সকল মেনু

খবর পড়ছে এআই, ঝুঁকিতে টিভি উপস্থাপকদের চাকরি?

বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) বা এআই’র ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে একদিকে যেমন কার্যসম্পাদনের সময়, শ্রম ও খরচ কমে যাচ্ছে, তেমনি হুমকির মুখে পড়ছে বিভিন্ন পদে মানুষের চাকরি। তেমনই একটি পদের নাম সংবাদপাঠক বা টিভি উপস্থাপক।

২০১৮ সালে চীনের শিনহুয়া বার্তা সংস্থা চালু করেছিল বিশ্বের প্রথম এআই পরিচালিত সংবাদপাঠক। এতে ব্যবহার করা হয়েছিল কম্পিউটার গ্রাফিকস। কিন্তু চলতি বছর সংস্থাটি প্রকাশ্যে এনেছে তাদের প্রথম এআই-পরিচালিত সংবাদপাঠিকা। গত মাসে রাশিয়ার সভয়ে টিভি তাদের প্রথম ভার্চুয়াল আবহাওয়া উপস্থাপক হিসেবে ‘স্নেজানা তুমানোয়া’কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।

এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই প্রতিবেশী ভারতও। গত এপ্রিল মাসে দেশটির অন্যতম বৃহত্তম মিডিয়া গোষ্ঠী ইন্ডিয়া টুডে তাদের প্রথম ফুলটাইম এআই সংবাদপাঠিকা হিসেবে ‘সানা’কে সামনে আনে। সুন্দরী নারী মুখোচ্ছবির এই সংবাদপাঠিকাকে আজ তাক চ্যানেলে দিনে একাধিকবার খবর পড়তে দেখা যাচ্ছে।

গত রোববার (৯ জুলাই) আরও একটি এআই সংবাদপাঠিকার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে ভারতীয় চ্যানেল উড়িষ্যা টিভি (ওটিভি)। চ্যানেলটির নতুন এই সংবাদপাঠিকার নাম ‘লিসা’। পরনে শাড়ি, কপালে টিপ, কানে দুল আর মুখে মৃদু হাসি নিয়ে ওড়িয়া এবং ইংরেজি ভাষায় খবর পড়ছে লিসা।

এআই সংবাদপাঠকের সুবিধা

মিডিয়া হাউজগুলোর জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর সংবাদপাঠক ব্যবহারের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন-

ক্রমাগত সংবাদ কভারেজ: এআই সংবাদপাঠকরা মানুষের মতো ক্লান্তি বা শিডিউল জটিলতা ছাড়াই দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সংবাদপাঠ করতে পারে। এটি সার্বক্ষণিক কভারেজ এবং দর্শকদের কাছে তথ্যের সময়মতো প্রচার নিশ্চিত করে।

ভাষাগত দক্ষতা: এআই সংবাদপাঠকদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক একাধিক ভাষায় সংবাদ প্রচার সম্ভব। ফলে কার্যকরভাবে এটি বিস্তৃত শ্রোতা শ্রেণির কাছে পৌঁছাতে এবং সামগ্রিক প্রচারণায় সাহায্য করে।

ধারাবাহিকতা এবং নির্ভরযোগ্যতা: এআই সংবাদপাঠকরা পূর্বনির্ধারিত শৈলী ও মানদণ্ড মেনে ধারাবাহিকভাবে সংবাদ সরবরাহ করতে পারে। এটি মানবিক ত্রুটির (হিউম্যান এরর) আশঙ্কা কমায় এবং দর্শকদের কাছে নির্ভরযোগ্য সংবাদ সরবরাহ নিশ্চিত করে।

রিয়েল-টাইম ডেটা প্রসেসিং: এআই সংবাদপাঠকদের রিয়েল-টাইমে প্রচুর পরিমাণে ডেটা প্রক্রিয়াজাত করার ক্ষমতা রয়েছে, যা দ্রুত বিশ্লেষণ ও জটিল তথ্য উপস্থাপনে সক্ষম। যেমন- লাইভ নির্বাচনের ফলাফল, আর্থিক আপডেট বা খেলাধুলার স্কোর সম্প্রচার।

