সকল মেনু

ভেসপা ধরতে হাজার কোটি টাকা

এর আগে এমন আজগুবি কথা কেউ শোনেনি, মহাকাশ গবেষণা এবং অভিযানের ইতিহাসে এই প্রথম এমন কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে। ভেসপাকে ধরতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ।

ভেসপা একটি অকেজো কৃত্রিম উপগ্রহ, ওজন ১১২ কিলোগ্রাম। সেই ২০১৩ সাল থেকে আমাদের মাথার ৮০০ কিলোমিটার ওপর দিয়ে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে তীব্র গতিতে ছুটছে। ছলে কিংবা বলে নয়, খুব কৌশলে এ বস্তুটিকে ধরতে হবে। এ জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। মোট তেরোটি প্রতিষ্ঠানকে ডিঙিয়ে ক্লিয়ারস্পেস নামে সুইজারল্যান্ডের ক্ষুদ্র একটি স্টার্ট-আপ দরপত্রের দরাদরিতে এগিয়ে গিয়ে মহাশূন্যে ভেসপাকে ধরাধরির কাজটি বাগিয়ে নিয়েছে। ইতিমধ্যে গত ১ ডিসেম্বর ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আট কোটি ষাট লাখ ইউরোর এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তবে মোট খরচ দশ কোটি ইউরো ছাড়িয়ে যাবে, যা আমাদের মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা।

চুক্তি মোতাবেক আগামী ২০২৫-এ পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে পরিভ্রমণরত ভেসপা নামের অকেজো কৃত্রিম উপগ্রহটি ধরে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে যাবে ৫০০ কিলো ওজনের ক্লিয়ারস্পেস-১ রোবট। কক্ষপথে পৌঁছে রোবটটি প্রথমে ভেসপার গতি নির্ভুল ভাবে নির্ণয় করবে। তারপর ছুটে গিয়ে সাঁড়াশির মতো চারটি বাহুর সাহায্যে জড়িয়ে ধরে নিজের সঙ্গে যুক্ত করে নেবে এবং কক্ষচ্যুত করে ফেলবে। শেষে ফিরে আসবে মর্ত্যে। মহাশূন্যে বিভিন্ন কৃত্রিম উপগ্রহের ধ্বংসাবশেষ, যন্ত্রাংশ অপসারণের এমন জটিল মিশন এটাই প্রথম হবে প্রথম।

১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর কৃত্রিম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ দিয়ে মহাকাশে মহাযাত্রা রুশরাই প্রথম শুরু করে। গত ৬৩ বছর ধরে এ পর্যন্ত প্রায় মোট ৪০টি দেশ মিলে নয় হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে পাঠিয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন কক্ষপথে প্রায় তিন হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ সচল আছে।

বিভিন্ন কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহ প্রেরণের শীর্ষে আছে তিনটি দেশ, চ্যাম্পিয়নের শিরোপাটি যুক্তরাষ্ট্রের অধিকারে। এরপরই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চীন এবং তৃতীয় হলো রাশিয়া। উপগ্রহগুলো আমাদের অবকাঠামোর একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আমাদের জিপিএস, ইন্টারনেট পরিষেবা এবং বিভিন্ন গবেষণায় যথেষ্ট সহায়তা করে যাচ্ছে। অর্থাৎ উপগ্রহ ছাড়া আমাদের উপায় নেই, পৃথিবীর মানুষের এক মুহূর্ত চলবে না। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, এ বছর ১ এপ্রিলের একটি গণনা অনুযায়ী মোট ২৬৬৬টি কৃত্রিম উপগ্রহ সচল রয়েছে। এদিকে স্পেসএক্স এবং টেসলার প্রধান মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্টারলিংক প্রকল্পের আওতায় পাঁয়তারা করছেন পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে প্রথমে ১২ হাজার এবং পর্যায়ক্রমে মোট ৪২ হাজার কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করবেন। এই বিপুলসংখ্যক উপগ্রহের সাহায্যে সমগ্র পৃথিবীতে উচ্চ গতির ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে দেবেন। সে যাই হোক, ভবিষ্যতে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘূর্ণমান বস্তুর সংখ্যা বিপুল হবে, তাতে কেউ দ্বিমত করছে না, সে উপায় মোটেই নেই।

