আছাদুজ্জামান,হটনিউ২৪বিডি.কম: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল রাজনৈতিক ‘জনযুদ্ধ’। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি দীর্ঘ অথচ ধারাবাহিক আন্দোলনের ফসল। সংগ্রামের ধারাবাহিকতা-স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা এবং চূড়ান্ত লড়াই সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় অসংখ্য ঘটনা, প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে দিক, গোপন পরিকল্পনা-সিদ্ধান্ত জানা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে কত মানুষের অপরিসীম ত্যাগ-অসম সাহসিকতা-বীরত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে তা সবার জ্ঞাত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে কাজের সঙ্গে যে যতটুকু সম্পৃক্ত, সে ততটুকুই জানে। সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা যুক্ত নয় তাদের সবকিছু জানার কথা নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা-তার অনুপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। ‘প্রকাশ্যে’ ও ‘অপ্রকাশ্যে’ এই দুই ধরনের কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। সুতরাং যারা এই দুই ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত নয় বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তারা মুক্তিযুদ্ধকে তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বদলে দিতে পারে না।
মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত এ কে খন্দকার ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বই প্রকাশ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্ব নিঃসন্দেহে জাতির জন্য গৌরবের। তবে তিনি যেহেতু রাজনীতি বা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, সুতরাং তার ১৯৭১-এর ভিতরের অনেক দিক দেখার সুযোগ হয়নি। ১৯৬২ সাল থেকে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে অপ্রকাশ্যে স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা চলছিল- জাতির মনন প্রস্তুত করা হচ্ছিল একই সঙ্গে ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ও অস্ত্র সংগ্রহসহ ট্রেনিং চলছিল।
এ কে খন্দকার তার বইয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোনো প্রস্তুতি নেয়নি- এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। অথচ ‘জয় বাংলা বাহিনী’ গঠন-স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা ২ মার্চ উত্তোলন, ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতেই স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ (Proclamation)-স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কাঠামো ঘোষণা ও ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণকে জাতির প্রস্তুতির ক্ষেত্র বলে এ কে খন্দকার বিবেচিত করেননি? ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবিলা করতে হবে’- এটা কী নির্দেশনা নয়?পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর আওতায় হঠাৎ ঘোষণা দিলেই কী দেশ স্বাধীন করা যেত? বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, পাঞ্জাব না বাংলা- বাংলা বাংলা, পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা, জিন্না মিঞার পাকিস্তান- আজিমপুরের গোরস্থান। জাতির অস্তিত্বের নির্যাস ‘জয় বাংলা স্লোগান’ নির্ধারণ-‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান, ‘বিএলএফ’ গঠন, পতাকা উত্তোলন, ইশতেহার পাঠ, ৭ মার্চের ভাষণ, অস্ত্র সংগ্রহ করে ছাত্র-যুবকের ট্রেনিং-মেয়েদের ট্রেনিং- এসব কী প্রস্তুতি নয়?
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পেছনে আছে বাঙালি জাতির সুদীর্ঘকালের লাড়াই-সংগ্রামের এক জাজ্বল্যমান ইতিহাস। জাতির মনন প্রস্তুত-বিশ্ববাসীর সমর্থন আদায় প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর কৌশল ইত্যাদিকে বিবেচনায় নিয়েই তো স্বাধীনতা সংগ্রামকে মূল্যায়ন করতে হবে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পেছনেও রয়েছে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৬২ সালের প্রথমার্ধে তৎকালীন ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদের (তিনজনই ছাত্রলীগ সদস্য) সমন্বয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ) ‘বিএলএফ’ গঠিত হয়। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে নেতৃবৃন্দ ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর গঠন এবং সাংগঠনিক বিস্তৃতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করেন।
