সকল মেনু

দখলকৃত ফ্রান্সের আত্মা থেকে উঠে আসেন প্যাত্রিক মোদিয়ানো | প্যাত্রিক ম্যাকগিনেস

 অনুবাদ; এন জি সাহা: ‘ফ্রান্সের সমকালীন সেরা লেখকদের অন্যতম প্যাত্রিক মোদিয়ানো। তাদের মধ্যে মোদিয়ানোই এমন একধরনের ইতিহাস লিখেছেন যা ইতিহাসলেখকরা এখনো বলতে পারেননি।’ আমার এই মন্তব্যের মধ্যেও মোদিয়ানোর প্রতি এক ধরনের পুরস্কারের উপাদান নিহিত আছে। মোদিয়ানোর মধ্যে প্রবেশ করার জন্য নোবেল কমিটির বিচারকদের জন্য এটি একটি উপাদানও নিশ্চয়ই। সেইসঙ্গে একজন ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক ও স্ক্রিপ্টরাইটার হিসেবে মোদিয়ানোর সাহিত্যিক স্তর নির্ধারণে বিপদের জায়াগাও আছে। মোদিয়ানো এক সময় চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লিখতেন। গানও লিখেছেন প্রচুর। ১৯৬৮ সালে তার লেখা লিরিক নিয়ে বের হয় ‘এতোনেজ-মোই বেনোইট’ নামের গানের অ্যালবাম। সে সময় এটি ব্যাপক সাড়া জাগায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ফ্যান্সকে দখল করে নেয়। সে সময় (অকুপেশন) দখলকৃত ফ্রান্সের পরিস্থিতি নিয়ে ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক লুইস মালে নির্মাণ করেন ‘লাকমবে লুসেইন’ নামের এক আলোচিত চলচ্চিত্র। এই সিনেমার কো-রাইটার ছিলেন মোদিয়ানো। মোদিয়ানোর রচিত সাহিত্যকর্মের বেশির ভাগ এলাকা জুড়ে রয়েছে অন্যরকম এক ইতিহাস। তার ফিকশন বর্ণনায়, উপন্যাসের কথকথায় সেইসব ইতিহাসের নিবিড় জল বয়ে গেছে নীরবে এবং অদ্ভুত সংবেদন তৈরি করে। মোদিয়ানোর উপন্যাসের ভাষা নিষ্কাসন করে এই ইতিহাস বোঝা গুরুত্বপূর্ণ বটে। সাহিত্যের ১০৭তম নোবেলজয়ী প্যাত্রিক মোদিয়ানোর একটি বক্তব্যেও তার উপন্যাসের ভাষায় এই ইতিহাসের কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাবে। মোদিয়ানোর দাবি তিনি ফরাসি ভাষার ক্ল্যাসিক ফর্মে লিখেছেন। মোদিয়ানো বলেছেন, ‘আমি প্রধানত ক্ল্যাসিক্যাল ফ্রান্সে লিখেছি।’ ১৯৭৫ সালের এক সাক্ষাৎকারে মোদিয়ানো এই দাবির কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘কারণ এই ফর্মটি আমার উপন্যাসের জন্য জরুরি। ফ্রান্সের ইতিহাসের অন্ধকার, ঘোর, ভাসমান, উদ্বাস্তু বা বাস্তুহীনতার একটি প্রতিবেশ তুলে ধরতে এই ফর্মটিই বেশ দরকারি। আমি তাই চেয়েছিলাম। বেশ সহজ, স্বচ্ছ ও যথাসম্ভব খুবই প্রথাগত ও ইতিহ্যময় ভাষায় এসব তুলে আনতে আমি একটি রীতি-শৃঙ্খলা মান্য করেছি।’

