সকল মেনু

প্রেম গাঢ় হয় বর্ষায় নয়, শরতে

 হাসান আজিজুল হক: আমি এখন একরকম প্রায় গ্রামেই থাকি। কাজেই বাংলার ছয়টি ঋতু আমার কাছে এখনো একাকার হয়ে যায়নি। যদিও ওই ছয়টি ঋতুর ভেতরে এমনিতেই অনেক রকমের গোলমাল হয়ে গেছে। আমাদের ছোটবেলার ঋতুগুলো যেমন ছিল- একদম পরিষ্কারভাবে বোঝা যেত ঋতুর পালাবদল। কবে যে শীত শেষ হলো, সেটা বসন্ত শুরু হলেই বোঝা যেত- আমগাছে বোল আসত, গাছের পাতারা ঝরে ঝরে পড়ত; গ্রামবাংলায় এখনো এগুলো আছে। যারা শহরে থাকেন, বিশেষ করে এই অসহ্য ঢাকা শহরে যারা থাকেন, তাদের কাছে কিন্তু এই ছয়টি ঋতু অস্পষ্ট হয়ে গেছে। এই যে শরতের আকাশ- নির্মল নীল আকাশ, বিশাল বিশাল অট্টালিকার কারণে তারা দেখতে পান না। সৌভাগ্য এই যে, আমি কিন্তু আকাশ দেখতে পাই। এই ফাঁকে বলেও রাখি, আকাশ দেখা কিন্তু আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজের মধ্যে একটি। পরিষ্কার আকাশ, মেঘলা আকাশ, রাতের আকাশ- এই আকাশের যে কত রূপ। আকাশ পরিষ্কার থাকলে রাতের তারাগুলো খুব স্পষ্ট হয় না। এমনকি চাঁদ উঠলেও নয়। এ জন্য অন্ধকার আকাশ আমার ভালো লাগে। মেঘলা আকাশও ভালো লাগে। চারপাশ মেঘে ঢেকে গেছে- বৈশাখ মাসে ঈশান কোণ থেকে একদল মেঘ এসে মুহূর্তের মধ্যেই পুরো আকাশ ছেয়ে ফেলল, প্রবল বেগে বাতাস বইতে শুরু করল; হঠাৎ শুরু হলো ঝড়! প্রকৃতির এও এক রূপ বটে।

গ্রীষ্ম আমার প্রিয় ঋতু নয়, যদিও এই গরমেও আমি ফ্যান না চালিয়ে দিব্যি কাজ করে যেতে পারি। এটা দেখে আমার বন্ধুরা খুব অবাক হয়ে জানতে চায়- এটা কী করে সম্ভব? সম্ভব এ কারণে যে, আমার জন্ম রাঢ়বঙ্গে। রাঢ়বঙ্গ বীরভূম এলাকা। ওদিকটাতেই তো বোলপুর, শান্তিনিকেতন। সে সময় তো আর এতকিছু ছিল না, রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিলের পাশে হাত পাখা পড়ে থাকত। চেয়ারে বসে লিখতেন। কিন্তু ওই হাতপাখা তিনি ব্যবহার করতেন না। তাই আর কিছু না পারি, অন্তত এটুকু বলতে পারি যে, গরম আমাকে খুব কাবু করতে পারে না।

এরপর বর্ষা। বর্ষা আমার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেখছি এ সময় যথেষ্ট বর্ষণ হচ্ছে না। আগে ছোটবেলায় দেখেছি একটানা সাত-আট দিন বৃষ্টি হতো। পথ-ঘাট সব ভেসে যেত। রাঢ়ের মাঠ যেগুলো শুকনো খটখট করত, সেগুলো ডুবে যেত। আমি যখন রাজশাহী এলাম, তখনো কিন্তু এমন বর্ষা দেখেছি। কিন্তু এখন আর তেমনটা দেখি না। কোথায় গেল রাতের সেই একটানা বৃষ্টি!

আমার প্রিয় ঋতু বসন্ত- সবাই অবশ্য এমনই বলে। আমিও এর সঙ্গে একমত। বসন্তকে ভালো না বেসে পারা যায় না। কিন্তু এর বাইরেও আরেকটি প্রিয় ঋতু শরৎ। শরৎকালের কিছু অদ্ভুত ব্যাপার আছে। তাই বসন্ত বা হেমন্তের চেয়ে শরৎ একেবারেই আলাদা। শরতে কিছু ফুল ফোটে, যা অন্য সময় ফোটে না। এই ফুলগুলো যে বাংলার শোভা, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার বাড়ির সামনে শিউলি গাছ রয়েছে। এ সময় গাছটি যে কী পরিমাণ ফুল ফোটাবে, তা কল্পনা করা যাবে না। শিউলি রাতে ফোটে। সকালে ঝরতে শুরু করে। ‘হে ক্ষণিকের অতিথি এলে প্রভাতে কারে ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া’- রবীন্দ্রনাথের এমন অনেক গান আছে শরৎ নিয়ে। গানগুলো ঘর বন্ধ করে শুনলেও মনে হয় শরৎ এসে গেছে।

