সকল মেনু

চুয়াডাঙ্গা কবি নজরুলের স্মৃতিভূমি

শরীফ সাথী : চুয়াডাঙ্গা জেলার ঐতিহ্যবাহী কার্পাসডাঙ্গা মিশনারীর এলাকা কি সুন্দর দাদু ভাই? -হ্যা নাতি ভাই। মিশনারীর পল্লির ভিতরে ঢুকতেই বামপাশে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যে ঘরে অবস্থান করে থাকতেন সে ঘরটি দাদু তাঁর নাতিকে দেখিয়ে বলল, নাতি ভাই আজও স্বযতেœ দাঁড়ানো এই আট চালা খড়ের ঘরটিতে কবি নজরুল থাকতো, তুমি কি জানো?  -না দাদু ভাই, তুমি আজ আমাকে ঘুরে ঘুরে সব দেখাবে আর এখানকার নানান প্রেক্ষাপটের বৈচিত্রময় কাহিনী শুনাবে?
চল নাতি ভাই, এখানে বসেই আজ কাজী নজরুল সম্মন্ধে তোমাকে শুনাব?  -দাদু ভাই, যার লেখা আমাদের বইতে আছে?
-হ্যাঁ নাতি ভাই, নজরুল এইখানে এসে লিচু চোর লেখাটি লিখেছিল। তার ইতিকথাও তোমাকে শুনাব। দাদু ভাই, কবি নজরুল এই জায়গায় বসেছিল, হেঁটেছিল, কী ভাগ্য আমার? আজ আমিও তোমার সাথে এখানে হাটছি, বসছি, বলনা.. দাদু ভাই, মন যে আমার থামেনা?
-তাহলে শোন নাতি ভাই—-।
কলকাতার আর্মহাষ্ট ষ্ট্রিট মিশনারী এরিয়ার খ্রিষ্টান পল্লিতে আনুমানিক ১৯২৬-২৮ সালে হবে প্রাণের কবি আমাদের জাতীয় কবি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম অবস্থান করেছিল। সেখানে কবি’র সাথে এখানকার বাবু মহিম সরকারের পরিচয় ঘটে এবং কবিকে আমন্ত্রণ জানান এই চুয়াডাঙ্গার কার্পাসডাঙ্গায় আসবার জন্য। কবি আমন্ত্রণ গ্রহন করে কৃষ্ণনগর চাঁদসড়ক পল্লিতে কিছুদিন কাটিয়ে স্ব-পরিবারে কার্পাসডাঙ্গায় পদার্পণ করেন। নিভৃত পল্লি এলাকা ছিল আজকের এই কার্পাসডাঙ্গা।
নাতি দাদুকে বলল, আজকের এই কার্পাসডাঙ্গা মানে কি দাদু ভাই? তখন কি এই কার্পাসডাঙ্গার নাম অন্য ছিল?
দাদু বলল, হ্যা রে নাতি ভাই, তখন এই কার্পাসডাঙ্গাকে সবাই নিশ্চিন্তপুর নামে বলতো এবং চিনতো। শোনা যায়, সেই থেকে কবি মাঝে মাঝেই এখানে আসতেন।


হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের আটচালা এই খড়ের ঘরে দীর্ঘ দুই মাস অবস্থান করে এই ঘরকে আলোকিত করে গেছেন আমাদের প্রাণের কবি জাতীয় কবি কালজয়ী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। হঠাৎ আবার নাতি তাঁর দাদুকে প্রশ্ন করল, দাদু ভাই, তুমি যে বললে এই বাড়িটি বকুল বিশ্বাসের আবার এখন বলছো বাবু হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের আটচালা খড়ের কুঁড়ে ঘর? দাদু তাঁর নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, নাতি ভাই বংশানুক্রমে পাওয়া। যেমন-তখন ছিল হর্ষপ্রিয় বিশ্বাস তাঁর ছেলে প্রদ্যুৎ বিশ্বাস এবং এখন প্রদ্যুৎ বিশ্বাসের ছেলে বকুল বিশ্বাস মালিকানা লাভ করে বসবাস করছে? নাতি বলল, ও বুঝলাম দাদু ভাই? এক কথায় তাঁর মানে বকুল বিশ্বাসের দাদু ভাই ছিলেন হর্ষপ্রিয় বিশ্বাস। ঠিক যেন তোমার আমার মত তাই না দাদু ভাই?
-ঠিক বুঝেছো নাতি ভাই, আবার দাদু বলা শুরু করল। এখানে এসে কবি অনেক কবিতা ও গান লিখেছিলেন, নিজ কন্ঠে সুর করে গেয়েছিলেন। যাদুকরী গানের সুরের মূর্ছনায় মাতিয়ে তুলতেন পাড়া-মহল্লার ধ্যান-জ্ঞান মনের মানুষগুলোকে। মহিম বাবুর মেয়ে আভারাণী ও শিউলি রাণী সরকার তার কাছে গানের তালিম নিতেন। পাশে বসে অনেকেই গান শুনতেন তন্মদ্ধে নীলিমা ও তরেণ মন্ডল অন্যতম। নাতি দাদুকে বলল, মহিম বাবু কি খুব ধনি লোক ছিল দাদু ভাই? তুমিতো বললে তাঁর আহ্বানে কবি এখানে এসেছে? দাদু বলল,তা তো ছিলোই? তা না হলে কি আর কলকাতা আর এখানে এতো যাতায়াত করতে পারতো, কবি নজরুলের সাথে এতো খাতির সখ্যতা গড়ে উঠতো। নিশ্চয় সে সময় তাঁরা পারিবারিকভাবে খুব আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ছিলেন এবং মহিম বাবুর কথা মতো কবি এখানে এসেছিলেন। কলকাতার রেডিওতে নজরুলের অনেক গান আভারানী ও শিউলী রানীর কন্ঠে রেকর্ড হয় এবং তা প্রচার হয়। যদিও শোনা যায়, আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানের ব্রিটিশ শাসন শোষণের অন্যতম নীল চাষের এই কার্পাসডাঙ্গায় চুপিচুপি আবির্ভাব ঘটেছিল। ইতিহাসের স্মরণকালের উজ্জ্বল নক্ষত্রের। এখানে এই ইংরেজ কুঠীবাড়ির নীল চাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করতেই এসেছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে কলমের পাকা শক্ত আঁচড় কাটতেন। গণমানুষকে চুপিচুপি জাগাতেই বিভিন্ন জায়গায় পরিদর্শন করতেন। এই এলাকার জনগণকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় করতে, উদ্বুদ্ধ করতেই এসেছিলেন। তাদের অনাচার অত্যাচরের প্রতিবাদী হতেই সকলকে আহ্বান করতে, সজাগ তৈরী হতে তাঁর লেখনি ও ধ্যান-জ্ঞান সম্মন্ধে বুঝাতেই তাঁর এখানে আসা। এক কথায় এখানের জনগণকে নীল চাষে বাধিত করা, নীলকর সাহেবদের অতিষ্ঠ অত্যাচারের বিরুদ্ধেই জনগণের জাগরন ঘটাতেই আসা। এখন আর ব্রিটিশ নেই, ভারত হয়েছে, বাংলাদেশ হয়েছে, আর এ কার্পাসডাঙ্গা হয়েছে মুক্ত। কারো কারো তথ্যমতে, কবি নজরুল এখানে একটু চুপিচুপি থাকতেন তার কারণ হয়তো বা তিনি গ্রেফতার এড়াতেই অনেকটা নিরবে ছিলেন এখানে। কার্পাসডাঙ্গা মিশনারীর ভিতর পার্শ্বে বর্তমান প্রাইমারী স্কুলের সাথেই মিশনারী স্কুল-হোস্টেলের পাশেই নদীর তীরে সান বাঁধানো ঘাটে বসে অনেক গান ও রচনা করেছেন।“কোন কূলে আজ ভীড়লো তরী এ কোন সোনার গাঁয়” ভৈরব নদীর তীরের সিঁড়িতে বসে কবি’র লেখা। “কলসী ভেসে গেল লো—” উল্লেখযোগ্য লেখা এ স্থানকে সমৃদ্ধ করেছে।

ঝাউ গাছের সারি। বিশাল এলাকাজুড়ে বিরাট লিচু গাছের বাগান। এখানের এই প্রকৃতির নিদারুন ছোঁয়া কবি’কে মুগ্ধ করে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিচু চোর, পদ্মগোখরো, বহুসংখ্যক গানসহ অনেক কিছুই রচনা করেছিলেন এই কার্পাসডাঙ্গাতে অবস্থানকালে। প্রকৃতির রুপ এমনই তারারা মেলা বসায় নীল আকাশে। চাঁদ জোছনা দিয়ে মায়ায় বাঁধে। রবির হাসিতে হেসে ওঠে ধরনী। মেঘরাশির বৃষ্টি রিমঝিম ছন্দে আনন্দে গান গায়। তেমনি প্রকