সকল মেনু

জলদস্যুদের ফেনীতে প্রকাশ্য অস্ত্রের মহড়া

 ফেনী প্রতিনিধি : সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে ফেনীর কুখ্যাতি দেশজুড়ে। এর প্রমাণ পাওয়া গেল আবারও। ঈদ সামনে রেখে সোনাগাজী উপজেলায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে জলদস্যুরা। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে তারা। সেখানে চলছে ত্রাসের রাজত্ব। এতে আতঙ্কে দিন কাটছে এলাকাবাসীর। জলদস্যুদের মধ্যে অধিকাংশই রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ ছাড়া পুলিশের সঙ্গে সখ্য থাকায় কেউ তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে পারছে না। ফলে অবাধে অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে জলদস্যুরা।  সোনাগাজীর শতাধিক স্পটে প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে এসব জলদস্যু। মূলত ছোট ফেনী নদী ও বড় ফেনীর আশপাশের এলাকাগুলো জলদস্যুদের অভয়ারণ্য। সম্প্রতি সোনাগাজীর ওলামা বাজার এলাকা থেকে গোপন ক্যামরায় ধারণ করা হয় অবৈধ অস্ত্রসহ তাদের ছবি। স্থানীয় ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, সোনাগাজী আবার অশান্ত হচ্ছে। সম্প্রতি সোনাগাজী উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সামাজিক, পারিবারিক ও রাজনৈতিক যেকোনো ছোটখাটো ঘটনাকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসীরা যখন-তখন অস্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছে। ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবেও কাজ করছে তারা। ফেনীর বাইরেও চলছে তাদের কর্মকাণ্ড। আর এসব সন্ত্রাসী রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকায় পুলিশ নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে।জানা যায়, দেশের অন্যান্য জায়গার মতো সোনাগাজীতেও দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কোনো অভিযান না-হওয়ায় সন্ত্রাসীরা অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়েছে।গত ২০ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে শহরের ট্রাংক রোড থেকে সোনাগাজী উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক সাইদুল ইসলাম ও আমিরাবাদ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রিংকুর কাছ থেকে একটি জাপানি রিভলবার, তিন রাউন্ড গুলি, দুটি ধারালো চাকু উদ্ধার করে র‌্যাব। এ সময় তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটিও আটক করা হয়। ১৯ জুলাই মাসুদ নামে এক জলদস্যুকে গ্রেফতার করে সোনাগাজী থানা পুলিশ। তার বিরুদ্ধে সোনাগাজী থানায় চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ ও অস্ত্র আইনে ১৫টিরও বেশি মামলা রয়েছে।

১৭ জুন স্থানীয় ওলামা বাজারে লেঙ্গা কালাম বাহিনী ব্যবসায়ী নুরুল আবছারকে মারধর করে টাকা ছিনিয়ে নেয়। এতে বাধা দিলে জলদস্যুরা কুপিয়ে তার ডান হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এ ঘটনার পর ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করেননি।

৪ জুন চর দরবেশে ৯ নম্বর ওয়াড আদর্শ গ্রামে স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্প থেকে ২০০ গজ দূরে জলদস্যুদের হাতে খুন হন আরেক জলদস্যু যুবলীগ সভাপতি জসিম উদ্দিন। এ ঘটনায় করা মামলার প্রধান আসামি যুবলীগ নেতা দেলোয়ার বাবুল ও ছাত্রলীগ নেতা সুমনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্তমানে তারা জেলহাজতে আছেন।

এর আগে সোনাগাজীতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল যুবদল নেতা আবদুর রহমান মানিক ওরফে সন্দ্বীপি মানিক। ২০১৩ জুন মাসে অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মানিক জলদস্যুদের হাতে খুন হন। এরপর একই বছর আগস্ট মাসে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন যুবলীগ নেতা আনোয়ার হেসেন মিন্টু ।

২০০৯ সালে যুবলীগ নেতা জলদস্যু হারিছ বাহিনীর হাতে খুন হন আরেক জলদস্যু ঈমাম হোসেন বল্টু। এর আগে বল্টু বাহিনী স্থানীয় লন্ডনিপাড়ায় ডাকাতি ও লুটপাটের পর এক গৃহবধূকে গণধর্ষণ করে। এ ছাড়া স্কুল-কলেজপড়ুয়া মেয়েদের অনেকেই জলদস্যুদের ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