শরতের বড় বৈশিষ্ট্য হলো আকাশ। শরতের আকাশের মতো এত সুন্দর আকাশ আর নেই। বসন্তের আকাশও কিন্তু এতটা সাদা নয়, এমনকি মেঘ সরে গেলে বর্ষার আকাশও ভালো দেখায় কিন্তু তা শরতের আকাশের মতো নয়। একমাত্র শরতের মেঘই যেন আকাশজুড়ে থাকে। এই যে মেঘের ধরন, তা আমি আজ পর্যন্ত কোনো শিল্পীর আঁকাতেও পাইনি। শরতের এমন নীল আকাশ বছরের অন্য কোনো ঋতুতে দেখা যায় না। আর সকালের রোদ সে তো কচি কলাপাতার মতো। জীবনানন্দ দাশের কবিতাতেও কিন্তু এ সময়ের আকাশের রঙের কথা আছে। এই সময়ের আবহাওয়াটাও চমৎকার। তাই আমার মনে হয়, মানুষের প্রেম সবচেয়ে গাঢ় হয় বর্ষায় নয়— এই শরতে। এ সময় আকাশ যদি মুক্ত থাকে, আর যদি চাঁদ ওঠে, সেই চাঁদের আলোয় সব ভেসে যায়। এই আলো এতটাই স্বচ্ছ যে বই পড়া যায়। একসময় আমি পড়েছি।

শরতের আরেকটি দিক দুর্গাপূজা। এটা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান উৎসব। এর পেছনে যে আইডিয়া, সেটা সর্বজনীন। আইডিয়াটা কী? এখন অবশ্য ওসব আর দেখা যায় না, কিন্তু আগে ছিল। যেমন মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছে, সে তো আর চাইলেই যখন-তখন বাপের বাড়ি আসতে পারবে না। মেয়ে আসত শরতে দুর্গাপূজার সময়। বছর ধরে গ্রামের বধূরা অপেক্ষা করত এই সময়ের। যত দূর মনে পড়ে আমাদের গ্রামে তিনটি পূজা হতো। কী আনন্দ যে লাগত! বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতাম। এক মাস আগেই কুমার আসত। তার গুরুত্ব দেখতাম। খড় দিয়ে কাঠামোতে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হতো। তারপর মাটির প্রলেপ- একবার, দুবার এভাবে বেশ কয়েকবার চলত। প্রতিমার ওই অপূর্ব মুখশ্রী ওরা কীভাবে তৈরি করত, এখনো ভেবে অবাক হই। আজকাল কেমন যেন হয়ে গেছে। তেমনটা আর দেখি না। মাঝখানে তো দেখলাম বড় বড় স্টারদের আদলে প্রতিমার মুখ তৈরি হতো। যেমন সুচিত্রা সেন। মায়ের মুখশ্রী ওরা কীভাবে যে ফুটিয়ে তুলত, কল্পনাও করা যায় না। দুর্গার মূর্তিটা খুব চেনা কিন্তু এই মূর্তিটাই কীভাবে তৈরি হতো, সেটাই ছিল দেখার বিষয়। চুন, মাটি দিয়ে রং করা। একের পর এক রঙের প্রলেপ দিতে দিতে হলুদ একটা আভা ফুটে উঠত। তারপর খুব যত্ন করে একদিন সকালে ঠাকুরের চক্ষুদান করা হতো। অর্থাৎ চোখ দুটি আঁকা হতো- আকর্ণবিস্তীর্ণ চোখ। বিশালনয়না তিনি। তার দৃষ্টির মধ্যেই ফুটে উঠত অনুকম্পা আর দয়া।

শরতের একেক রূপ, একেক পর্ব। ছেলেবেলায় এ সময় মাঠে যেতাম, দেখতাম ধানের মধ্যে রস জমতে শুরু করেছে সাদা দুধের মতো, ওটা জমে চাল হবে। তারপর ধীরে ধীরে সোনালি রং ধারণ করবে। এই দৃশ্য দেখতে মাঠে ছুটে যেতাম। সন্ধ্যাবেলা একটু শিশির পড়ত। বিকেলে খেলার পর বন্ধুদের নিয়ে মাঠে বসে অন্তত ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিতাম। আমার প্রথম গল্প কিন্তু এটা নিয়েই লেখা। অনেক সময় স্কুলের পাকা সিঁড়িতে বসে থাকতাম। একসময় দেখতাম শিশিরে মাথার চুল ভিজে গেছে। এটাও এই শরতেরই আরেক রূপ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top