সকল মেনু

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশকে কতটা ভোগাচ্ছে!

হটনিউজ ডেস্ক:

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ, যা সারাবিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন সূচিত করেছে। সৃষ্টি করেছে নতুন নতুন পরিস্থিতি ও সংকট। ঠিক এক বছর আগে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সীমান্তে উত্তেজনা ও ইউক্রেনে রুশ ভাষাভাষীদের দমন-পীড়নের অভিযোগ তুলে দেশটিতে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। যার ভবিতব্য নিয়ে ঠিক স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারছে না।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এ ধরনের একটা যুদ্ধ ইউরোপসহ বিশ্বের অপরাপর দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করেছে। খাদ্য ও জ্বালানি সংকটসহ নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশ। যদিও সরকার শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করে অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।

রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধের কারণে একাধিক দেশের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়েছে ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটেছে। ইউক্রেনের কৃষকদের হাতে যে শস্য আছে যুদ্ধের কারণে তারা সেগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছাতে পরেনি ও পারছে না।

আয়াতনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ রাশিয়া এবং ইউক্রেনের বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্য সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তারা বিশ্ব বাজারে সানফ্লাওয়ার অয়েল, ভুট্টা, গম ও বার্লি রপ্তানি করে থাকে। এগুলো ঠিকমতো বিশ্ববাজারে না আসতে পারায় বিশ্বের অপরাপর দেশের মতো বাংলাদেশের বাজারে এগুলার দাম বেড়ে গেছে। এখনো দাম বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে মানুষ।

গম ও গমজাত দ্রব্য

বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য ভাত হলেও আটা-ময়দার ওপরও ধীরে ধীরে নির্ভরশীলতা বেড়েছে। আর এই আটা-ময়দা আসে গম থেকে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণায় বলা হয়, গত ২০ বছরে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

বাংলাদেশ তার চাহিদার ২০ ভাগ গম নিজ দেশে উৎপাদন করতে পরে। বাকি ৮০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এর অর্ধেকই আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। শুধু ইউক্রেন থেকে আসে চাহিদার ২৫ শতাংশ গম। যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় গমের দাম বেড়েছে।

এর প্রভাব পড়েছে আটা-ময়দার দামে। আটা-ময়দা দিয়ে তৈরি খাদ্যের দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। যুদ্ধের আগে বাজারে যে রুটি ৫-৬ টাকায় পাওয়া যেত তার দাম বেড়ে এখন ১০ টাকা হয়ে গেছে। হোটেলগুলোতে যে পরোটা প্রতি পিস ৫ টাকায় পাওয়া যেত তা এখন ১০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এভাবে গমের তৈরি সব ধরনের পণ্যের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে।

ভোজ্য তেল

বাংলাদেশের বাজারে ভোজ্য তেল এখন লাগামছাড়া। কয়েক দফায় বৃদ্ধি করা হয়েছে নিত্য প্রয়োজনীয় এ পণ্যটির দাম। বাংলাদেশের ভোজ্য তেলের বেশিরভাগই আসে পাম অয়েল এবং সয়াবিন অয়েল থেকে। বিশ্বজুড়ে যেসব ভোজ্য তেল ব্যবহার হয় তার মধ্যে সানফ্লাওয়ার তেল প্রায় ১৩ শতাংশ। এর প্রায় ৭৫ শতাংশই আসে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে। যেহেতু এই সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে, সে জন্য বিশ্বজুড়ে ভেজিটেবল অয়েলের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনিস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় ভেজিটেবল অয়েল আমদানি করে হয় কাঁচামাল হিসেবে, নয়তো প্রক্রিয়াজাত পণ্য হিসেবে (পাম অয়েল ও সয়াবিন অয়েল)। আবার কখনো তেলবীজ আমদানি করে সেটিকে স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত করে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি করে। কিন্তু একদিকে করোনাভাইরাস মহামারি-পরবর্তী শ্রমিক সংকটের কারণে দাম কিছুটা উর্ধ্বমুখী ছিল। পরে ইউক্রেন যুদ্ধ সে দাম আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর খাবার

প্রধানত ভুট্টা থেকে পোল্ট্রি ফিড উৎপাদন হয়ে থাকে। বিশ্ববাজারে ইউক্রেন ১৬ শতাংশ ভুট্টা সরবরাহ করে। পৃথিবীর আরও অনেক দেশে ভুট্টা উৎপাদিত হয়। যেহেতু ইউক্রেন থেকে ভুট্টা সরবরাহ আসতে পারছে না সে জন্য বিশ্বজুড়ে পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। এর ফলে বাজারে মুরগী ও ডিমের দাম বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ ফিড ইন্ডাট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন জানায়, পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনের ৬০ শতাংশ উপকরণ আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উপকরণ হচ্ছে ভুট্টা।

