সকল মেনু

ফুল পরীর জন্ম কথা

poriসৈয়দা ইসাবেলা :

বহু বছর আগে এমন সময় ছিল যখন পরিদের জন্ম  হয়নি। প্রকৃতি মার কাজে সাহায্য করার মতো একজন ছিল না। সব কর্তব্য তাকে একাই পালন করতে হতো। বৃদ্ধ প্রকৃতি মাকে এখন যেমন দেখায় তখন তিনি তেমন ছিল ন। তখন ছিলেন অসহায় নিঃসঙ্গ একজন যুবতিজ করতে করতে কখন সময় পার হয়ে যেত তিনি বুঝতেও পারতেন না। ক্লান্ত অবসন্ন দেহে এক সময়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন। এখন পরীরা বৃদ্ধ প্রকৃতি  মাকে সব কাজেই সাহায্য করছে। ভোর রাতে ধানের শীষে ঘসের ডগায় শিশির বিন্দু ফেলে দেয়। প্রথম সূর্য রশ্নি  এগুলোর উপর পড়ে জ্বলজ্বল হিরক হিরক কণার মতো দেখায়।

হেমন্তকালে গাছের পাতা গুলো ঝরিয়ে দেয়। সমস্ত বনভূমি ছেয়ে থাকে। রাত পোহালে বনের ময়ূর , দোয়েল , শ্যামা , চড়ুই , ফিঙ্গের দল পাতার উপর দিয়ে নেরাথাকে। প্রকৃতি আমোদিত হয়। রাতে পরীরা ফুলের বুকে ঘুমিয়ে থাকে। রাত পোহালে ফুলদের ঘুম ভাঙায়। ছোট ছোট ঘাস ফুল গুলো উপত্যকা বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমায় ।পরীরা আদর করে তাদের ঘুম ভাঙায় । ফুটতে সাহায্য করে। তবে একথা ঠিক ফুলদের সাথে পরীদের সখ্য থাকলেও তারা কাঁকড়া , বিছে আর মাকড়সাদের ঘৃণা করে। কারণ ওরা সর্বদা ফুলদের অনিষ্ট করে। পরীদের ভয়ে ওরাও দিনের আলো ফুটবার আগেই গর্তে ডুকে পড়ে। পরীদের কাছে ফলেরাই সবচেয়ে আপনজন। একটি ফুলের কলি ফুটবার সাথে সাথেই পরীরা নিজের নামে নামকরণ করে। আনন্দে নাচ গান করে। কিন্তু কেন তারা ফুলদের ভালোবাসে জেনেও? কারণ হলও ফুলের বুকেই তাদের জন্ম। সে কারণ তারা ফুলের বুকে  ঘুমিয়ে থাকতে ভালোবাসে।

পৃথিবী সৃষ্টির পর মা প্রকৃতি যখন তার দায়িত্ব পেলেন , তিনি তার কর্তব্যকর্ম বুঝে নিয়ে সজাগ হলেন। তিনি স্থির করলেন তার প্রথম কাজ হলো এই পৃথিবীর বুকে যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে তাদের প্রত্যেককে তাদের কর্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া। যাতে তারা নিজের নিজের কাজ সময়মতো সম্পন্ন করে বিশ্বকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে। প্রকৃতি মা ফুল গুলোকে শিক্ষা দিলেন সুন্দরভাবে ফুটে সুগন্ধ  বিলাতে। বৃক্ষরাজি জানল ডালপালা ছড়িয়ে সোজা হয়ে উপরে উঠতে হবে। যাতে পাখিরা তাদের শাখায় নিজেদের নীর গুলো বাঁধতে পারে। প্রাণীকুল বৃক্ষের শীতল ছায়ায় বিশ্রাম নিতে পারে। সুমিষ্ট ফল রাশি খেয়ে পাখি ও  প্রাণীকুল খুধা নিবৃত করতে পারে।

