সকল মেনু

সড়কে গাড়ি নামালেই টোল!

ঢাকা, ২৫ মার্চ (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : দেশের সব জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক-মহাসড়ক, জেলা সড়ক ও উড়াল সড়কে গাড়ি চালানোর জন্য নির্ধারিত হারে টোল দিতে হবে। যানবাহনভেদে সর্বনিম্ন পাঁচ টাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকা টোল ধরা হবে। কনটেইনারবাহী ট্রেইলার, ট্রাক, বাস থেকে শুরু করে ১৩ ধরনের যানবাহন টোলের আওতায় আসবে। এ ছাড়া সব সেতু ও ফেরিতে একক কাঠামোর আওতায় টোল আদায় করা হবে। টোল গুনতে হবে উড়াল ও পাতাল সড়কেও। এসব বিধান রেখে গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘টোল নীতিমালা ২০১৪’ অনুমোদন করা হয়।

সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নীতিমালা হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সংসদে পাস করার প্রয়োজন পড়বে না। তবে এ টোলের ধাক্কা জাতীয় জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলেছেন, যানবাহনের ওপর আরোপ করা হলেও টোলের ঘানি জনগণকেই টানতে হবে। তবে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, এ বোঝা জনগণের জন্য প্রকারান্তরে আশীর্বাদই বয়ে আনবে।

বৈঠকের পর একজন সিনিয়র মন্ত্রী কালের কণ্ঠকে জানান, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা যদি সেবা দিতে পারি, মানুষ টোল আদায় নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না।’ এ ছাড়া মন্ত্রীরা টোলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁদের নিজ নিজ মতামত তুলে ধরেন।

সরকারের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মহাসড়কের সেতু ও সড়ক থেকে টোল আদায়ের নিয়ম ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আছে। আমাদের দেশে যদি সেবা দেওয়া নিশ্চিত করা হয়, তাহলে এ টোল আদায় করা অযৌক্তিক নয়। টোল থেকে আদায় হওয়া অর্থে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ করে চলাচলের আরামদায়ক সড়ক ব্যবহার করতে পারলে এ টোল নেওয়া যায়। তবে একসঙ্গে টোল আদায় করলে তা সাধারণ মানুষের জন্য বহন করা কষ্টকর হবে। আর এ টোল আদায় করাকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজরা সংগঠিত হবে। এসব বিষয়ে সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।’

যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সর্বোচ্চ হারে টোল আরোপ করা হবে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক হিসেবে বিবেচিত হবে। জাতীয় মহাসড়কের মধ্যে রয়েছে ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-রাজশাহী ইত্যাদি মহাসড়ক। আঞ্চলিক মহাসড়ক হলো, সিলেট-তামাবিল সড়ক, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক, ঢাকা-কালীগঞ্জ-ঘোড়াশালের মতো সড়কগুলো। আর জেলা সড়ক বলতে জেলা সদর ও উপজেলার মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী সড়ককে বোঝানো হবে।

নীতিমালা অনুযায়ী, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ব্যবহারে ট্রেইলারের টোল হবে এক হাজার টাকা, ভারী ট্রাক ৮০০, মাঝারি ট্রাক ৪০০, বড় বাস ৩৬০, ছোট ট্রাক ৩০০, মিনিবাস ২০০, কৃষিকাজে ব্যবহৃত যানবাহন (ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার) ২৪০, মাইক্রোবাস ও পিকআপ ১৬০, ব্যক্তিগত গাড়ি ১০০, অটোরিকশা ৪০, মোটরসাইকেল ২০ এবং রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ির ১০ টাকা।

ভিত্তি টোল জেলা সড়কে ১০০, আঞ্চলিক মহাসড়কে ২০০, জাতীয় মহাসড়কে ৩০০ টাকা এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে ৪০০ টাকা। ‘ভিত্তি টোল’ প্রকারান্তরে মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের ভিত্তি টোল ৪০০ টাকা- যা মাঝারি ট্রাককে গুনতে হবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কে বড় বাসের টোল হবে ভিত্তি টোলের ৯০ শতাংশ-৩৬০ টাকা, মিনি ট্রাক ৭৫ শতাংশ তথা ৩০০ টাকা এবং মাইক্রোবাস ৪০ শতাংশ তথা ১৬০ টাকা। একইভাবে ভারী ট্রাককে দিতে হবে ভিত্তি টোলের দ্বিগুণ, অর্থাৎ ৮০০ টাকা। আর ট্রেইলারের ক্ষেত্রে টোল হবে এক হাজার টাকা। আর জাতীয় মহাসড়ক ব্যবহারে টোলের হার হবে উপরে লিখিত পরিমাণের চার ভাগের তিন ভাগ, আঞ্চলিক মহাসড়কের ক্ষেত্রে অর্ধেক ও জেলা সড়কের ক্ষেত্রে চার ভাগের এক ভাগ। তবে সরকার চাইলে যেকোনো সড়ককে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করে সর্বোচ্চ হারে টোল আরোপ করতে পারবে।