এই বৈঠকের কয়েক দিন পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব লন্ডনে যান এবং সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ দূতের সঙ্গে বাঙালির স্বাধীনতার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। লন্ডন থেকে দেশে ফিরে তিনি ‘নিউক্লিয়াস’ নেতৃবৃন্দকে ডেকে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। সে অনুযায়ী ‘নিউক্লিয়াস’ নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের দুটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র সংগ্রহের ব্যবস্থা সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধু ‘বিএলএফ’-এর চার নেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মণি এবং তোফায়েল আহমেদকে ডেকে চিত্তরঞ্জন সুতার এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ‘বিপ্লবী বাংলা’ এবং ‘জয় বাংলা’ নামে গোপন পত্রিকা প্রকাশ, বুকলেট, লিফলেট, পুস্তিকা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সাহিত্য সৃষ্টি করে স্বাধীনতার চেতনায় জাতিকে উজ্জীবিত করার কাজটি অত্যন্ত সুকৌশলে ‘নিউক্লিয়াস’ পালন করেছিল।
৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ৬-দফা ও ১১-দফা আন্দোলন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলনকে এক দফায় রূপান্তর করে স্বাধীনতার বিষয়কে সামনে নিয়ে আসার রূপরেখা প্রণয়নসহ আন্দোলনের মূল দায়িত্ব পালন করে ছাত্র-যুব নেতৃত্ব।১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮-১৯ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিএলএফের চার নেতাসহ তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে স্বাধীনতা বিষয়ে আলোচনায় বসেন। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে স্বাধীনতার প্রশ্নে বিএলএফের চার নেতা সম্পর্কে বিস্তারিত বিষয়ে অবগত করেন।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে ৩ মার্চ তারিখে গণপরিষদের অধিবেশন বাতিল করলে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। এ সময় বঙ্গবন্ধু হোটেল পূর্বাণীতে পার্লামেন্টারি দলের বৈঠক করছিলেন। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলে তিনি (নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী) আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার হুকুম দেন। শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য প্রত্যক্ষ আন্দোলন।
‘নিউক্লিয়াস’-এর পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২ মার্চ ডাকসুর ভিপি হিসেবে আমি স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে ওঠে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’। এই পরিষদের চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং আমি ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় ‘স্বাধীন সার্বভৌম’ বাংলাদেশের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ইশতেহারটি পাঠ করেন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শাজাহান সিরাজ।
ঘোষণায় বলা হয়- ৫৪ হাজার ৫ শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগোলিক এলাকার ৭ কোটি মানুষের আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’।স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ সংগীতটি ব্যবহৃত হবে। উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক। ‘জয় বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এ ছাড়াও স্বাধীনতার ইশতেহারে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কর্মপন্থা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মকৌশল এবং পদ্ধতির দিক-নির্দেশনা দেওয়া হয়। ৩ মার্চ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হয়েছিলেন। তার সামনেই স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার পক্ষে চার ছাত্র নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, আমি, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথবাক্য পাঠ করি। শপথ শেষে ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর ডেপুটি চিফ কামরুল আলম খান খসরু আনুষ্ঠানিকভাবে গান ফায়ার করেন এবং হাসানুল হক ইনু পতাকা উত্তোলন করেন এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশিত হয়।
মার্চের ৩ তারিখ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিএলএফের চার নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে স্বাধীনতা আন্দোলন বিষয়ে আলোচনা হয়। মার্চের ৪ তারিখে বঙ্গবন্ধু বিএলএফের চার নেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদকে ডেকে ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড সম্পর্কে অবহিত করেন। বঙ্গবন্ধু জানান, তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড গঠিত হয়েছে। ৫ ও ৭ মার্চের ভাষণের বিষয় নিয়ে প্রথমে বিএলএফের হাইকমান্ড সিরাজুল আলম খানসহ চার নেতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা হয়। ৬ মার্চ রাত ১২টায় বিএলএফ ‘হাইকমান্ড’-এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পুনরায় আলোচনা হয়।
