সকল মেনু

সক্রেটিসের মৃত্যু : প্লেটো

 সাহিত্য ডেস্ক: আমাদের মনে হয়েছিলো, যেন আমরা আমাদের বাবাকে হারাতে যাচ্ছি এবং বাকি জীবনের জন্যে অনাথ হতে যাচ্ছি। তার দুটো সন্তান ছিলো, একজন সদ্য বড় হতে চলছে এবং তার পরিবারের নারীদের তার কাছে আনা হলো, ক্রিটোর উপস্থিতিতে তিনি তাদের সঙ্গে কথা বললেন এবং তাদের প্রতি শেষ আদেশ রাখলেন। তারপর তিনি নারী এবং শিশুদের সরিয়ে দিলেন এবং আমাদের কাছে ফিরে এলেন। সেই মুহূর্তে যে গভর্নিং কাউন্সিল তাকে মৃত্যুর আদেশ দিয়েছিলো তাদের একজন কর্মী তার সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘সক্রেটিস, আমি জানি অন্য সবার মতো আপনি অবিবেচক হবেন না। যখন তাদেরকে বিষ দেই পান করার জন্যে তখন তারা আমার উপর রেগে যায়, আমাকে অভিশাপ দেয়, কিন্তু কর্তৃপক্ষই আমাকে এ দায়িত্ব দিয়েছে। তবে আমি এখানে যতো লোক এসেছে তার মধ্যে আপনাকেই সবচেয়ে মহৎ, ভদ্র এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে দেখেছি, এবং এখন আমি নিশ্চিত যে আমার উপর নয়, বরং আপনি তাদের উপরই ক্ষুব্ধ হবেন যাদেরকে আপনি দায়ী মনে করেন। অতএব, বিদায়, এবং যা ঘটবেই তাকে যতো হাল্কাভাবে সম্ভব গ্রহণ করুন, আপনি তো জানেনই আমি কেন এসেছি।’ এইটুকু বলে তিনি মুখ ফেরালেন এবং কাঁদতে কাঁদতে চলে গেলেন। সক্রেটিস তার দিকে তাকিয়ে রইলেন আর বললেন, ‘বিদায়, আপনার কথা মতোই আমি কাজ করবো।’ তারপর তিনি আমাদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন, ‘মানুষটি কতোই না ভদ্র। যতোটা সময় আমি এখানে ছিলাম তিনি নিয়মিত আমাকে দেখতে আসতেন, এবং মাঝেমাঝে আমার সঙ্গে গল্প করতেন এবং এদের মধ্যে তিনিই হলেন সর্বোৎকৃষ্ট। এবং এখন দেখো কী উদারভাবে আমার জন্যে কাঁদলেন। ক্রিটো, এসো, আমরা তার কথা অনুসরণ করি – যদি তৈরি হয়ে থাকে তবে আমার সামনে সেই বিষ আনা হোক, আর যদি এখনও তৈরি হয়ে না থাকে তবে তা তৈরি করা হোক।’

ক্রিটো বললেন, ‘না সক্রেটিস, আমার মনে হয় পাহাড়ের চূড়ায় এখনও সূর্য বর্তমান – এখনও সূর্যাস্ত হয়নি। পাশাপাশি আমি এও জানি আর সবাই আরো দেরি করে বিষ গ্রহণ করে থাকে। এবং ঘোষণা দেয়ার পরও তারা সাগ্রহে পানাহার করে, নির্বাচিত বন্ধুদের সঙ্গ উপভোগ করে। কাজেই আপনি তাড়াহুড়া করবেন না, এখনও সময় বাকি আছে।’
জবাবে সক্রেটিস বললেন, ‘যাদের কথা বললে, ক্রিটো, স্বাভাবিকভাবেই তারা এ রকম আচরণ করে থাকে, কারণ তারা ভাবে এতে করে হয়তো তারা লাভবান হবে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই আমি সে রকম করবো না, কেননা আমি জানি একটু দেরি করে বিষ পান করলে আমার বিশেষ কোন লাভ হবে না। আমার বিবেচনায়, যে জীবন শেষ হয়ে গেছে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। তাই, আমি যা বলি তা করতে অস্বীকার কোরো না।’