তিনি পাখিদের উড়তে শেখালেন। তারা তাদের সন্তানদের উড়তে শিখাল। নীড়  বাঁধতে শিক্ষা দিলেন। কেমন করে দিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটাতে হয় তাও বুঝালেন।

তিনি খরগোস , পিপিলিকা, ইঁদুরদের মাটির নিচে বাসা গড়তে শেখালেন।

নিজেদের রক্ষা করার জন্য কি করতে হবে তাও শেখালেন। তার স্নেহ র্পূণ স্পর্শে  এক সময়ে সবাই সব শিখে ফেলল।

কঠোর পরিশ্রম করে তিনি পৃথিবিকে ফুলে ফুলে আনন্দে –ঘ্রাণে সুশোভিত করলেন।

নদী , পাহাড় , পর্বত , উপত্যকায় ফসলের মাঠে অরণো খুশীর বন্যা বয়ে গেল।

প্রকৃতি মা নিজের কর্মফল দেখে আনন্দ পেলেন। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন। কিন্তু শিগগিরই পৃথিবীর বুকে পরিবর্তন দেখা গেল। মানব জাতির আগমন ঘটল।

তারা পৃথিবীর বুক লাগল দিয়ে চিড়ে ফেলতে লাগল। ফসল বুনতে লাগল।

উপত্যকার ফুলের ঝাড়গুলোকে জঙ্গল বলে উপড়ে ফেলতে লাগল। তারা শুধু নিজেদের ও তাদের গৃহপালিত পশুদের নিয়ে ব্যস্ত রইল। প্রকৃতি মার মর্মবেদনার কথা একবারও ভেবে দেখল না। প্রকৃতির বুকে যে আরো সন্তান রয়েছে সেটাও খেয়াল করল না। গাছগুলো কেটে উজাড় করে ফেলল। গ্রামের পর শহর গড়ার কাজে ব্যস্ত হলো। জ্বালানির ধূম্রে আকাশ-বাতাস কলুষিত হলো। তাদের দালানকোঠা, ব্রিজ, কালভাট তৈরি করতে গিয়ে পৃথিবীর বুক ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল। প্রকৃতি মা তার সাধের পৃথিবীর অবস্থা দেখে বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। হায় রে কত কষ্ট করে তিনি এই উপত্যকা বনভূমি সাজিয়েছিলেন। পাখিদের কলতান, বানরের বৃক্ষের ডালে দোল খাওয়া, বৃষ্টির শব্দের সাথে ময়ূরের পেখম তুলে নৃত্য। সব হারিয়ে গেল ।নিষ্ঠুর মানুষ গুলো সভ্যতযাবে মে নিজেদের স্বার্থে তার হৃদয়কে ছিন্নভিন্ন করে ফেলল।প্রকৃতি মা এসব দেখে আর সহ্য করতে পারছিলেন না। গভীর অরণে গাছের তলায় বসে কাঁদতে লাগলেন। মানুষের সুবুদ্ধির জন্য ঈশ্বরের দরবারে ফরিয়াদ জানাতে লাগলেন। এক সময় বিলাপ করে সুর করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হে ঈশ্বর। কি উপায়ে এদের রোধ করব আমি। তুমি সাহায্য না করলে প্রকৃতির এই অসহায় জীবগুলো কোথায় যাবে। নদীর পানি আবর্জনা ফেলে দূষিত করছে। মাছগুলো মরে যাছে। পাখিগুলোর বাসা বাঁধার জায়গা নেই। ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো সব মরে যাছে। ফুল ফুটছে না। পাখি গান গাইছে না। হায় আমি কত অসহায় কিছুই করতে পারছি না। হে ঈশ্বর রক্ষা করো। আমার সাজানো বাগান বিরান হয়ে গেল।