সেদিন গভীর রাতে ৭ মার্চের ভাষণ বিষয়ে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। ৭ মার্চেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা করা হয়। এর ভিত্তিতেই জনগণ বিকল্প রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ‘জয় বাংলা’ বলেই বঙ্গবন্ধু তার ভাষণ শেষ করেন। আমরা মঞ্চে উপস্থিত ছিলাম। পতাকা উত্তোলন, স্বাধীনতার ইশতেহার ঘোষণা, ৭ মার্চের ভাষণের নির্দেশনা দিয়ে কী মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র ভিত্তি রচিত হয়নি? এরপরও ঘোষণার আর কী বাকি থাকে? কীভাবে রাষ্ট্রের নামকরণ ‘বাংলাদেশ’ নির্বাচিত হলো, কীভাবে জাতির আত্মপরিচয় পতাকা নির্মিত হলো, কীভাবে জাতীয় সংগীত নির্ধারিত হলো, কীভাবে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হলো- এগুলো যাদের জানা নেই তারা কীভাবে সে কথা বলবে? জয় বাংলা স্লোগান কারা নির্ধারণ করেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি কীভাবে প্রদান করা হলো, ৭ মার্চের ভাষণ কীভাবে প্রস্তুত করা হলো যারা জানেন না তারা সে সম্পর্কে বলবেনইবা কেমন করে?বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি…, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ…’ এভাবে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। ঘোষণা করেছেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
জাতি এভাবেই অসহযোগ আন্দোলনকে সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে নিয়ে যায়। জাতির এই লৌহকঠিন ঐক্যবদ্ধ প্রস্তুতির কারণেই তখনকার সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে বাঙালি বীর সন্তানরা এমনকি সুদূর পাকিস্তান থেকেও মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সমগ্র জনগণের অন্তরাত্মার প্রস্তুতি অনুভব করেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করার তারা নৈতিক শক্তি পেয়েছেন।জাতিভিত্তিক একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয় রাজনৈতিক সংগ্রাম ও জাতির সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ‘নিউক্লিয়াস’ ও ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক এবং সশস্ত্র যুদ্ধের বীরত্বব্যঞ্জক ঘটনাবলি ও ত্যাগের ইতিহাসকে গোপন করে রাখাই হবে অপকৌশল। অগ্নিঝরা মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের সময় দিনের প্রতিটি ঘণ্টা অর্থাৎ যতই ২৬ মার্চ ঘনিয়ে আসছিল ততই তখনকার জনগোষ্ঠীর মধ্যকার ছাত্র-যুব সমাজের অদম্য এবং সাহসিক প্রত্যয় সবকিছুকে অতিক্রম করে স্বাধীনতার জন্য শেষ লড়াই সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত করার প্রস্তুতি নিয়েছিল, তাও প্রকাশিত হওয়া প্রয়োজন।
২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসের পরিবর্তে ‘বিএলএফ’ ও ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে’র পক্ষ থেকে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয় এবং সারা দেশের ঘরে ঘরে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলিত হয়। আমরা ছাত্ররা ভোরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ছাদে, হাইকোর্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পতাকা উড়িয়ে দেই। দুপুরে জয় বাংলা বাহিনীর পক্ষে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দেই। ২৩ মার্চ গভীর রাতে ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বিএলএফ’-এর নেতাদের সঙ্গে ৪ ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক হয়। পরদিন ২৪ মার্চ সকালে অনির্ধারিতভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠকের জন্য তৎকালীন গণভবনে বঙ্গবন্ধু রওনা হলেন। আমি গাড়ির এক পাশে কালো পতাকা আর অন্য পাশে স্বাধীন বাংলার পতাকা বেঁধে দেই। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাঙালির সংগ্রামী চরিত্র আরও বিকশিত হয়েছিল-সুদৃঢ় হয়েছিল-প্রত্যক্ষ তা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণে উন্মুখ ছিল। অথচ এ কে খন্দকার অসহযোগের সময় লুটপাট প্রত্যক্ষ করেছেন- জাতির জন্য বেদনাদায়ক। আর মুজিব বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে এ কে খন্দকারের মূল্যায়ন একেবারেই অবান্তর। যাতে সত্যের লেশমাত্র নেই। কারও জানার সীমাবদ্ধতা আর অজ্ঞতা বা কারও সংকীর্ণতা মুক্তিযুদ্ধের মহান উচ্চতম গৌরবকে ম্লান করতে পারে না। তেমনি কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলেই ‘পাকিস্তানি চর’ আখ্যায়িত করাও শোভনীয় নয়। মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে স্বাধীনতার পর শাসনক্ষমতার দ্বন্দ্বে সম্পর্কিত করে মূল্যায়ন করা খুবই দুঃখজনক। সুতরাং স্বাধীনতার ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রস্তুতি ছিল না, তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাজনৈতিক নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সে মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর ভূমিকাও গৌরবোজ্জ্বল আর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকাও অনস্বীকার্য। ‘জাতি-রাষ্ট্র’ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নেপথ্যের কাহিনী অনুসন্ধান ও গবেষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নির্মাণ করতে হবে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।