চ্যালেঞ্জ ও উদ্বেগ

এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এআই সংবাদপাঠ মিডিয়ার জন্য বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ ও উদ্বেগ তৈরি করেছে। এর মধ্যে রয়েছে-

মানবিক উপাদানের অভাব: এআই সংবাদপাঠ সম্পর্কিত প্রাথমিক উদ্বেগগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মানুষের আবেগ, অন্তর্দৃষ্টি ও সমালোচনামূলক চিন্তা করার ক্ষমতার অনুপস্থিতি। সাংবাদিকরা প্রায়ই তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, অনুসঙ্গ এবং বিচার সংবাদ প্রতিবেদনে নিয়ে আসেন, যা এআই’র ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।

নৈতিক বিবেচনা: স্বচ্ছতা এবং প্রকাশের বিষয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করে এআই সংবাদপাঠকরা। শ্রোতাদের জানার অধিকার রয়েছে, তারা কোনো মানুষের সংযুক্ত হচ্ছেন নাকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। এক্ষেত্রে আস্থা ও নৈতিকতার মান বজায় রাখতে স্পষ্ট যোগাযোগ এবং স্বচ্ছতা অপরিহার্য।

বিশ্বাসযোগ্যতা ও পক্ষপাত: এআই সংবাদপাঠকরা অ্যালগরিদম ও প্রি-প্রোগ্রামড ডেটার ওপর নির্ভরশীল। এটি পক্ষপাত বা ভুল তথ্য সম্পর্কিত উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। নির্ভুলতা, ন্যায্যতা এবং নিরপেক্ষ প্রতিবেদন নিশ্চিত করা এআই সিস্টেমের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: মানবিক আচরণ, সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বোঝা বা অলিখিত পরিস্থিতি পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে এআই সংবাদপাঠকরা। অপ্রত্যাশিত ঘটনা বা ব্রেকিং নিউজের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এআই সিস্টেমের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

সাংবাদিকতার চাকরি কি ঝুঁকিতে?

গত মার্চ মাসে চালু হয়েছে বিশ্বের প্রথম শতভাগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর নিউজ চ্যানেল নিউজজিপিটি। চ্যানেলটির সব কন্টেন্টই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্যে তৈরি। এটিকে মিডিয়াকর্মী ও তাদের চাকরির জন্য সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে দেখছেন অনেকে। যদিও নিউজজিপিটির সিইও অ্যালান লেভি এটিকে সংবাদ সম্প্রচারের ক্ষেত্রে গেম-চেঞ্জার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

মিডিয়া সমালোচক শৈলজা বাজপেয়ীর মতে, এআই নিঃসন্দেহে সাংবাদিকতার ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। তবে এর প্রভাবের পরিমাণ নির্ধারণ করার মতো সময় এখনো আসেনি।

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শৈলজা বলেন, এআই অবশ্যই সাংবাদিকতায় স্থায়ী প্রভাব ফেলবে। তবে এটি কতটা গভীর হবে এবং কতটা পার্থক্য তৈরি করবে, তা বলার সময় আসেনি।

ভারতে টেলিভিশনের বিকাশ নিয়ে তিন দশক লেখালেখির অভিজ্ঞতা রয়েছে শৈলজার। তার বিশ্বাস, এআই বটগুলো হয়তো নিউজ বুলেটিন পড়তে পারে। তবে তারা আজকালকার উপস্থাপকদের মতো প্রতিক্রিয়া জানাতে এবং বিতর্ক পরিচালনায় (এখনই) সক্ষম হবে না।

এ বিশ্লেষকের মতে, এআই বটগুলো মানুষের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতার প্রতিলিপি করতে সক্ষম না-ও হতে পারে। তাই ব্যাখ্যামূলক সাংবাদিকতা, গ্রাউন্ড রিপোর্টিং এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি। তিনি বলেন, আমাদের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

সূত্র: ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিন, মিন্ট, কাউন্টার কারেন্টস

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top