সকল মেনু

হায়রে অভাগী!

xgolpo20131027225900.jpg.pagespeed.ic.PMMxqWi4yj শানজানা জামান আনভি, হটনিউজ২৪বিডি.কম: মেহেদী রাঙা হাতের দিকে তাকিয়ে নাজুক হাসি হাসছে অভাগী। পরক্ষণেই চারপাশে তাকালো কেউ দেখতে পাচ্ছে কিনা। তারপর আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কাজে মন বসছে না যে তার। হাতদুটো যখন মেশিনের কাছে চলে আসে তখনই চোখে পরে যায়। তাকিয়ে থাকতে বড্ড ইচ্ছে করে! বড্ড বেশি সুন্দর লাগছে যে হাতটা। শুধু তাকিয়ে থাকতে আর স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। গত পরশু যে তার বিয়ে হল! অনেক স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করছে তার! মনের মধ্যে অনেকগুলো স্বপ্ন তৈরি করেও রেখেছে। অসংখ্য ছোট ছোট স্বপ্ন, যা দিয়ে সাজাবে ছোট্ট বাসাটি।

জন্মের দুদিন পূর্বে তার বাবা মারা গিয়েছিল। তাই মা তার নাম রেখেছিল অভাগী। কিন্তু জ্ঞান হবার পর থেকে যখন অভাগীর মানে বুঝতে পারল, লোকেরা এই নামে ডাকলেও তার কোন রকম মন খারাপ হত না। সে আপন মনে উড়ে বেড়াতো। কিশোরী অভাগি পরিবারের হাল ধরতে থাকে। স্বপ্ন দেখতে থাকে কিভাবে পরিবারকে এগিয়ে নেওয়া যায়। যখন যৌবনে উপণিত হল তখন আরও নতুন নতুন স্বপ্ন দেখতে লাগলো। তার সবগুলো স্বপ্ন যেন সত্যি হয়ে যায়। এজন্য লোকে যখন তাকে অভাগী নামে ডাকে সে মোটেও মন খারাপ করে না। বরং মনে মনে হাসে শুধু। অভাগি হাতদুটো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে।

‘অভাগী!’
চমকে উঠে ফিরে তাকালো অভাগী।
‘কিরে, কি করতাছস তুই?’-বলল অভাগির বান্ধবী জোছনা।
বলে, কিছু না তো। কাজ করছি দেখতাছস না।
হঃ, অভাগীর কাছে এসে ওর থুতনি ধরে বলে জোছনা-আইজ আইলি যে। না আসলে তো পারতি।
হু, কাল মাল ডেলিভারি দেওয়ার কথা। আরও তো অনেক কাজ বাকি। না আসলে হইব নাকি?
বান্ধবীটি বলল, কামের লোকের অভাব আছে? তোরই আসতে অইব? তারপর একটু আস্তে বলল, বেতন পাস নাই বুঝি।
অভাগী একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, আজ দিয়া দিব বলছে।
অ, আইচ্ছা। মন দিয়া কাম কর। দেখিস হাতে যেন সূই না ঢুকে। তাইলে তো সব্বনাশ হইয়া যাইব। নাগরের চিন্তা পরেও করন যাইব।
অভাগী নাজুক হাসিতে বলল, এই যা!
অইছে। আর লজ্জা পাইতে হইব না, এই বলে হাসতে হাসতে চলে গেল সে।
অভাগী এবার কাজে মন দেয়। তারপর ঘড়ির দিকে তাকায়। তিনটা বাজে তখন। মনে মনে ভাবে, পাঁচটা বাজতে আরো দুই ঘন্টা! মুখে একটা অধৈর্যের ছাপ ফুটিয়ে তুলে আবার কাজে মন বসালো।

মেশিন চলছে। উদ্দাম গতিতে হাত-পা চালাচ্ছে কর্মিরা। চারপাশ থেকে মেশিনের আওয়াজে কান ভারী হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা যেন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। তবে এই প্রতিযোগিতায় আলাদা কোন পুরষ্কার নেই। তাতে কি? কাজ চলছে তো চলছেই।

কিছু কিছু মেশিনের আওয়াজ বাহির থেকে শোনা যায়। শহরের শত শত পথচারী কারখানার পাশ ঘেষে চলাচল করছে। কারো কারও কানে এ শব্দ পৌছায়, আবার কারোর কাছে পৌঁছায় না।

বেলা তিনটা পনের। হ …ঠা….ৎ….!!!

