কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন সর্বস্তরের জনগণ। বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) সকাল ১০টা ৫ মিনিটে তার মরদেহ শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হয়। এর পরে ১০টা ২২ মিনিটে রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধারা তার লাশকে বহন করে শ্রদ্ধা নিবেদনের প্যান্ডেলে নিয়ে আসেন।
১০ টা ২৭ মিনিটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য এ কে আজাদ চৌধুরীর শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো শুরু হয়। এরপরে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বসাধারণ শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, জাফরউল্লাহ ভাই আমার ছাত্রজীবনের সহযোদ্ধা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সহযোদ্ধা ছিলেন। এই দীর্ঘ সময় মানুষের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে আমাদের যে লড়াই সেই লড়াইয়ে তিনি পাশে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকাার অর্থেই জনযোদ্ধাই ছিলেন তিনি । তিনি শুধু মুক্তিযুদ্ধ শেষ করেননি। এরপরও তিনি মুক্তিযুদ্ধের লড়াই চালিয়ে গেছেন। শুধু দেশের মধ্যে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তার লড়াই ছিল অবিচল। আমাদের দেশের ওষুধ নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তার প্রচেষ্টাতেই আমরা এটিতে লাভবান হচ্ছি। তিনি রাজনীতি করেননি ঠিকই, কিন্তু রাজনীতিতে বিবেকের কন্ঠস্বর হিসেবে তিনি থেকেছেন।
শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই বিদায় আমাদের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে এক বিরাট ক্ষতির কারণ। তিনি শুধু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না শুধু ডাক্তারও ছিলেন না, তিনি আমাদের ইতিবাচক পরিবর্তনে অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। বাঙালি জাতিকে পৃথিবীতে বাঙালি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা জ্ঞান-বিজ্ঞানে জাতিকে ভূষিত করা এবং পৃথীবির সকল মহান কাজে তিনি অগ্র সৈনিক ছিলেন। তার প্রতি আমি আমার ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা জানাই। ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি ওনাকে চিনি। তার পরিবারে আমি গিয়েছি। তার পিতামাতার সাথে আমি খেয়েছি। ভাই বোনের সাথে কথা বলেছি। এ এক অসাধারণ পরিবার। অসাধারণ এর মধ্যে অসাধারণ জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
বেলা সাড়ে ১১টায় বিএনপির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রতিনিধি দল। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে তার অসাধারণ ভূমিকা এবং তার গণস্বাস্থ্যের যে ধারণা সাধারণ মানুষ যেন স্বাস্থ্যসেবা পায় সে জন্য তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। তার হাসপাতাল, ওষুধ নীতি সব কিছুই বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। তিনি সাহসী, স্পষ্টভাষী ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। দেশের মানুষের জন্য কথা বলতে তিনি পিছপা হননি। সমাজকে জনগণের কল্যাণের জন্য তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী খ্যাতিমান মানুষ ছিলেন। তার অনেক প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি নিজেও অনেক সম্মানিত বোধ করতেন। তুমি অত্যন্ত বিনম্র চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। অনেক কারণেই এই মানুষটি মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকবেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি অসাধারণ অবদান রেখেছেন। খুব সরল প্রকৃতির খুব সাদামাটা জীবন তিনি যাপন করতেন। এটা নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়। গণমানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন সেটি অতুলনীয়।
ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর বলেন, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনী অতুলনীয় এবং অনুকরণীয়। এ রকম একজন মহান ব্যক্তি জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাই। তার জীবন মানুষকে অনুপ্রেরণা দিবে। এ রকম একজন মানুষ কিভাবে আজীবন এবং সমাজের জন্য কাজ করে গেছেন। তার জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে আমি মনে করি তার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে।
এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন, অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু তারপরও যে কোন সরকারের আমলে তিনি যেকোনো অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর হিসেবে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী সকল দল মত নির্বিশেষে সকলের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। এটা দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।
শ্রদ্ধা জানানো হলে ডাকসুর সাবেক ভিপি ও জেএসডির নেতা আ স ম আব্দুর রব বলেন, ডা. জাফরুল্লাহ প্রতি আমাদের ঋণ অপরিসীম। তার ঋণ কোনো দিন পরিশোধ হবে না। তার প্রতি জাতির কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিত। বাংলাদেশে আরেকটা জাফরুল্লাহ তৈরি হবে না। আমরা যারা গরীব মেহনতি মানুষের পক্ষে রাজনীতি করি এর বাইরেও সর্বস্তরের মানুষ তাকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে।
এ সময় গণ সংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, জাফরুল্লাহর অনুপস্থিতি বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি করেছে। কিন্তু তার কাজ ও বহুমাত্রিক কীর্তি, দেশ ও মানুষের প্রতি উজার করা ভালোবাসা বর্তমান আমাদের প্রজন্ম ও অনাগত প্রজন্মকে বহুকাল ধরে অনুপ্রাণিত করবে। তার কীর্তি নানাভাবে এই দেশের মানুষের নানা অর্জনের মাধ্যমে প্রকাশিত। মানুষের স্বার্থে একটা পরিবর্তন কীভাবে আনা যায় সেটা নিয়ে ভাবতেন। তিনি সর্বদা মানুষের কল্যাণ, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন নিয়ে ভাবতেন। এসব পরিবর্তনের বিষয়ে যারাই ভাববেন নিশ্চিতভাবে সেখানেই ডা. জাফরুল্লাহ প্রাসঙ্গিক থাকবেন। আমরা যত দ্রুত তার জীবন থেকে শিক্ষা নিতে পারবো তত দ্রুত আমরা এগিয়ে যেতে পারবো।
সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদ মিনারে তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দুপুর আড়াইটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ডা. জাফরুল্লাহর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপরে বিকেল চারটায় ধানমণ্ডির গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আরেকটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়াও শুক্রবার শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য সকাল ১০টায় তার মরদেহ নেয়া হবে সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। জুমার নামাজ শেষে সেখানে তার আরেকটি জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাত ১০ টা ৪০ মিনিটে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ডা. জাফরুল্লাহ। ৮২ বছর বয়সী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন ধরেই কিডনি সমস্যার পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।