আমরা যখন মোদিয়ানোকে পড়ি তখন কতগুলো বৈপরীত সাদৃশ্যের মুখোমুখি হই। আঘাত পাই। তার বর্ণনার ধরণ ও বাক্য গঠনের মধ্যে একদিকে থাকে স্বচ্ছতা আর দিকে থাকে সহজতা। অপরদিকে তার বিষয়বস্তুর বর্ণনাভঙ্গিতে রয়েছে জটিল স্বভাব আর ঘোর-রহস্যময়তা। সুইডিশ একাডেমি মোদিয়ানোকে ২০১৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এটি ফ্রান্সের ১৫তম নোবেল পুরস্কার। তাকে পুরস্কৃত করার সময় সুইডিশ একাডেমির বক্তব্য ছিল, ‘তার স্মৃতিশিল্প—যার মধ্য দিয়ে তিনি রহস্যময় অধরা মানব নিয়তিকে তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছেন। উন্মোচন করে দিয়েছেন ‘অকুপেশন’ এর জীবন-জগত।’

মোদিয়ানো কিছুটা শরমিন্দাগোছের, প্রচারবিমুখও। খুবই কম-সম সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাহিত্য নিয়ে শোরগোল আর নানান রকম উত্তেজনা থেকে তিনি বেশ দূরে অবস্থান করেন। এমনকি প্যারিসের সাহিত্য-সেন্স বলে যে একটা ব্যাপার চালু আছে সেটা থেকেও মোদিয়ানো বেশ দূরত্ব বজায় রাখেন। তিনি উদ্যোগী, সামর্থবান বটে। হয়ত ব্রিটেনের মতো কোনো প্রখ্যাত পারিবারিক নামধাম নেই তার। কিন্তু তিনিই হলেন ফ্রান্সের বড় মাপের লেখকদের একজন। মোদিয়ানো। তার উপন্যাসের ক্যারিয়ার যতটুকু সামনে হাজির হয়েছে তাই বিপুল মুগ্ধতা ছড়িয়েছে। মোদিয়ানো এতটাই চুপচাপ ছিল যে, তাকে রীতিমত আবিষ্কার করতে হয়েছিল।

মূলত ফ্রান্সের খুবই অভিজাত ও প্রভাবশালী প্রকাশক রেইমন্ড কুইনেয়া তাকে সবার সামনে তুলে আনেন। ১৯৬৮ সালে তার প্রথম উপন্যাস ‘লা প্লাসে দে আই’ইতোলি’ বের হওয়া থেকে শুরু করে নানান সময়ে নানাভাবে সমর্থন দিয়ে গেছেন রেইমন্ড কুইনেয়া।

গল্প বলেছেন মোদিয়ানো উত্তম পুরুষে। এতে ইহুদি বংশোদ্ভুত হয়েও তিনি সেমিটিক বিরোধী ভঙ্গিতে অবস্থান নিয়েছেন। এটি ঘটেছে তার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। গল্প বলছেন অন্ধকারে। অন্ধকারের কাহিনী ঠিক নয়—এই গল্প হল হ্যালোসিনেটরি গদ্যভাষার। মনস্তাত্ত্বিক গল্পের কাছাকাছি। কারণ একেবারে বাস্তবতার ঊর্ধ্বের নয়। ফ্যাক্ট যেমন আছে তেমনি যথারীতি আছে ফিকশনের সমারোহ। ব্যক্তির অভিযাত্রার সাথে জড়ায়ে মিলেমিশে তার উপন্যাসের ভাষা সমূহের এবং সমষ্টির না-বলা ইতিহাস হয়ে উঠেছে। এটিই শেষ পর‌্যন্ত মোদিয়ানোর সাহিত্যিক স্টাইল ও নিজস্ব ভাষা হয়ে ওঠে।