তবে সমস্যা হচ্ছে অকার্যকর কৃত্রিম উপগ্রহ, পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ নিয়ে। পৃথিবীর কক্ষপথে এসব অচল এবং পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ এখন জঞ্জালে পরিণত হয়েছে এবং দিনে দিনে তা বেড়েই চলছে। এর মধ্যে নিম্ন কক্ষপথের কিছু কিছু উপগ্রহ, যন্ত্রাংশ পৃথিবীতে ফিরে আসার পথে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতেই বাতাসের সংস্পর্শে উত্তপ্ত হয়ে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যেগুলো কক্ষপথে থেকে যায়, সেগুলোর কিছু কিছু অক্ষত এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার কারণে ছোট-বড় সব মিলিয়ে সংখ্যায় কোটির ঘর ছাড়িয়ে গেছে বহু আগে। মহাকাশের খবর যারা রাখেন, তাঁরা জানিয়েছেন পৃথিবীর কক্ষপথে ১০ সেন্টিমিটার বা ৪ ইঞ্চির চেয়ে বড় বস্তুর সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। এগুলো ঘণ্টায় ২৮ হাজার কিলোমিটার বা ১৭৪০০ মাইল গতিতে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে চলছে অর্থাৎ শব্দের গতির চেয়ে প্রায় ২৩ গুণ বেশি এই গতি। গতির এমন তীব্রতায় প্রতিটি ছুটন্ত বস্তু সত্যিকার অর্থে ভীষণ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব উপগ্রহগুলো এখনো সচল, সেগুলোর সঙ্গে খুব ছোট্ট একটি বস্তুর সংঘর্ষ হলে মুহূর্তে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে নানা আকার আকৃতির অগণিত টুকরো মহাকাশে ছড়িয়ে পড়বে এবং একের পর এক আঘাত হেনে চলবে আশপাশের সচল এবং অচল কৃত্রিম উপগ্রহে। এ ছাড়াও এ কারণেই নিম্ন কক্ষপথে (৪০৮ কিলোমিটার বা ২৫৫ মাইল) আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের অস্তিত্বও হুমকির মুখে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার (২২ হাজার মাইল) ভূ-সমলয় কক্ষপথ থেকে আরও প্রায় তিন শ কিলোমিটার দূরত্বের ‘সমাধিক্ষেত্র’ বা ‘শ্মশান’ নাম দিয়ে মৃত (অকেজো) কৃত্রিম উপগ্রহের জন্য নির্দিষ্ট করা হলেও তাতেও ঝুঁকি কমছে না। উন্নত প্রযুক্তিতে ঠাসা নতুন নতুন উপগ্রহ পাঠানোর ক্ষেত্রে কক্ষপথের জঞ্জাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সে কারণেই মহাকাশের আবর্জনা পরিষ্কারের উপায় খুঁজছেন বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদেরা।

এই প্রথম ২০২৫ সালে ক্লিয়ারস্পেস-১ কৃত্রিম উপগ্রহটি পাঠিয়ে ধরে আনার উদ্যোগ নিয়েছেন ক্লিয়ারস্পেসের প্রযুক্তিবিদেরা। এটাই হবে পৃথিবীর কক্ষপথে ঘুরতে থাকা অবাঞ্ছিত এবং বিপজ্জনক ধ্বংসাবশেষ অপসারণের প্রথম মিশন।

মহাকাশচারী, বিজ্ঞানীরা খুব উৎসাহিত হচ্ছেন কারণ এতে করে পৃথিবীকে বেষ্টন করে ইতিমধ্যে যে আবর্জনার বেষ্টনী গড়ে উঠেছে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র: ক্লিয়ারস্পেস সুইজারল্যান্ড ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top