সকল মেনু

বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও পরিবর্তন

সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রতিবেদক, ১৯ ফেব্রুয়ারি (হটনিউজ২৪বিডি.কম) :  অনেক দিন ধরে পত্রপত্রিকায় ভুল-ভাল বাংলার ব্যবহার দেখে প্রায় গা সওয়া হয়ে আসছিল। ইদানীং ব্লগারদের আধিপত্যে এই বিকৃতি আরও ব্যপকতর হয়েছে। এমন কি যে সব ব্লগার নিজেকে ‘লেখক’ ‘সাহিত্যিক’ হিসেবে পরিচিত করিয়ে দিতে চান তারাও এর ব্যতিক্রম নয়। এই বিষয়টি নিয়ে হয়তো অনেকেই লিখছেন, লিখবেন। তবে এখনো বিষয়টি নিয়ে লেখার সুযোগ আছে বিধায় আমি কয়েকটি কথা- অক্ষর, শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করার লোভ সামলাতে পারছি না।

আমি বাংলা ভাষা সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্র নই। তবে কিঞ্চিৎ লেখালেখির সূত্রে উৎসাহী শিক্ষার্থী মাত্র। মধুমাস বলতে, ছোটবেলা থেকে ফাল্গুন মাস বা বসন্তকাল বলেই জেনে এসেছি। যদিও দু’ একবার কাউকে কাউকে ‘জ্যৈষ্ঠ মাস’ উল্লেখ করতে দেখেছি। বিশেষ গা করিনি! শুধু প্রতিমার ঐ গানই নয়, অসংখ্য গানে কবিতায়ই তো ‘মধুমাস’ এসেছে। শচীন কর্তার ‘বঁধু গো এই মধুমাস বুঝিবা বিফল হল/ ভুলে গেছ তুমি সেই মধুনামে ডাকা’ অতি প্রিয় গান আমার। যাহোক…
পত্রপত্রিকার, সিনেমা, টিভি বা মিডিয়ার প্রভাবে ভুল বানান বা ভাষার প্রয়োগ, আমার মতে, বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড বা ব্যক্তিগত চিঠিপত্র (যদিও চিঠিপত্র জাদুঘরে যেতে চলেছে) লেখকদের পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পারে। মূলধারার সাহিত্য বা লেখকদের প্রভাবিত করতে পারার কারণ দেখি না। আধুনিক সমাজে উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই মিডিয়ার ক্ষমতা অতিরঞ্জিত করে দেখান হয়। তবে সমস্যা হতেই পারে যদি এই মিডিয়া প্রভাবিত ভাষাজ্ঞানহীন পাবলিকরা কাছা দিয়ে সাহিত্য চর্চায় নেমে পড়েন। আজকাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সাংবাদ লেখক’ হওয়ার বিদ্যাশিক্ষার সর্বোচ্চ সনদধারিরাও আকছার ভুল-ভাল লিখছেন। সাধারণ লোকের ভাষার বিকৃত প্রয়োগ মার্জনা যোগ্য হলেও লেখা যাদের পেশা, যেমন সংবাদ লেখক, কবি, সাহিত্যিক, এদের অজ্ঞতাজনিত ভুল লেখা ক্ষমার অযোগ্য।
ভুল বানানের আপনার তালিকার বাইরেও আরও বেশি বহুল প্রচলিত শব্দ আছে। যেমন: দৈন্যতা, দরিদ্রতা, সখ্যতা, জোনাকী, অঞ্জলী থেকে অশুদ্ধ শ্রদ্ধাঞ্জলি কে আশ্লীল করে ‘শ্রদ্ধাঞ্জলী’ অহরহ দেওয়া হচ্ছে। ‘দুর্নীতি’ শব্দটা খুবই কমই দেখা যায়। সর্বত্র দীর্ঘ-উ দিয়ে লেখা ‘দূর্নীতি’র ছড়া ছড়ি। রাজশেখর বসু’র ভুল বানানের তালিকার মধ্যে সব থেকে স্বল্প-সমালোচিত শব্দ মনে হয় ‘আশীষ’। বাংলাদেশে ‘আশীষ’ (খন্দকার) ও থেকে ‘শুভাশীষ’ (ভৌমিক) প্রায় দুই কুড়ি লোক জানি ভুল বানানে নিজ নাম নির্ধারিত করে জীবনাতিপাত করছে। এতে তাদের বা সমাজের ইতর বিশেষ হচ্ছে বলে মনে হয় না। বরং আমি একজনের নামের বানানের শুদ্ধতার কথা বলে বিপদগ্রস্ত হয়েছিলাম। এই ‘গ্রস্ত’ কে এখনও ‘গ্রস্থ’ (বিপদগ্রস্থ, বাধাগ্রস্থ, কণ্যাদায়গ্রস্থ) লেখার সমস্যাগ্রস্ত বাংলাদেশের মোটামুটি সব পত্রপত্রিকা। কোন কোন সংবাদ লেখক আরও এক কাঠি এগিয়ে শব্দটাকে দুই শব্দে (বিপদ গ্রস্থ) লেখেন। একবার শুধু ‘গ্রস্থ’ গুগল-সার্স দিয়ে মনে হয় ৩ হাজারের মত এরকম ‘ইত্যাদি গ্রস্থ’ রেজাল্ট পেয়েছিলাম। এর বিরাট অংশই দৈনিক পত্রপত্রিকার সাইট! এক সময়ে ড. আহমেদ শরীফ তার সাপ্তাহিক ‘আড্ডা’য় সাংবাদিকতার পেশার লোকদের অর্ধশিক্ষিত বললে খারাপ লাগত। এখন সুযোগ পেলে আমি নিজেই বলি।
তবে একথা ঠিক রাজশেখর বসুর তালিকার অধিকাংশ শব্দই এখন ‘ভুল’ প্রয়োগের ব্যাপক প্রচলনজনিত কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ ভাষার ‘পরম বিশুদ্ধতাবাদী’দের প্রচেষ্টা বিফলে গেছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ভুল বানান বা ভুল প্রয়োগ যেমন সমর্থন করি না, তেমনি ‘পরম বিশুদ্ধতাবাদী’ হওয়াও সমর্থন করি না। ভাষা গাণিতিক বিজ্ঞান নয়। মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে এর পরিবর্তণ হবেই। সমস্ত নিয়ন-কানুন আইনই পরিবর্তনের শর্তসাপেক্ষ। আর তাই আমাদের ভাষার ও বানানরীতি জানা ও শেখা দরকার তা পরিবর্তনের জন্যই, বা পরিবর্তন সামাল দেওয়ার জন্যই। এই দ্বৈতাদ্বৈতের মধ্যেই ভাষার শুদ্ধতা এবং পরিবর্তন বোঝা উচিত।
তাছাড়া আজকের বিশ্বে ‘পিওর সাইন্স’ বা বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলেও কিছু আছে কিনা সন্দেহ। কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের এমন কোন শাখা নেই যেখানে মানুষের মনের মাধুরীর ছোঁয়া লাগেনি। আর তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার মনের মাধুরি মিশিয়ে সচেতন ভাবেই অসংখ্যবার অশ্রুজল (‘বিষাদের অশ্রুজলে, নীরবের মর্মতলে গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নূতন বাণী’ বা ‘তারি লাগি যত ফেলেছি অশ্রুজল, বীণা বাদিনীর শতদল দলে করিছে সে টলোমল’) লিখেছেন। শুধু কাব্য বা গানেই নয়, গদ্যেও ‘অশ্রুজল’-এ তিনি মুক্তহস্ত।  ‘সুভা’ গল্পে যত্রতত্র ‘অশ্রুজল’ লিখেছেন (‘কিন্তু অশ্রুজল ভর্ৎসনা মানিল না’, ‘দুই নেত্রপল্লব হইতে টপ্‌ টপ্‌ করিয়া অশ্রুজল পড়িতে লাগিল’, ‘শুক্তির মুক্তার ন্যায় বালিকার অশ্রুজল কেবল বালিকার মূল্য বাড়াইয়া দিল’)। যদিও ‘কাবুলিওয়ালা’ তিনি একবারই লিখেছেন। ‘সকাতরে’ শব্দটাও অকাতরে ব্যবহার করেছেন রবিঠাকুর। ‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে শোনো শোনো পিতা’, তরুণ বয়েসে লেখা ব্রহ্মসংগীত।  