সকল মেনু

পদ্মা সেতুর যাত্রা শুরু স্বপ্নপূরণের

 নিজস্ব প্রতিবেদক,১৭জুন : পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সরকার ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে ১৬ কোটি বাংলাদেশির স্বপ্নপূরণের যাত্রা শুরু হলো। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় হোটেল রূপসী বাংলার উইন্টার গার্ডেনে দুই পক্ষের মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রকল্প পরিচালক যুগ্ম-সচিব শফিকুল ইসলাম ও চায়না মেজর ব্রিজের পক্ষে লিউ জি নি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান।  ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণ করবে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। এর মধ্যে মূল সেতুর জন্য চায়না মেজর ব্রিজ ব্যয় ধরেছে ৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পর্যন্ত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর স্থায়িত্বকাল ধরা হয়েছে ৯৯ বছর। সবচেয়ে বেশি অর্থ লাগবে সেতুর উপরিভাগের সুপারস্ট্রাকচার নির্মাণে। এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৪০২ কোটি টাকা। আর সাবস্ট্রাকচার (পাইল, পিলার ইত্যাদি) নির্মাণে লাগবে তিন হাজার ৪৫ কোটি টাকা। মাওয়া অংশে সড়কের সঙ্গে সেতুর সংযোগস্থলের সাবস্ট্রাকচার নির্মাণে ১৫৫ কোটি টাকা ও সুপারস্ট্রাকচার নির্মাণে ৮২ কোটি টাকা এবং জাজিরা প্রান্তে সড়কের সঙ্গে সেতুর সংযোগস্থলের সাবস্ট্রাকচার নির্মাণে ১৭৮ কোটি টাকা ও সুপারস্ট্রাকচার নির্মাণে ৯২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।  এ ছাড়া প্রাথমিক ও সাধারণ অন্যান্য কাজে দুই হাজার ৫৮৮ কোটি, টেলিফোন, বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ ব্যবস্থা স্থাপনে ২৭৯ কোটি, মাটি পরীক্ষায় ৭৯ কোটি, সাইট ক্লিয়ারেন্স, মাটি খনন ও ভরাটে চার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। আর মাওয়া প্রান্তে রেলওয়ের সংযোগস্থলে সাবস্ট্রাকচার ও সুপারস্ট্রাকচার নির্মাণে ২৫ কোটি টাকা এবং জাজিরা প্রান্তে রেলওয়ের সংযোগস্থলে সাবস্ট্রাকচার ও সুপারস্ট্রাকচার নির্মাণে ২৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রস্তাবিত দরের ১০ শতাংশ (এক হাজার ২১৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা) পারফরম্যান্স গ্যারান্টি দিচ্ছে চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি। নির্মাণকালীন সময়ের জন্য এ গ্যারান্টি দেবে প্রতিষ্ঠানটি। চু্ক্তি স্বাক্ষর শেষে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘২০১৮ সালে পদ্মা সেতু সবার জন্য উন্মুক্ত করা হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দেশ আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অতিক্রম করলো। এই ধাপ পর্যন্ত আসতে অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। স্বপ্নেও ভাবিনি এই স্বপ্ন সত্যি হবে।’ এই চুক্তির মাধ্যমে পদ্মা সেতু বাস্তাবায়নের ক্ষেত্রে আর কোনা বাধা থাকলো না বলে মত দেন মন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘খুব শিগগিরই দেশবাসী এর দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পাবেন।’ জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সকল অবৈধ্ স্থাপনা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জমি অধিগ্রহণের ৯৮ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিষয়টি তদারকি করছে।’ গত ১৫ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ২০০ শত ১৩ কোটি ৩৩ লাখ ৯৩ হাজার ৬৮ দশমিক ২২ টাকা পারফরমেন্স ব্যাংক গেরান্টি দেয়। তার যাছাই শেষে মঙ্গলবার এই চুক্তি সম্পন্ন হলো। গত ২২মে মে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর দরপত্র প্রস্তাব সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে অনুমোদন দেয়া হয়। দরপত্রে মূল সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় হবে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে মোট ব্যয়ের ২৫ দশমিক ৬০ শতাংশ (৩ হাজার ১০৬ কোটি ১৫ লাখ টাকা) দেশীয় অর্থে ও অবশিষ্ট ৭৪ দশমিক ৪০ শতাংশ (৯ হাজার ২৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা) বৈদেশিক মুদ্রায় (ডলারে) পরিশোধ করতে হবে। পদ্মা সেতুর মূল কাজের জন্য ২০১০ সালের ১১ মে পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামো নির্মাণে প্রাথমিক দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। চূড়ান্ত মূল্যায়ন শেষে ২০১১ সালের মাঝামাঝি ঠিকাদার নিয়োগ দেয়ার কথা ছিল। সে সময় মূল সেতুর প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ১২৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা। তবে বিশ্বব্যাংকের আপত্তিতে ২০১১ সালের আগস্টে প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। নানা জটিলতা শেষে প্রায় দুই বছর পর ২০১৩ সালের ২৬ জুন পূনরায় চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়।

গত ২৪ এপ্রিল মূল সেতুর আর্থিক প্রস্তাব জমা পড়ে। কিন্তু তিন বছরের ব্যবধানে মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় ৩ হাজার ৬ কোটি ২২ লাখ টাকা বাড়িয়ে ধরা হয়। ব্যয় বাড়লেও সর্বশেষ প্রাক্কলিত ব্যয়ের তুলনায় দরদাতা প্রতিষ্ঠান প্রায় ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ কম দর দেয়। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ হচ্ছে ১ হাজার ৭৫২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

অথচ গত বছর ২৬ জুন চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বানের পর মূল সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয় ১৩ হাজার ৮৮৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি এ ব্যয় প্রাক্কলন করেছিল।

মূল পদ্মা সেতু নির্মাণে ১০টি প্রতিষ্ঠান প্রাক-যোগ্যতা বাছাই দরপত্রে অংশ নেয়। সেখান থেকে ৫টি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। ২০১৩ সালের ২৬ জুন চারটি প্রতিষ্ঠানের কাছে চূড়ান্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়। এতে তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলে সবগুলোই কারিগরিভাবে যোগ্য বিবেচিত হয়। অপর দুই প্রতিষ্ঠান হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং সিএ্যান্ডটি কর্পোরেশন এবং ডেলিম-এলএ্যান্ডটি জেভি। কিন্তু আর্থিক প্রস্তাব জমাদানের ক্ষেত্রে ওই দুই প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে ১০ সপ্তাহ ও ১১ সপ্তাহ সময় বাড়ানোর দাবি জানায়। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পের ক্রয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল-এইকম ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি) এতে সম্মত হয়নি। ফলে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে চায়না মেজর ব্রিজকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সুপারিশ করা হয়।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চুক্তির অ্যাওয়ার্ড প্রদানের দিন থেকে ১৪৬০ দিন বা ৪ বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ করতে হবে। সে হিসেবে এ সেতুর নির্মাণ কাজ আগামী ২০১৭ সালের ডিসেম্বর বা ২০১৮ সালের প্রথমদিকে শেষ হবে বলে আশা করা হয়েছে।

এর আগে ২০০৯ সালে সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এ সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বিশ্বব্যাংক, ৪০ কোটি মার্কিন ডলার জাপান, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪ কোটি মার্কিন ডলার, ৬১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) দেওয়া কথা ছিল।কিন্তু এরপরই পরামর্শক নিয়োগ নিয়ে তৈরি জটিলতার পর পুরো প্রক্রিয়া সাময়িক বন্ধ যায়।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top