প্রকৃতি মা যেখানে বসে কাঁদছিলেন পাশেই ঘাসের মধ্যে ছোট একটি ফুল ফুটে ছিল।কান্না দেখে তার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। তার মনে পড়ল গত বছর ঝড়ের সময় একটা গাছের ডাল বেঙে ওদের ওপর পড়েছিল। ডালের পাতায় এমনভাবে তারা ঢেকে গিয়েছিল যে নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। দম আটকে মরে যাবার অবস্থা হয়েছিল। ওদের গোঙানি শুনে প্রকৃতি মা ঝড়কে দিয়েই সব পাতা ঊড়ীয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তার ইচ্ছাতেই বৃষ্টি হলো। সূর্যের কিরণে আবার তারা জীবন ফিরে পেল। মাতা প্রকৃতি সেদিন সদয় না হলে তারা কখনো বাঁচতে পারত না।

ছোট ফুল কলিটি সে কথা আজও মনে রেখেছে। সে কান্না সহ্য করতে পারল না। নিজেও কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ শুরু করল,হায় আমি ছোট ফুল কলি না হতাম, নাড়াচাড়া করতে পারতাম। এই দুঃসময়ে মার পাশে দাঁড়াতে পারতাম। কৃতঞতা প্রকাশ করব সে ক্ষমতাও আমার নেই।

ঠিক এই সময়ে সন্ধ্যা আকাশের বুকে একটা নক্ষত্র খসে পড়ল। খসে পড়া নক্ষত্রের ধূম্র সম্পুণ বনভূমিতে ছড়িয়ে পড়ল। তারই এক কণা ছোট ফুলটির বুকে ঢুকে গেল। ফুল কলিটি তার মধ্যে আশ্চর্য রকমের পরিবতন টের পেল। একটা প্রচন্ত ইচ্ছা তার মধ্যে জন্ম নিল। ছোট ফুল কলি ঈশ্বরের কাছে প্রকৃতি মাতাকে সাহায্য করবার শক্তি কামনা করল।

ধীরে ধীরে তার পাপড়িগুলো খুলে যেতে ফুল কলিটি তার ভিতরে নতুন কিছুর জন্মের আভাস পেল। হলুদ ফ্রক পরা একটা ছোট মেয়ের মুখ উঁকি দিল। তার মাথায় সবুজ পাথর বসানো সোনার মুকুট। একটা প্রজাপতি উড়ে এসে তার পিঠে বসল। সেটা ডানা হয়ে গেল। পরীটির সারা সরির হীরের কুচির মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল।

কোনো শব্দ না করে জন্ম নেওয়া প্রথম মেয়েটি প্রকৃতি মার কাঁধের ওপর উড়ে গিয়ে বসল। মেয়ে মাকে আদর করে তার অশ্রুসিক্ত গালে চুমু খেয়ে বলল , কেঁদো না মা, আমি এসে গেছি। এবার তোমার সব দুঃখের অবসান হবে। আমি আবার সব ফিরিয়ে আনব।

তার  কণ্ঠস্বর এতোই মধুর যে প্রকৃতি মা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি ফুল কলিটির দিকে তাকিয়ে ভাবলেন পৃথিবীতে এত কিছু সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এর মতো সুন্দর আর একটাও নয়। তিনি ঠিক করলেন এই অসামান্য সুন্দরীকে তিনি পরী বলে ডাকবেন। তিনি আদর করে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

ছোট ফুল পরী বলল, মা আমার মনে হয় আমাকে দেখার পর সব ফুলেরাই একটা করে পরী জন্ম দেবে।

তার কথাই ঠিক হলো। অচিরেই বন ভূমিতে যত গোলাপ,  গন্ধরাজ , জুঁই ছিল সবাই পরীর রূপ ধরে প্রকৃতি মাতার কাছে উড়ে এলো। ওরা মাতার চারিদিকে উড়ে উড়ে গান গাইতে লাগল। এদের দেখাদেখি বনভূমিতে যত ফুল ছিল সবার মধ্যে পরীর জন্ম হলো। সমস্ত বনভূমি বিচিত্র বর্ণে বর্ণিল হয়ে উঠল । তারা প্রকৃতি মাতার সাথে সুর মিলিয়ে ঈশ্বরের বন্দনা করতে লাগল।