নীতিমালায় বলা হয়, ২০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে সেতু টোলের আওতায় আসবে। এ ছাড়া যেখানে ফেরি আছে সেখানে স্থায়ী সেতু হলে দৈর্ঘ্য যাই হোক, কমপক্ষে এক বছরের জন্য তা টোলের আওতায় আসবে। সেতু ও ফেরির ক্ষেত্রে টোল নির্ধারণে চারটি ধাপ নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০০ থেকে ৫০০ মিটার, ৫০১ থেকে ৭৫০ মিটার, ৭৫১ থেকে ১০০০ মিটার এবং এক হাজার মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যরে সেতুর জন্য আলাদা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে। একইভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল সড়ক, নদী বা সড়কের তলদেশ দিয়ে নির্মিত টানেল বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে নির্মিত সড়কেও টোল দিতে হবে।

বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা সাংবাদিকদের জানান, এ নীতিমালা বাস্তবায়নের কোনো তারিখ বেঁধে দেওয়া হয়নি জানিয়ে মোশাররাফ বলেন, ‘সড়ক বিভাগ তাদের সুবিধামতো সময়ে পর্যায়ক্রমে এটা বাস্তবায়ন করবে। এটা ওভারনাইট বাস্তবায়ন করা যাবে না।’ তিনি বলেন, জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা মহাসড়কের পাশাপাশি জাতীয় মহাসড়কের মধ্যে ‘গুরুত্বপূর্ণ সড়ক-মহাসড়ক’ নামে আরো একটি ক্যাটাগরি করা হয়েছে। সরকার বিভিন্ন সময় এসব ‘গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক’ নির্ধারণ করবে। বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে ‘বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক’ হিসেবে চিহ্নিত। সচিব আরো বলেন, সড়ক ও সেতু থেকে আদায় করা টোল সড়ক উন্নয়ন তহবিলে যাবে; যা দিয়ে সড়ক কাঠামোর উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। তিনি বলেন, টোল আদায়ের পদ্ধতিকে স্বচ্ছ, আধুনিক ও যুগোপযোগী করতেই এ নীতিমালা।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, বড় গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়কের জন্য ‘অপারেশন অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট’ পদ্ধতিতে টোল আদায় করা হবে, যা উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে বর্তমানে এ পদ্ধতিতেই টোল আদায় করা হচ্ছে। অন্য ক্ষেত্রে উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে টোল আদায় করা হবে। নিলামে টোল আদায় করা না গেলে বিভাগীয় সিদ্ধান্তে টোল আদায় করা হবে। তবে এটি সাময়িক ব্যবস্থা। দুটি সেতু কাছাকাছি হলে সময় বাঁচাতে এবং যানজট কমাতে দুই সেতুর টোল এক জায়গায় সংগ্রহ করা হবে। সচিব আরো বলেন, ‘টোলের বিদ্যমান হার বাড়লেও সিগনিফিক্যান্ট কোনো ইমপ্যাক্ট হবে না। দ্রব্যমূল্যের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। আদায় করা টোলের পরিমাণ আমাদের ওভারঅল জিডিপির তুলনায় অনেক কম।’

সরকারের এ পদক্ষেপের সমালোচনা করে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সড়ক-মহাসড়কে টোল ধার্য্য করা হলে তা বহন করতে হবে সাধারণ মানুষকে। বিদ্যুতের দাম বাড়ার রেশ কাটতে না কাটতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আমরা হতবাক। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এ ধরনের জনবিরোধী সিদ্ধান্ত আমরা আশা করিনি। সরকারের টোল আরোপের ফলে বাস ভাড়া বাড়বে, পণ্য পরিবহন খরচ বাড়বে। সব মিলিয়ে একটা অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হবে।’

সড়ক বিভাগের সচিব এম এ এন ছিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, আগে একেক সময় একেক সেতুর টোল আদায়ের জন্য বারবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে যেতে হতো। স্থানীয় জনগণ আবার তা মানতেন না। এ কারণে টোলের হার নির্ধারণ নিয়ে সময় ক্ষেপণ ও নানা তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হতো। এ জন্য টোল আদায়ের নীতিমালাটি করা হয়েছে। তাতে সব বিষয় সমন্বয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। মহাসড়কে রিকশা ও ঠেলাগাড়ি চলাচল নিরুৎসাহিত করতে টোলের হার নির্ধারণ করা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

টোল নীতিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে মহাসড়ক ব্যবহারে এর আগে টোল আরোপ করা হয়নি। তাই বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করে বিধানটি চালু করা হচ্ছে।(দৈনিক কালের কণ্ঠ)

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top