দেশের বাজারে যে পোল্ট্রি মুরগি যুদ্ধের আগে ১০০-১২০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যত সেই মুরগির দাম এখন ২০০ টাকার উপরে। যে মুরগির ডিম ৩০ টাকা হালিতে পাওয়া যেত তা এখন ৫০ টাকায় কিনতে হচ্ছে।

একইভাবে গবাদি পশুর খবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন খামারিরাও। রুপালি খাতুন নামে যশোরের একজন খামারি নিউজ টোয়েন্টি ফোরকে বলেন, ‘আমার একটা গাভী আছে। প্রতিদিন ৪ থেকে সাড়ে ৪ কেজি করে দুধ দেয়। কিন্তু আমার একটা টাকাও থাকে না। গুরুর খাবারের দাম এত বেশি যে, দুধ বিক্রি করে যা টাকা পায় তা গরুর জন্য খবার কিনতেই শেষ হয়ে যায়। ’

সার ও কৃষি পণ্যের দাম বৃদ্ধি

সারাবিশ্বে সিংহভাগ সার রপ্তানি করে রাশিয়া ও বেলারুশ। রাশিয়ার ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ফলে বাংলাদেশে ঠিকমতো রাশিয়ার সার আসতে পারছে না। আর রাশিয়ার সার আসতে না পারায়, যেগুলো দেশে উৎপাদিত হচ্ছে বা ভারতসহ অন্য দেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে, সেগুলোর দামও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে কৃষিপণ্য উৎপাদন খরচ বাড়ার পাশাপাশি বাড়ছে কৃষি পণ্যের দামও।

জ্বালানি তেলের দাম

এই যুদ্ধে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম হু হু করে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া বেশ গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয় মেটাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এরই মধ্যে কয়েক দফা জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটে জ্বালানি তেলের ভর্তুকির জন্য সরকারকে অনেক টাকা গুণতে হবে। কিন্তু জ্বালনিতে আর ভর্তুকি দিতে চায় না সরকার।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা জ্বালানি তেলে আর ভর্তুকি দিতে চাই না। আমাদের বেশি দামে বাইরে থেকে তেল আনতে হচ্ছে। এই বাড়তি দাম ভোক্তা পর্যায় থেকে দিতে হবে। ’ জ্বালানি তেলের এই বাড়তি দাম পরিশোধ করতে এক রকম নাজেহাল অবস্থা তৈরি হয়েছে মানুষের। বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতার কারণে বিদ্যুতের ওপরও এর প্রভাব পড়ছে।

ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে গ্যাস রপ্তানি করে থাকে রাশিয়া। কিন্তু যুদ্ধের পর দেশটি গ্যাস রপ্তানি সীমিত করেছে। তাই ইউরোপে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। যার প্রভাব বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়াতেও পড়েছে।

রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে দেশের রাজনীতির মাঠেও। যুদ্ধের কারণে নিত্য পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। তবে বিরোধী দল পণ্যের দাম বাড়ার পেছনে সরকারকে দায়ী করছে। এ নিয়ে নানা কর্মসূচিতে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো সরকারের তীব্র সমালোচনাও করছে। তারা সরকারের ‘দুর্নীতি ও বড় বড় প্রকল্পের নামে অর্থ লুটপাটের’ অভিযোগ করছে। বাজারের অস্থিরতার কারণে এসব বিষয়কে দায়ী করছে। তবে সরকারি দল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে করোনা মহামারি এবং যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব বাজারের অস্থির পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে দ্রব্য মূল্য বাড়ছে বলে দাবি করে আসছে।

তবে যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব যেন বাংলাদেশে না পড়ে এ জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে জনগণকে উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি নজর দিতে বলছেন। তিনি বলছেন, এক ইঞ্চ জমিও যেন কেউ ফাঁকা না রাখে। বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে সব পতিত জমিকে উৎপাদনের আওতায় আনতে জোর তাগিদ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।

এছাড়া ডলার সংকটসহ বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইতোমধ্যে আইএম থেকে ঋণ নিয়েছে সরকার। যার প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়েছে। ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের মধ্যে বাকটা পর্যাক্রমে পাবে বাংলাদেশ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top