এছাড়া ববীন্দ্রনাথের একই বাক্যে একাধিক বহুবচনের ব্যবহারও দেখেছি। বাংলায় যা ভয়াবহ রকম অশুদ্ধ। এটা সম্ভবত: বেখেয়ালের ভুল। আবার রবীন্দ্রনাথ ‘বাঙালী’কে ‘বাঙালি’ লিখেছেন বলে অনেকেই অন্ধের মত সেটাই অনুকরণ করেন। ড. আহমেদ শরীফ  হ্রস্ব-ই দিয়ে ‘বাঙালি’ লিখতে অস্বীকার করেছিলেন। আবার ‘হিসাব’ কে অনেকে ‘হিশাব’ লেখেন, আহমেদ শরীফ এটা ফার্সি (হিছাব) থেকে আসা শব্দ বলে ‘শ’ ব্যবহারের বিরোধিতা করেছেন।
সুতরাং, বেচে থাকলে রাজশেখর বসু হয়তো এ সব তালিকা আরও দীর্ঘ করতেন না, হয়তো দেখে শুনে পরিবর্তনের ব্যাকরণ বুঝে নিজেকেই নিজে বলতেন এরকম ‘হয় হয়, জান্তি পার না’ মন। আর এরকম অশুদ্ধ দুর্বৃত্ত শব্দসমূহ ‘শুদ্ধ’ বনে অভিধানে স্থান পাওয়া  ‘যুক্তিসংগত হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন’ যারা তাদের এইটুকুই বলা যায় যে, এইটাই জগতের রীতি, গণপ্রয়োগে বেআইনও আইন হয়ে যায় আবার অশুদ্ধ শব্দ শুদ্ধ হয়ে বৈধতা পেয়ে যায়। এমন কি অস্তিত্বহীন শব্দও (নতুন শব্দ হয়ে) অভিধানভূক্ত হয়ে যায়। সব ভাষাতেই এটা হয়।  আমরা যারা যৎকিঞ্চিৎ সাধনা করেছি ভাষা শিক্ষায় তাদের কষ্ট লাগারই কথা। কিন্তু এর ইতিবাচিক দিকও আছে নিশ্চয়ই। জীবন্ত ভাষা প্রতি নিয়ত রূপান্তরিত হওয়ার মধ্যে দিয়েই বিকশিত হয়। ভাষার আইন-কানুন অনমনীয় রকম কঠোর হলে তার মৃত্যুও আসন্ন হয়ে পড়ে।
গত দশ বছরে শতখানেক নতুন শব্দ ‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি’ তে স্থান পেয়েছে। বহু পুরনো শব্দ পরিবর্তিত হয়ে কিংবা সম্পূর্ণ অর্থহীন শব্দও ‘পপুলার কালচার’, ‘সাবকালচার’ থেকে বা হাল আমলের ইন্টারনেট এসমএস, মেসেজিং-এ ‘স্ট্রীট-ল্যাঙ্গুয়েজ’র ব্যাপক ব্যবহারে মাধ্যমে অবশেষে নতুন শব্দ আকারে ডিকশনারিতে স্থান করে নিচ্ছে। তবে সেগুলো অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ‘বিনাবাক্যব্যয়ে স্থান পেয়েছে’ বলে মনে হয় না।  গত দশ বছরে ডিকশনারিতে স্থান পাওয়া কয়েকটা শব্দ দিচ্ছি: ১। hottie (also hotty)  – sexy looking (young) girl. 2। Bromance – a close but non-sexual relationship between two men.  ৩। Buzzkill – a person or thing that has a depressing or dispiriting effect. ৪।Cheeseball – calm down and relax. ৫। Frenemy – a person with whom one is friendly despite a fundamental dislike or rivalry.
লেখক: হৃৎকমল

 

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top