তখন ক্রিটো পাশে দাঁড়ানো দাসের প্রতি ইশারা করলেন। দাসটি চলে গেলো, এবং কিছুক্ষণ পরেই যে লোকটি বিষ দেবে তাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো। সে একটি পেয়ালার মধ্যে বিষটি প্রস্তুত করে এনেছে। সক্রেটিস তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জনাব, আপনি এ ব্যপারটি ভালো বোঝেন, অতএব আমাকে বলে দিন কী করতে হবে?’
‘আপনাকে শুধু এটা পান করতে হবে’– তিনি বললেন ‘এবং ততোক্ষণ পর্যন্ত হাঁটতে হবে যতক্ষণ না আপনার পা ভারী হয়ে ওঠে। এবং তারপর আপনাকে শুয়ে পড়তে হবে এবং এটা নিজ থেকেই কাজ করতে শুরু করবে।’
এইটুকু বলে তিনি বিষের পেয়ালাটি সক্রেটিসের হাতে তুলে দিলেন। কোনরকম কাঁপুনি ছাড়া, বদল ছাড়াই, স্বাভাবিকভাবেই তিনি তা গ্রহণ করলেন এবং স্থির দৃষ্টিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি বলো এই এক চুমুকেই দেবতাদের প্রতি নিবেদন সমাপ্ত হয়ে যাবে? আমি কী তাই করবো, না করবো না?’
জবাবে সে বললো, ‘আমরা শুধু ততটুকু বিষই প্রস্তুত করি যতটুকু দরকার, সক্রেটিস।’
‘আমি বুঝতে পেরেছি’, সক্রেটিস বললেন, ‘তবে আমার মনে হয় আমি হয়তো কিংবা অবশ্যই দেবতাদের উদ্দেশে প্রার্থনা করবো যেন আমার যাত্রা শুভ হয়। এই আমার প্রার্থনা– তাই যেন হয়।’

এইটুকু বলেই তিনি বিষের পেয়ালা ঠোঁটে তুলে নিলেন এবং সানন্দে, শান্তভাবে তা পান করলেন। এ পর্যন্ত আমাদের অধিকাংশরাই কোনভাবে নিজেদের আর্তনাদকে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিলো। কিন্তু যখন আমরা তাকে বিষ পান করতে দেখলাম এবং নিমিষেই বিষ শেষ হয়ে গেলো, আমরা আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলাম না। আমার অজান্তে কান্না বেরিয়ে এলো এবং আমি মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলাম – তার জন্যে নয় বরং আমার নিজের দুর্ভাগ্যের জন্যেই যে এমন একজন বন্ধুকে হারাতে বসেছি। আরও আগেই ক্রিটো কান্না সংবরণ করতে না পেরে দূরে সরে গেলেন। এবং এপোল্লোডোরাস যে কিনা এর আগে কখনো একবারও কাঁদেনি সে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। একমাত্র সক্রেটিস ছাড়া, তার কান্না আর আর্তনাদে আমরা সবাই ভেঙ্গে পড়লাম।

‘হে আমার বন্ধুরা, তোমরা কী করছো?’ তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘আমি নারীদের মূলত এই কারণেই সরিয়ে দিয়েছি যে তারা হয়তো যেমন আমি শুনেছি তেমন শান্তভাবে মরতে দেবে না। নিজেদের শান্ত করো এবং সহ্য করো।’
তার এ কথা শুনে আমরা লজ্জিত হলাম এবং কান্না বন্ধ করলাম। কিন্তু তিনি পায়চারি করতে লাগলেন এবং তার পা ভারী হয়ে এলো, এবং এরপর যেভাবে তাকে বলা হয়েছিলো সেভাবে তিনি শুয়ে পড়লেন। যে লোকটি তাকে বিষ দিয়েছিলো সে একটু পর পর তার পা এবং পায়ের পাতা পরীক্ষা করতে লাগলো। তারপর সে সজোরে তার পায়ে চাপ দিলেন, এবং জানতে চাইলেন তার কোন অনুভূতি আছে কিনা, সক্রেটিস না বললেন। এরপর তার পা উপরে উঠিয়ে আমাদের দেখানো হলো যে, তিনি স্থির ও ঠাণ্ডা হয়ে এসেছেন।

সক্রেটিস নিজেও তা বুঝতে পারছিলেন, এবং বলা হলো, এটা যখন তার হৃৎপিণ্ডে যাবে তখন তিনি শেষ হয়ে যাবেন। তার দেহের নিচের অংশ আরও শীতল হয়ে উঠলো, তিনি মুখের উপর যে পর্দা দেয়া ছিলো তা সরালেন এবং শেষবারের মতো কথা বললেন।
‘ক্রিটো’, তিনি বললেন, ‘আমি এসক্লিপিয়াসের কাছ থেকে একটা কক ধার করেছিলাম, সেটা শোধ করে দিতে ভুলো না।’
‘তা করা হবে’, জবাবে ক্রিটো বললেন, ‘আপনার কি আর কোন ইচ্ছা আছে?’
তিনি এ প্রশ্নের কোন উত্তর দিলেন না। একটু বিরতির পর তার শরীরটা একটু কেঁপে উঠলো। লোকটি তার শরীর থেকে কাপড় সরিয়ে দিলেন, তার চোখ তখন স্থির। ক্রিটো তার চোখ ও মুখ বন্ধ করে দিলেন।
এইভাবে শেষ হয়ে গেলেন আমাদের বন্ধু, একজন মানুষ, যাকে আমি মনে করি আমার দেখা সবচেয়ে জ্ঞানী, বিবেচক এবং সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top