সকল মেনু

কৃষকরা মহাসড়ক অবরোধ করেও সেচের পানি পাচ্ছে না

মো. আমিরুজ্জামান, নীলফামারী , ১৭ মার্চ (হটনিউজ২৪বিডি.কম) : একদিকে ভারতের কাছ থেকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়া অন্যদিকে তিস্তার ভারত অংশে গজলডোবা ব্যারেজের সব গেট বন্ধ করে দেয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এ মুহূর্তে সেখানে সাড়ে তিন হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ কিউসেক। যা চাহিদার মাত্র ১৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। ফলে উত্তরাঞ্চলের তিন জেলার ১২ উপজেলার ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টরে বোরো চারা সেচের অভাবে মরে যাচ্ছে। অসহায় কৃষক হাপিত্যেস করে ধর্ণা দিচ্ছেন পাউবোর কাছে। সড়ক- মহাসড়ক অবরোধ করে চলছে কৃষকদের বিক্ষোভ সমাবেশ। পানি দেয়ার জন্য পাউবো টাকা নিয়ে পড়ে গেছে বেকায়দায়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তা এখন অনেকটাই মরা খাল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিস্তার মরণদশার একমাত্র কারণ চুক্তি অনুযায়ী পানি না পাওয়া। ভারত নীলফামারীর ডালিয়ার তিস্তা ব্যারাজের ৬৫ কিলোমিটার উজানে কুচবিহার জেলার মেকলিগঞ্জ থানার গজলডোবা নামক স্থানে ব্যারাজ দিয়ে তিস্তার পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়ায় তিস্তার বাংলাদেশ অংশ সরু খালে পরিণত হয়েছে। ফলে প্রতিবছর প্রয়োজনের সময় তিস্তার বাংলাদেশ অংশ পানিশুন্য থাকে। আর অসময়ে পানি ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন না থাকলেও বর্ষায় দেখা দেয় বন্যা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, তিস্তার পানি হিস্যার বিষয়টি জেধারসির বৈঠকে তুলে ধরার চেষ্টা হলেও আজও এর কোন সুরাহা হয়নি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের জোরালো চাপ সৃষ্টির পরও ভারত সরকারের সাথে আজ পর্যন্ত কোন দ্বিপক্ষীয় চুক্তি কার্যকরও হয়নি। ১৯৯৬ সালের সমঝোতা অনুযায়ী শুষ্ক মওসুমে ভারত ৪০ শতাংশ, বাংলাদেশ ৩৫ শতাংশ এবং স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে ২০ শতাংশ পানি ছাড়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। পাউবো বলছে, ’৯৬ সালে সমঝোতার পর আজ পর্যন্ত তিস্তার ভাগ্যে ১০ শতাংশ পানিও জোটেনি।

পাউবো সূত্রে প্রকাশ, এবার শুষ্ক মওসুমের শুরুতেই ভারত গজলডোবার সব কটি গেট বন্ধ করে দেয়ায় তিস্তায় পানির প্রবাহমাত্রা বিগত ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কম। প্রাপ্ত তথ্যে প্রকাশ, ১৯৬১ থেকে ’৬৭ সালের ফেব্র“য়ারি মাসের প্রথম থেকেই তিস্তায় পানির প্রবাহমাত্রা ছিল ৪ হাজার ৬৭০ কিউসেক। কিন্ত চলতি মওসুমের ফেব্র“য়ারি মাসের প্রথম থেকেই তিস্তার পানি প্রবাহমাত্রা মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ কিউসেকের মধ্যে উঠানামা করছে। একদিকে গজলডোবার গেট বন্ধ অন্যদিকে বিগত দিনগুলোর চেয়ে চলতি বোরো মওসুমের শুরু থেকেই চলছে অনাবৃষ্টি। ফলে তিস্তায় পানির অভাবে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার কালিগঞ্জ জিরো পয়েন্ট গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার বাহাদুরাবাদ ঘাটের ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত ১৫২ কিলোমিটার নদী অববাহিকায় তৈরি হয়েছে স্মরণকালের ভয়াবহ বালুচর।

