সকল মেনু

বিএনপির দল পুনর্গঠনেও বিপত্তি

 রাহিমা জামান : নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগাম নির্বাচনের দাবিতে ভবিষ্যৎ সরকারবিরোধী আন্দোলনের আগে দলকে সাংগঠনিক মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করানো প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছেন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ইতিমধ্যে শ্রমিক দল ও ঢাকা মহানগরের পর সদ্য ঘোষণা করা হয়েছে ছাত্রদলের নতুন কমিটি। তবে যে উদ্দেশ্য নিয়ে পুনর্গঠন-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তার বিপরীত ক্রিয়া দেখা গেছে। এর ফলে সংগঠনগুলোতে ঐক্যের পরিবর্তে বিভেদ আর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ব্যাপকভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে পাল্টা কমিটি গঠনের পাশাপাশি নতুন কমিটির বিপক্ষে নামছেন বিদ্রোহীরা। এ অবস্থায় দল গোছানো নিয়েও বিপত্তিতে পড়েছে বিএনপি। দলীয় সূত্রগুলো বলছে, অঙ্গসংগঠনগুলোর ত্যাগী, পরীক্ষিত আর নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্বের ব্যাপারে বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে সুস্পষ্ট তথ্য দেওয়া হচ্ছে না। কমিটিগুলোর নতুন নেতৃত্ব আনার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা ওইসব বিষয় মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা না করে নিজেদের পছন্দের পকেট কমিটি দিচ্ছেন। এর ফলে বিদ্রোহ দেখা দিচ্ছে। যাদের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে তাদের তুলনায় পদবঞ্চিতরাই সাংগঠনিভাবে বেশি শক্তিশালী থাকছেন। এসব বিষয় ভবিষ্যৎ সরকারবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা।

ক্ষোভের আগুনে ছাত্রদল
মঙ্গলবার রাতে রাজিব আহসানকে সভাপতি এবং মো. আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের ২০১ সদস্যবিশিষ্ট নতুন কমিটি ঘোষণার পরপরই বিক্ষোভ দেখান পদবঞ্চিতরা। বুধবার নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। দুই জায়গায়ই বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। শুক্রবার দুপুরেও নয়াপল্টনের সামনে পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী নতুন কমিটি প্রত্যাখ্যান করে মিছিল করেছেন।

বিদ্রোহীদের অভিযোগ, নতুন কমিটিতে যারা নেতৃত্বে রয়েছেন তারা বিতর্কিত। ১/১১-এর সংকটকালীন এরা ছিলেন নিষ্ক্রিয়। ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ছাত্রদলে নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে পকেট কমিটি করেছে। তা ছাড়া এই নেতৃত্ব দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, দক্ষ ও পরীক্ষিত নয় বলেও মন্তব্য তাদের। সদ্য ঘোষিত কমিটিকে কাজ করতে দেবেন না বলেও জানান বিদ্রোহীরা। এ অবস্থায় যেকোনো সময়ে সংগঠনে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

নতুন কমিটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এমন একজন সাবেক কমিটির সহসভাপতি আবু সাঈদ। তিনি বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতির তীর্থস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল রাজনীতি করতে পারে না। ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ অচলাবস্থা দূর করতে একটি কার্যকর কমিটি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা না করে অর্থের বিনিময়ে নিজেদের পকেট কমিটি দিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। এ কমিটি আমরা মানি না, মানব না।’

এদিকে দীর্ঘ এক যুগ পর সম্প্রতি সিলেট জেলা ও মহানগর কমিটি ঘোষণার পর বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে সেখানকার ছাত্রদলে। পদবঞ্চিতরা নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। ঘটেছে ককটেলের বিস্ফোরণও। এ অবস্থায় ঘোষিত কমিটি বাতিল করা না হলে যেকোনো মুহূর্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন অনেকে। এভাবে বিভিন্ন এলাকায় ছাত্রদলের কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে সংঘর্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বহু বিভক্ত শ্রমিক দল
২৭ এপ্রিল আনোয়ার হোসেনকে সভাপতি এবং নুরুল ইসলাম নাসিমকে সাধারণ সম্পাদক করে শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হলেও সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ বিভেদ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই দেখা দেয় কোন্দল। বিদ্রোহীরা খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে বিক্ষোভ করেন। তার পরও কোনো আশ্বাস না পেয়ে কয়েক মাস আগে গঠিত শ্রমিক দলের কমিটিকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর পাল্টা কমিটি ঘোষণা করেন বিএনপির এই সহযোগী সংগঠনের বিদ্রোহী নেতা-কর্মীরা। জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সংবাদ সম্মেলন করে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়।

