ফরেন পলিসি
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারে দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে আসছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং এই অঞ্চলে মার্কিন অংশীদারদের অনুসৃত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। আর এই ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের লক্ষ্য মূলত চীনকে ঠেকানো বা মোকাবিলা করা।
আন্তর্জাতিক সাময়িকী ফরেন পলিসির এক নিবন্ধে এসব কথা লিখেন তিনি। এত আরো বলা হয়, গত মাসে বাংলাদেশ তার নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুকের একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এই খসড়াতে এমন উদ্দেশ্যগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে যাতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের প্রতিফলন ঘটেছে। যেমন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি মুক্ত, নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ অঞ্চলের প্রয়োজন বলে চূড়ান্ত খসড়ায় উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ।
ঢাকা এই পদক্ষেপ এমন এক সময়ে নিয়েছে যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার কয়েকটি প্রধান মিত্রদেশ ইঙ্গিত দিয়েছে, বাংলাদেশেরও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হওয়া উচিত। সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা নয়াদিলিল্গতে বক্তৃতা দেন যাকে এই অঞ্চলের জন্য একটি ‘নতুন পরিকল্পনা’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে তিনি নতুন অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তিসহ বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। এছাড়া চলতি মাসেই যুক্তরাজ্যের ইন্দো-প্যাসিফিক মন্ত্রী অ্যান-মেরি ট্রেভেলিয়ান বাংলাদেশ সফর করেন।
দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ মাইকেল কুগেলম্যান লিখেন, এই দেশগুলো কেন বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে অংশ হতে বলছে তা বোঝা বেশ সহজ। বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত, ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়া ছাড়াও এই দেশটি দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার হিসেবেই কাজ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঢাকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। আবার অনেক ইউরোপীয় দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। এই দুই বাস্তবতার কারণে বাংলাদেশ সবার কাছেই ভালো অংশীদার।
অন্যদিকে চীন অবকাঠামোগত ঋণের মাধ্যমে বাংলাদেশে তার নিজস্ব প্রভাব বাড়িয়েছে। তবে চীনের এই ঋণকে মার্কিন কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ঢাকার জন্য খারাপ চুক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এছাড়া ভারত মহাসাগর অঞ্চলের পশ্চিমাঞ্চলে জিবুতিতে অবস্থিত চীনের সামরিক ঘাঁটিসহ দেশটির বর্ধিত নৌ উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন চীনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা। মূলত এসবই বাংলাদেশের সামুদ্রিক এলাকার কাছাকাছি অবস্থিত। এছাড়া চীন বাংলাদেশের অস্ত্রের বড় সরবরাহকারীও। তাই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনে বাংলাদেশের যোগদান হবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের কৌশলগত বিজয়।
আরো একটি কৌতূহলী প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশ কেন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল এবং চীনকে মোকাবিলার বিষয়ে পশ্চিমাদের লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইবে। যুক্তরাষ্ট্রের এ কৌশলে অংশগ্রহণ বাংলাদেশকে ওয়াশিংটনের প্রধান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদার হওয়ার কাছাকাছি নিয়ে যাবে। বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সরকার বেশ ঘনিষ্ঠ এবং নয়াদিলিল্লি সম্ভবত ঢাকাকে এই কৌশলটি গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছে।
তবে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে গ্রহণ করলেও একইসঙ্গে চীনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। ঢাকার নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক খসড়ায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে চায় এবং ঢাকার কোনও নিরাপত্তা লক্ষ্য নেই।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নিজস্ব ইন্দো-প্যাসিফিক খসড়াকে ‘নীতি’ বা ‘কৌশল’ না বলে এটিকে একটি আউটলুক বা ‘দৃষ্টিভঙ্গি’ বলার একটি কোমল অর্থ রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ এমন ইঙ্গিত এখনও দেয়নি যে দেশটি চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী চারদেশীয় জোট কোয়াডে যোগ দেবে। তবে এরপরও চীন উদ্বিগ্ন বলে মনে হচ্ছে। গত সপ্তাহে, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে ঢাকাকে মার্কিন শিবিরে টেনে নেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ তোলেন।
তাই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার জন্য বাংলাদেশ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল থেকে সরে আসতে পারে। এছাড়া ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু না হলে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। ২০২১ সালের শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশে সন্ত্রাস দমনের প্রচেষ্টার সফলতা দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় আগ্রহ রয়েছে। তবে একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী এই বার্তাও পাঠাতে চায় যে বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিষয়ে ওয়াশিংটন বেশ উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে জঙ্গি হুমকির অজুহাতে সরকার বিরোধী দলকে নতুন করে দমনপীড়ন চালাতে পারে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।