টগর পরী সবার প্রতিনিধি হয়ে এসে প্রকৃতি মার কাছে হাত জোড় করে দাঁড়াল, মা বলো, কি করলে তুমি খুশি হবে? তোমাকে সুখী করার জন্যই ঈশ্বরের ঈচ্ছায় আমরা জন্মেছি। বলো মা।

জ্ঞানী প্রকৃতি মাতা উত্তর দিলেন, বাছা তোমাদের আগমন শুভ হোক।  এই ম্লান পৃথিবীকে আবার হাসি-আনন্দে ভরিয়ে তুলবে এই প্রত্যাশা করি। পরী বন চাঁপা বলল, কোথা থেকে শুরু করা দরকার বলে দাও মা।

মা প্রকৃতি উত্তর করলেন,শোণো মা সকল,এখন আমি বুড়ো হয়েছি। আমার পক্ষে ছুটোছুটি করে সব কাজ দেখাও সম্ভব নয় । স্বর্ণ পরী মা তুমি শস্য ক্ষেতে যাও সেখানে খরগোস আর ইঁদুর গুলো মানুষের ভয়ে সিটিয়ে রয়েছে। তোমার পাকা শসের ওপর উড়ে উড়ে পাহারা দাও। যাতে ওরা নিভয়ে শস্য খুঁটে খেতে পারে।

পপি পরীকে বললেন, যাও তো মা, দেখো গে পাখিগুলো ডিমে ওম দিচ্ছে। মানুষের ভয়ে আহার সংগ্রহ করতে যেতে পারছে না। তুমি বলো আছো ওদের পাশে। কোলো চিন্তা না করে খাবার সংগ্রহ করে আনুক। অশোক, শিমুল, বকুল সবাইকে কাজে পাঠিয়ে অনেক দিন পরে আজ প্রকৃতি মা গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়লেন।

বৃষ্টির শব্দে মার ঘুম ভেঙ্গে। দেখলেন আকাশ ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে।

বনের ময়ূর- ময়ূরী,পশু পাখিদের সাথে পরীরাও নৃত্য করছে। তিনি খুশি মনে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। ঈশ্বরকে আবারও ধন্যবাদ দিলেন।

সেই থেকে ছোট ফুল পরীটি প্রকৃতি মার পাশেই থাকে। সর্বদা তাকে বুদ্ধি দিয়ে সাহায্য করে। ধীরে ধীরে প্রকৃতি তার হারানো শ্রী ফিরে পেতে লাগল। আবার গাছে গাছে পাখির কূজন, ময়ূরের নৃত্য, ভ্রমরের গুঞ্জন শোনা যেতে লাগল। ঘোড়োর ছুটে চলা, হরিণের লাফালাফিতে প্রকৃতি আবার সতেজ হয়ে উঠল।  ঈশ্বরের ইচ্ছায় পরীরা প্রজাপতির আকার ধারণ করল । কিন্তু ফুলদের সাথে পরীদের আত্মার সম্পর্ক অটুট রইল।

প্রকৃতির স্নিগ্ধ সংস্পর্শে এসে নিষ্ঠুর মানুষগুলোও বদলে গেল। পরীদের সৌন্দর্যের মুগ্ধ হয়ে এই প্রথম মানবজাতি প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। এখন থেকে মানুষ প্রকৃতি ধ্বংস না  করে তার শ্রী বৃদ্ধিতে মনোযোগী হল।

তবে সেই ছোটো ফুলকলিটির কথা ভুললে চলবে না। এখনো লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে যত্রতত্র ঘাসের মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট ফুল ফুটে  রয়েছে। কারন কি জান?কারন তারা সর্বদা প্রকৃতি মার বুকের কাছেই থাকতে চায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top