সকল মেনু

আঠার শতকের মানুষ !

Thakurgaon_02 হুমায়ুন কবীর, বালিয়াডাঙ্গী (ঠাকুরগাঁও) থেকে: বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬০ বছর হলেও ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ করনাইট গ্রামে এখনো সুস্থভাবে বসবাস করছেন ১৮৯৫ সালে জন্ম নেয়া নজর মোহাম্মদ চেলী। অপরদিকে ১৮৯৮ সালে জন্ম নেয়া বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মহিষমারী গ্রামের কেশিরন বেওয়া । নজর মোহাম্মদের বর্তমান বয়স ১শ ১৮ বছর এবং কেশিরন বেওয়ার বর্তমান বয়স ১১৫ বছর।

 

করনাইট গ্রামের ৯২ বছর বয়সী হাফিজ উদ্দীন জানান, নজর মোহাম্মদ মোট ৫ টি বিবাহ করেন, যার ৪ টিতে তিনিই উকিল দিয়েছেন। নজর মোহাম্মদ শেষ বিয়ে করেন, গত ১৯৯০ সালে। তখন তার বয়স ছিল ৯৫ বছর। নজর মোহাম্মদ ৫ ছেলে ও ১ মেয়ের জনক। বর্তমানেও তিনি বেশ সুস্থ আছেন। নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারেন। শুধু তাই নয়, তিনি এখনো লিখতে ও পড়তে পারেন। তবে কানে খুব কম শুনতে পান তিনি।

ঠাকুরগাঁও-রানীশংকৈল সড়কের নেকমরদ নামক স্থানের পূর্বদিকে করনাইট গ্রাম। সেখানেই বাপ-দাদার কয়েক পুরুষ ধরে বসবাস নজর মোহাম্মদের। তবে তার পূর্ব পুরুষগন জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন বলে নজর মোহাম্মদ জানান।

স্মৃতি চারন করতে গিয়ে নজর মোহাম্মদ জানান, পলাশির যুদ্ধের কথা তিনি শুনেছেন। এর পর ছিল ইংরেজ শাসনামল। সে সময়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে সরাসরি হাতের ইশারায় ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে হতো। জমিদারি প্রথা এবং ইংরেজ শাসনামল বিলুপ্ত এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের সময়ই তার বয়স ৫০ পেরিয়েছিল বলে জানান তিনি। ১৯৩৯ সালের প্রথম ও ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নান্সি বাহিনীর বিপক্ষের সমর্থক ছিলেন তিনি। সে সময় তিনি যুদ্ধে না গেলেও তার পরিচিত অনেকেই যুদ্ধে গেছেন এবং তাদের কেউ এখন বেঁচে নেই। ১৯০১ সালে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার হরিণমারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। কলার পাতায় বাঁশের কলম বানিয়ে লিথতে হতো তাদের। নিজেরাই কিভাবে কালি তৈরী করতেন তার বর্ননা করতে গিয়ে তিনি বলেন, মাটির একটি পাত্রের মধ্যে অনেকক্ষন ধরে চাল ভেজে তা পুড়িয়ে ফেলতে হতো। তারপর সে চাল পানি দিয়ে বেটে ছাকুনি দিয়ে ছেকে তৈরী করা হতো কালি। তখনকার পাঠ্য বইয়ের কয়েকটি কবিতার লাইন তিনি মুখস্ত পড়ে শোনান। তার দৈনন্দিন হিসাবের খাতায় কখন কি খরচ করেন তা এখনো লিখে রাখেন। এখনো তার দৃষ্টি শক্তি বেশ প্রখর রয়েছে উলেখ করে তিনি খাতা এবং বই থেকে বেশ কিছু লেখা পড়ে শোনান। তবে কানে খুব কম শুনতে পান বলে জানান তিনি।

মোট ৫ স্ত্রীর ৭ টি সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে ৭৫ বছর বয়সে মারা গেছে। বর্তমানে তার দ্বিতীয় ছেলের বয়স ৭৬ বছর। ৭৬ বছর বয়সী মজির উদ্দীন জানান, বাবা নজর মোহাম্মদ তাদের চেয়েও সুস্থ আছেন। তার এ দীর্ঘায়ু’র রহস্য সম্পর্কে মজির উদ্দীন বলেন, বাবা একজন রসিক মানুষ। তবে নিয়মিত আহার, নিয়মিত পরিশ্রম এবং জীবনে নিয়মানুবতিতার কারনে তিনি এখনো সুস্থ। দৈনন্দিন অন্যান্য আহারের পাশাপাশি তিনি নিয়মিত দুধ খান। তাদের নাতি-নাতনি অর্থাৎ নজর মোহাম্মদ প্রপিতামহ সহ তার ষষ্ঠ প্রজন্ম দেখছেন। এতে করে নজর মোহাম্মদের নাতি-নাতনি ও নাতি নাতনির সন্তান সহ অর্ধশত সন্তানের সাথে তিনি জীবন কাটাচ্ছেন। দীর্ঘ জীবনের কারনে তাদের বাবা মোট ৫ টি বিয়ে করেন। এমনকি ৯৫ বছর বয়সেও বাবাকে বিয়ে দেন সন্তান ও নাতি-নাতনিরা।