এদিকে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের তিস্তা অববাহিকায় পানির স্তর মারাত্মক নিচে নেমে গেছে। ডোবা, নালা, জলাশয়গুলো শুকিয়ে গেছে। টিউবওয়েল, বিদ্যুৎচালিত মোটর ও ডিজেল চালিত শ্যালো মেশিনেও পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। নদীর নাব্যতা ধরে রাখা তো দূরের কথা পানি শুন্যতায় তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় বোরোর ভরা মওসুমে মারাত্মক সেচ সংকট দেখা দিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, প্রকল্পের প্রথম ধাপে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার ৮৬ হাজার ৭৫৯ হেক্টরে সেচ সুবিধা দেয়ার কথা থাকলেও এবার ৬০ হাজার ৫০০ হেক্টর এর আওতায় আনা হয়েছে। এই পরিমাণ বোরোর জমিতে সেচ দিতে ক্যানেলে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার কিউসেক পানির প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন। সেচ সুবিধা দিতে কৃষক সমিতির মাধ্যমে বোরো মওসুমের শুরুতেই প্রতিবিঘার জন্য ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা হারে আগাম টাকাও জমা নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্ত পানি না থাকায় তারা পানি দিতে পারছে না।

প্রকল্পের উপর নির্ভরশীল বোরো চাষিদের এ কারণে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। বোরো চারা লালচে হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। কোথাওবা মরে যাচ্ছে। কম খরচে এবং যথাসময়ে উন্নত সেচ পাওয়ার জন্য তারা প্রকল্পের অধীনে বোরো চাষে উদ্যোগী হলেও এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। ডালিয়ার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা কৃষকদের শুধু আশ্বাসই দিচ্ছেন। কিন্ত কোনো সমাধান মিলছে না। বোরো চাষিরা পানির জন্য ধর্ণা দিচ্ছেন পাউবোর আওতাধীন সেচ প্রকল্পের অফিসগুলোতে। চলছে আন্দোলনও। কিন্ত কোনো কাজ হচ্ছে না।

গত ৩ মার্চ ও ৫ মার্চ দু’দফায় বোরো জমিতে পানির দাবিতে প্রকল্পের ক্যাচমেন্ড এরিয়ার দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার ফতেজংপুর ইউনিয়নের দেবীগঞ্জে রংপুর- দিনাজপুর মহাসড়ক ৫ ঘন্টা অবরোধ করে রাখে চাকলা, বাঙ্গালপাড়া, দেউল, হাশিমপুর, পাইকারপাড়া, চক সন্যাসী, দেবীগঞ্জ, বেকিপুল, ডাঙ্গারহাট এলাকার শত শত কৃষক। সরকারি কর্মকর্তাদের আশ্বাসের পরেও সেখানকার কৃষকরা পানি পাচ্ছেন না। আন্দোলনরত কৃষক আবদুস সামাদ, নওশাদ হোসেন, বিমল কুমার ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, পানি দিতে না পারলে আগে বললে হতো। আমরা টাকাও দিলাম। ক্যানেলের পানির জন্য জমিতে ধানও লাগালাম। এখন মাঝপথে এসে বলছে পানি নেই। তাহলে আবাদ কিভাবে হবে। আবাদ না হলে পরিবার- পরিজন নিয়ে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া পয়েন্টের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, ভারত গজলডোবার সব কটি গেট বন্ধ করে দেয়ায় তিস্তায় পানির তিস্তায় পানির প্রবাহমাত্রার এই করুণ দশা। রোটেশনের মাধ্যমে কৃষকদের পানি দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানেরও তাগিদ দেন তিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাব-ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার হাবিবুর রহমান জানান, ক্যানেল এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন সার্বক্ষণিক কাজ করছেন যাতে কৃষকরা পানি পায়। নদীতে পর্যাপ্ত পানি আসলে কৃষকদের আর কোন সমস্যা থাকবে না উল্লেখ করেন। অপরদিকে তিস্তা সেচ ক্যানেলে পানির দাবিতে রংপুরে গঙ্গাচড়ায় কৃষকরা গত ১৩ মার্চ খলেয়া গঞ্জিপুর এলাকায় সড়ক অবরোধ করে। এসময় রংপুর- ডালিয়া মহাসড়ক ২ ঘন্টা চলাচল বন্ধ থাকে। বোরো আবাদের মৌসুমে তিস্তা সেসচ ক্যানেলে পানির প্রবাহ প্রায় শুন্যের কোঠায়। পানির জন্য কৃষকদের মাঝে হাহাকার বিরাজ করছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top