হঠাৎ প্রকাণ্ড ভয়ংকর শব্দ! রাস্তার চারপাশের মানুষ ভয়ে এদিক-সেদিক ছুটে পালাচ্ছে। তারা ছুটছে আর শুনতে পাচ্ছে কিছু একটা ধসে পরার শব্দ। আর মানুষের আর্তনাদ, আর্তনাদ আর আর্তনাদ! কিছুদূর অতিক্রম করার পর যখন পেছনে তাকালো, দেখতে পেল চারপাশের আকাশে-বাতাসে ধুলো আর ধূলো। আর দশতলা বিল্ডিংটার ধ্বংসস্তূপ! শুনতে পাচ্ছে মানুষের ভয়াবহ আর্তচিৎকার! বাচাও! বাঁচাও! আল্লাগো! মাগো!

মানুষগুলো এবার পাগলের মতো ছুটে আসছে। এবার তারাও অসহায়ের মতো চিৎকারে ফেটে পড়ছে। ঝাঁপিয়ে পড়ছে উদ্ধারে। কেউ কেউ চিৎকার করে বলছে এম্বোলেন্স! ডাক্তার! কেউ কেউ আহতদের কোলে নিয়ে দিশাহারা পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছে! কেউ কেউ বলছে ঐ দিকে হাসপাতাল! ঐ দিকে! ঐ দিকে!

ভাঙ্গা স্তূপের একটু ফাক দিয়ে সূর্যের হালকা আলো পরছে অভাগীর রাঙা হাতে। তার চোখের সামনে রাঙা হাতটি ভাসছে। সমগ্র শরীর ইটের স্তূপে চাপা পড়েছে। অসাড়, নিস্তেজ অভাগীর নিঃশ্বাস বন্ধ!
হাতের কাটা অংশ থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরছে। ওর মনে হচ্ছে, কারা যেন জোর করে তার হাতে মেহেদী লাগাচ্ছে। খুব যন্ত্রনা হচ্ছে তার। সে চিৎকার করে বলছে, তোমরা হাতে মেহেদী দিও না! আমার লাগবো না। তোমরা কি দেখতে পাও না আমার হাতে মেহেদী আছে। দুইদিন আগেই তো মেহেদী দিছি। দেখ, আমার হাত এখনও রাঙ্গা। ও বলেছিল হাতের রং ঊঠে গেলে আমারে আরও মেহেদী কিনে দিব। ও নিজের হাতে আমারে মেহেদী লাগিয়ে দিব। তখন আমি ওর মুখের দিকে মায়া ভরা চোখে তাকাইয়া থাকবো। তোমরা লাগাচ্ছো কেন? বলছি তো লাগবো না! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। খূব কষ্ট……

অভাগীর লাশটা এক স্থানে শোয়ানো হলো। তার সমস্ত শরীর সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। অভাগী বোঝতে পারল সে এখন মৃত! তবে চারপাশটা ঠিকই দেখতে পাচ্ছে সে। সে দেখতে পাচ্ছে তার দুই পাশে দুইজন সম্মানি ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন। তার মাথার কাছে একটা নান্দনিক চেয়ার। আর অদূরে দাঁড়িয়ে আছে কিছু সংখ্যক মানুষ। যাদের পাশে তার স্বামীও দাঁড়িয়ে আছে অশ্রুসিক্ত নয়নে। তাকে তার কাছে আসতে দেয়া হচ্ছে না। কিছু পুলিশ তাদেরকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু কেন? তাকে একটু কাছে আসতে দিলে কি হয়?

ক্ষণেই সে ধারনা করতে পারলো, আগে এই সম্মানী ব্যক্তি দুইজন দেখবে। তারপর নিজেরা মর্মাহত হয়ে সবাইকে সান্তনা দিবে। তারপর তার স্বামীকে কাছে আসতে দিবে। এর আগে অন্য কেউ নয়!

সে আবার তাকালো সম্মানীদের দিকে। চমকিয়ে গেল সে! তাদের কেউ-ই তার দিকে তাকাচ্ছে না! তাদের চোখে দয়া-মায়া-ভালবাসা বিন্দুমাত্র নেই! তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে হিংসা আর ক্রোধ নিয়ে! আর একটু পর পর নজর রাখছে ঐ চেয়ারটায়!
তাদের চোখ অন্য এক ধাতু দিয়ে গড়া। এক ফোটা অশ্রুর চিহ্নও নেই তাদের চোখে!

তাদের এই কাণ্ড-কারখানা দেখে কেঁদেই ফেলল অভাগী। আর চিৎকার করে বলতে লাগলোঃ হায় ঈশ্বর! শেষ পর্যন্ত এই দৃশ্যও দেখাইলা আমারে!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top