‘লা প্লাসে দে আই’ইতোলি’ মানে প্যারিসের একটি স্কোয়ার। বর্তমানে এটি প্লাসে চার্লস দে গোলে। যেটি মোদিয়ানোর মধ্যে দিয়ে একটি প্রতীকি রূপ পেয়েছে। ঢাকা পড়ে যাওয়া অপরের ইতিহাসকে স্মৃতিময় করে তোলায় বর্তমানে যে অর্থ তৈরি হচ্ছে তার জন্য এর রয়েয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী তাৎপর্য। এই স্কোয়ারই ছিল ইহুদিদের কোর্ট—যেখানে এক সময় ইহুদিদের ইয়েলো স্টার খচিত পতাকা পতপত করে উড়তে দেখা যেত। কিন্তু তাতে মোদিয়ানোর কি কাজ। মোদিয়ানোর শুধু কাজ ছিল ইতিহাসের সেই সীমানাটুকু—সেই অদেখা জগতটুকু দেখানো। যেখানকার সত্য-মিথ্যা—বা হিস্টিক্যাল ট্রুথ এর যে এলাকা সেটা হাজির করা। মোদিয়ানো সময়ের সেই নির্ধারিত স্মৃতি আর ফ্যান্টাসি এবং অপরাধ ও নিরপরাধ বা মাছুম পরিস্থিতির তীব্র কথকতা উপন্যাসের সার্বিক ভাষায় জীবন্ত করে তোলেন। যে বিষয় গড়ে উঠেছে মোদিয়ানোর মধ্য দিয়ে তাতে এখন দুই এবং তারও বেশি অর্থ উৎপাদিত হচ্ছে।

কারণ এতে যেমন করে গোয়েন্দা ফিকশন গড়ে উঠছে তেমনি ঔপন্যাসিক চলচ্চিত্র চিত্রায়িত হচ্ছে—এটিই একটি জগত যেখানে মোদিয়ানো অবজ্ঞা আর নৈতিক রহস্যময়তা বা দ্যর্থবোধকতার এক দুনিয়া নির্মাণ করেছেন। সেখানে নির্দিষ্ট স্থান কালপাত্র এমনভাবে গড়ে উঠছে যাতে অকুপেশন (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) থেকে শুরু করে ভাইসি শাসন বা ভাইসি ফ্রান্স, মেরুকরণ এবং ফ্রান্স থেকে ইহুদিদের ভূমিচ্যুত করার ঔপন্যাসিকতা অভিনব ভঙ্গিতে উঠে এসেছে।

পরবর্তী তার তিনটি উপন্যাসে এসব বিষয় নানান দিক থেকে বর্ণিত হয়েছে। পরের উপন্যাসগুলোতে আরো বিষয় বৈচিত্র্য নির্মিত হয়।

১৯৪৫ সালের ৩০ জুলাই প্যারিসের উপশহর বোলগ্নে-বিলানকোর্ট এলাকায় মোদিয়ানোর জন্ম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার অল্প কয়েক সপ্তাহ পরেই তার জন্ম। সেইকারণে মূলত তিনি অকুপেশন বা যুদ্ধেরই সন্তান। তার মা ছিলেন বেলজিয়ামের। আর বাবা ছিলেন ইতালির ইহুদি অনুসারী। প্যারিসের রাস্তাই ছিল তার বসতি। ঘুরে ফিরে সেসব কথা উঠে এসেছে তার উপন্যাসে। সে কারণে তার উপন্যাসের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি কর্তৃক ফ্রান্স দখল আক্রমণের পরিস্থিতি।

তার কাহিনী বলার অভিমুখ, প্রবণতা, বৈশিষ্ট্য, আগে-পিছে ফেরা, রহস্য তৈরি করার মধ্য দিয়ে অর্থময় ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি করার অপূর্ব সাহস ও শক্তি বিস্ময়কর। কিন্তু তার কাজ দুর্বোধ্য ও কঠিন নয়। তার উপন্যাসের দরোজা বন্ধ নয়। দুর্গম্য নয়। খুবই সহজ অথচ সংবেদশীল। তার ভাষা নানা দিক থেকে গল্প-সহায়ক। ভাষার গতি এতটাই স্বচ্ছন্দ যেন সংগীতের বহমান সুর। গল্পবলার সাথে আছে নাটকীয়তা, আছে অবকাশসহ পুরো দুঃসাহসিক প্রতিবেশ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top