এ এম নাজিম উদ্দিনকে সভাপতি ও আবুল খায়ের খাজাকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩৫ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, গত ৭ জুন সংগঠনের বিশেষ সম্মেলন ও কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে এই কমিটি করা হয়েছে। এ নিয়ে শ্রমিক দল বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

বিভেদে ব্যর্থতার পথে ঢাকা মহানগর
সাদেক হোসেন খোকা-আবদুস সালাম কমিটিকে ব্যর্থ আখ্যা দিয়ে গত ১৯ জুলাই ঢাকা মহানগর বিএনপিতে মির্জা আব্বাস ও হাবিব উন নবী খান সোহেলকে আনলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর অগ্রগতি হয়নি। ঢাকা মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনে ২ মাসের সময় দেওয়া হলেও কার্যকর কেনো অগ্রগতি নেই। কমিটি ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল। কয়েক দিন পর তা প্রকাশ্যে রূপ নেয়। কিছুতেই সোহেলকে মেনে নিতে পারছেন না আব্বাস। তাদের কোন্দল নিরসনে খালেদা জিয়া হস্তক্ষেপও করেন। এখন প্রকাশ্যে না হলেও মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলছে। কোন্দলের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মহানগর কমিটির পুনর্গঠন। কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও এখনো সম্পন্ন হয়নি ওয়ার্ড ও থানা কমিটি পুনর্গঠনের কাজ।

এরই মধ্যে মহানগরের বিভিন্ন এলাকায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। বুধবার রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার ডুমনিতে মহানগর বিএনপির ওয়ার্ড কমিটির কর্মিসভায় যোগ দিতে যাওয়ার সময়ে বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব আবু সাঈদ খান খোকনের গাড়িবহরে হামলা করেন। এ সময় তারা আবু সাঈদ খানকে ধাওয়া করেন। তিনি পালিয়ে গেলেও তার বহনকারী গাড়িটি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

তবে নেতা-কর্মীদের দাবি, মূলত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে টার্গেট করেই এই হামলা চালানো হয়। সৌভাগ্যক্রমে তিনি ওই গাড়িতে না থানায় প্রাণে রক্ষা পান। এর আগে কমিটি পুনর্গঠন করতে গিয়ে সবুজবাগে তোপের মুখে পড়েন মহানগর যুগ্ম-আহ্বায়ক সালাহউদ্দিন আহমেদ। ওই সময়ে চেয়ার-টেবিল ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়ছে মহানগরেও।

যুব দলের নীরব অসন্তোষ
হচ্ছে-হবে করে বিএনপির অন্যতম অঙ্গসংগঠন যুবদলের কমিটি না হওয়ায় অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে সংগঠনটিতে। কমিটি গঠনের আগেই সেই অসন্তোষ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। শিগগিরই যুবদলের নতুন কমিটি ঘোষণা হবে। আর তাতে সংগঠনের মধ্য থেকেই নেতৃত্ব সৃষ্টির দাবি জানাচ্ছে বড় একটি অংশ। তাদের মতে, যুবদলের বাইরে থেকে কাউকে এনে সংগঠনের নেতৃত্ব দিলে তাতে হিতে বিপরীত হবে।

যুবদলের মধ্য থেকেই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নির্বাচন করার জন্য গত ৭ আগস্ট নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে প্রায় দেড় হাজার নেতা-কর্মী অবস্থান নেন। এ সময় যুবদলের আসন্ন নতুন কমিটিতে বর্তমান কমিটির মধ্য থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার দাবিতে স্লোগান দেন তারা। এক পর্যায়ে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা সৈয়দ আবেদিন প্রিন্স, সোহেল আহমেদ, আহসান উল্লাহ, মঈনুল ইসলাম, সেলিম রেজা, রাসেল মিয়া, বাবলুর নেতৃত্বে দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে দেখা করে তাদের দাবি জানান। মির্জা আলমগীর তাদের কথা গুরুত্ব সহকারে শোনেন এবং বিএনপির চেয়ারপারসনের কাছে তা তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দেন।

দলে বিভেদ আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কথা স্বীকার করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিএনপি অনেক বড় একটি দল। এখানে সংগঠনগুলোর মধ্যে কিছুটা বিভেদ থাকবেই। নেতৃত্বের প্রশ্নে সেই বিভদে কিছুটা প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। প্রতিটি গণতান্ত্রিক দলের মধ্যে এ সমস্যা কম-বেশি আছে। তবে এ ঘটনাকে বড় করে দেখার উপায় নেই। এ অবস্থা উত্তরণে দল চেষ্টা করছে।’

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top