আবার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এক জলদস্যুর হাতে খুন হচ্ছে আরেক জলদস্যু। এক বাহিনীর বিদায় হলে আরেক বাহিনীর জন্ম হয়। এভাবে গড়ে উঠছে বাহিনীর পর বাহিনী। বর্তমানে আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে তারা। একেক জন একেক গ্রুপে ভাগ হয়ে অপকর্ম চালাচ্ছে তারা। যেমন আফসার বাহিনী, লেঙ্গা কালাম বাহিনী ও ভাগিনা কালাম বাহিনী।

জলদস্যুদের সক্রিয় স্পট
ফেনী-সোনাগাজী সড়কের ছিন্তারপুল, ধলিয়া-সোনাগাজী সীমান্ত সড়কের উকিলবাড়ির দরজা, সোনাগাজী বাংলা ফাইভ স্টার, বখতার মুন্সি কলেজের সামনের যাত্রীছাউনি, গুচ্ছারটেক মতিগঞ্জ, ছাদিক্কার টেক মতিগঞ্জ, সাতবাড়িয়া ব্র্যাক অফিস, সাতবাড়িয়া  ব্রিজ, বালুয়া চৌমুহনী শুকুরের দোকান, ওলামা বাজার ভৈরব রাস্তার মাথা, সোনাগাজী ধান গবেষণা কেন্দ্র এলাকা, সোনাগাজী চেয়ারম্যান পুকুরপাড়, ফকিরবাড়ির দরজা ও সোনাগাজী বেনাপোলসহ শতাধিক জায়গা জলদস্যুদের স্পট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

গত ৮ জুন বিকেলে সোনাগাজী উপজেলা চর দরবেশ ইউনিয়নের বটতলায় পূর্বশত্রুতার জের ধরে জলদস্যু ভাগিনা কালাম বাহিনীর হামলায় স্থানীয় যুবদল নেতা মোস্তফা গুরুতর আহত হন। উপকূলীয় জলদস্যু ভাগিনা কালাম বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড জসিমের নেতৃত্বে আকবর, আলম, নবী, সেলিমসহ ১০-১২ জনের সংঘবদ্ধ দল ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে।

১৮ মে উপজেলার ওসমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির পক্ষ থেকে স্কুলের দীর্ঘদিনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে অভিভাবক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশের পূর্বমুহূর্তে স্থানীয় যুবলীগ কর্মী সাইফুল ইসলাম শিপন, রহিম ও মানিকের নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি সশস্ত্র দল একাধিক অবৈধ অস্ত্র নিয়ে সমাবেশে হামলা চালায়।

এ সময় সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে নবম শ্রেণির ছাত্র পারভেজ (১৪), মহসীন (১৪), অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ফারহানসহ (১৩) চার শিক্ষার্থী এবং পথচারী সোহাগ, ফয়েজ আহাম্মদ, স্কুলের  অভিভাবক আমির হোসেন, ইসমাইল হোসেন, মো. সেলিম, আবুল কাসেমসহ ১০ জন গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় তারা লাঠিসোঁটা ও রড দিয়ে পিটিয়ে অভিভাবক, সাধারণ লোক ও শিক্ষার্থীদের আহত করে।

গত ২৩ মার্চ গভীর রাতে উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম চর চান্দিয়া গ্রামের সুলতান মিস্ত্রীর বাড়ির সৌদিপ্রবাসী আজিজুল হকের ঘরে ১৫-২০ জনের সশস্ত্র ডাকাত দল ঢুকে জিম্মি করে স্বর্ণালংকারের জন্য মারধর করে। এক পর্যায়ে দস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে গৃহকর্ত্রী ঘরের আলমারির চাবি তাদের হতে তুলে দেন। দস্যুরা আট ভরি স্বর্ণালংকার, ৪৮ হাজার টাকা, পাঁচটি মোবাইল ফোনসেট, মূল্যবান জিনিসপত্রসহ ৬ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে নেয়।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, সোনাগাজী থানায় জলদস্যুদের বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ থাকার পরও পুলিশ বলছে, তথ্য নেই।

সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ হটনিউজ২৪বিডি.কমকেকে জানান, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরার তথ্য তাদের জানা নেই। তথ্য পেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন তারা। সোনাগাজীতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top