছিল বিশ্ব বাজার। শীতপ্রধান ও অতি তুষারপাত দেশে এপোড়া মাটির টালি দৃষ্টি কেড়েছিল বিদেশীদেরও। কারণ এই টালিতে কোন প্রকার বরফ বা তুষার জমে না। কংক্রিট বা টাইলস কে পিছনে রেখে সাতক্ষীরার মাটির তৈরি টালি বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে ছিল। সমৃদ্ধ করেছিল দেশের অর্থনীতিকে।
দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ও শিল্প কে তুলে ধরেছিল বিশ্ব দরবারে। এখানকার টালি কারখানা থেকে যেত টালি আর আসছে ডলার-ইউরো। মাটি কারিগরদের মেধা ও শ্রমে গড়ে ওঠা টালির ঠাঁই মিলেছিল দেশের রফতানিযোগ্য পণ্য তালিকায়। আর এলাকাটিও পরিচিতি পেয়েছিল ইতালি নগর নামে।সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি, শ্রীপতিপুর ও মির্জাপুর এ তিন টি গ্রাম টালি শিল্প পল্লী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তিনটি গ্রামে টালি কারখানা ছিল প্রায় ৪৫টি। যুগ যুগান্তর ধরে পাল বংশের শিল্পীরা আপন হাতের সুনিপুন ষ্পর্শে গড়েছেন মাটির তৈরি নানা জিনিস। মাটির কারিগররা গড়ে তুলেছে বাহারি টালির এক সাম্রাজ্য।২০০০ সালের পর থেকে মাটির তৈরি টালি বিদেশে রপ্তানী হতে থাকে। প্রথমে টালি ইটালির বাজার দখল করে। পরে তা বিস্তৃত হয়ে নেদারল্যন্ড, দুবাই, স্পেন, আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশের বাজারে ক্রেতা সৃষ্টি করেছে। এসব টালি মংলা বন্দর দিয়ে দুবাই ও ইউরোপে রপ্তানী করা হয়। দুবাই থেকে আবার কিছু টালি প্রসেসিং হয়ে আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যায়।
কলারোয়ার অঘোষিত এই ইতালি নগর যেন এক রাঙ্গা ধুলোর জনপদ। প্রতিদিন শত শত শ্রমিকের শ্রমের বিনিময়ে এখানে তৈরি হয় এক একটি টালি। আমাদের এই কারিগরদের হাতে গড়া টালি চলে যায় সভ্যতা, তথ্য, প্রযুক্তি ও সম্পদে ভরা উন্নত দেশ ইতালিতে। সেখানে রয়েছে টালির শোরুম।ইতালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এদেশের মাটি দিয়ে গড়া এই টালি মেঝেতে, ছাদে, দেয়ালে টাইলস হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রফতানি করা এই টালি ইতালিয়ানদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যামিক্যাল সংমিশ্রণে এর রূপ বদলে করা হয় টাইলস ও শোপিসে। যা সৌন্দর্য প্রিয় ইউরোপীয়দের বিভিন্ন ভবন ও স্থাপনার কারুকার্যের ব্যবহার হয়। আর আমাদের দেশের কারিগরদের উজ্জীবিত করত বেশি বেশি টালি উৎপাদন ও রপ্তানিতে। কিন্তু বর্তমানে একদিকে টালি রপ্তানি কমে যাওয়ায় উৎপাদও কম হচ্ছে ফলে বিপাকে পড়েছেন টালি শিল্পের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া এলাকার কারখানা মালিকরা ঐক্যবদ্ধ নয়, ফলে একেক মালিকের একক মূল্য। মহাজনরা বাকীতে টালি কিনে সময়মত বিল শোধ করে না। যে টালি ইটালি থেকে অন্য দেশে সরবরাহ করা হত এটি যে বাংলাদেশের টালি তা বলা হতনা এমন কি বিদেশি ক্রেতাদের সরাসরি এ দেশে আনা হত না ।৪৫টি টালিকারখানা থেকে প্রতি মাসে এখান ৪০ থেকে ৫০ ট্রাক টালি বিদেশে যেত। আর তাদের ৫ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করে ভাল ভাবে সংসার চালিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়া লেখার খরচ ও চালাত। এখন কারখানা বন্ধ হয়ে ১৫টি চালু আছে আর তা হতে বছরে ১০ ট্রাকও টালি রপ্তানি করাযায় না। অনেক টালি কারখানার মালিক শ্রমিকের কাজ করছে বেকার হয়ে পড়েছে হাজার ও শ্রমিক তাদের এখন সংসার ঠিকমত চলে না। সরকারি সাহায্য সহযোগিতা ও পৃষ্টপোষকতা পেলে এ শিল্প থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা আয় করে দেশের অর্থনীতির বিকাশ ঘটাতে পারবে। দারিদ্র্য বিমোচনে এ শিল্প উন্মোচন করতে পারে সম্ভাবনার নব দিগন্ত।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।