নজর মোহাম্মদের বর্তমান স্ত্রী ৪৭ বছর বয়সী রেবেকা বলেন, স্বামী নজর মোহাম্মদ এখনো সুস্থ। তিনি স্বামীর সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করে বলেন, এ বয়সেও তার স্বামী হেটে হেটে মসজিদে এবং হাটবাজারে যান।

স্মৃতিচারন করতে গিয়ে নজর মোহাম্মদ জানান, ইংরেজ শাসনামলে ১৯২৬ সালের দিকে তিনি কলকাতা থেকে ১ টাকা দিয়ে একটি ধুতি কিনে আনেন। ওই ধুতিটি ওই এলাকার ঐতিহ্য বহন করতো। এলাকার যে কেউ বিয়ে করতে গেলেই তার কাছ থেকে ধুতিটি ধার করে নিয়ে যেতেন। ওই ধুতি পরে শতাধিক ব্যক্তি বর সেজে বিয়ে করেন। যাদের কেউ এখন আর বেঁচে নেই। টাকায় ১০ সের চিনি আর এক মন চাউল বিক্রি হতো তখন।

দশম শ্রেনীতে পড়–য়া পলি জানায়, তার বাবার দাদা হলেন নজর মোহাম্মদ। সে নজর মোহাম্মদকে বড় আব্বা বলে ডাকে। ১শ ১৮ বছর বয়সী মানুষ এখনো সুস্থভাবে জীবন যাপন করছেন, বিষয়টি দেখতে তার বন্ধু-বান্ধব এবং দুর-দুরান্ত থেকে দেখতে আসেন।

৯২ বছর বয়সী হাফিজ উদ্দীন জানান, তিনি নজর মোহাম্মদের ৪ টি বিয়েতে উকিল দিয়েছেন। তিনি বয়সে ছোট হলেও তিনি বেশ অসুস্থ এবং নজর মোহাম্মদ এখনো অনেক সুস্থ।

নেকমরদ ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক জানান, নজর মোহাম্মদকে তিনি ছোটবেলা থেকে ঠিক এরকমই দেখে আসছেন। তার দাদা এবং দাদার বড়রা ছিলেন নজর মোহাম্মদের সম বয়সী। করনাই গ্রামের তিফাইত হোসেনের ছেলে নজর মোহাম্মদ এলাকার সবচেয়ে প্রবীন ব্যক্তি বলে উলেখ করে তিনি বলেন, নজর আলীর বর্তমান বয়স ১১৮ বছর।

অপরদিকে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার মহিষমারী গ্রামের কেশিরন বেওয়া বর্তমানে নিজে চলাফেরা করতে না পারলেও তিনি খোলা চোখে সব দেখতে পান। কেশিরন বেওয়ার ১ ছেলে ও ২ মেয়ের জননী। তার বড় মেয়ের বয়স বর্তমানে ৮৫ বছর। বড় মেয়ে সালেহা বেগমের ছেলে মেয়েরাও এখন বৃদ্ধ প্রায়।

এ প্রসংগে কেশিরন বেওয়ার ছেলে ইশার উদ্দীন জানান, ১১৫ বছর বয়সী মা এখন বেশি চলাফেরা করতে পারেন না। তবে খালি চোখে সব দেখতে পান।

১১৮ বছর বয়সেও মানুষ সুস্থ-এ প্রসংগে ঠাকুরগাঁওয়ের স্বনামধন্য ডাক্তার মারুফ আলী খান বলেন, এ বয়সেও মানুষ স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারে। শরীরের কোন কোন অংশের হয়তো দুর্বলতার সৃষ্টি হলেও তা জীবন-যাপনের জন্য অন্তরায় নয়। সন্তানদানের ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষদের ক্ষমতা অনেক বেশি। সাধারনত ৫৫ বছর বয়স হলেই নারীরা সন্তান ধারনের সক্ষমতা হারালেও পুরুষরা সক্ষমতা হারায় না। দীর্ঘজীবনের রহস্য হলো, তার নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top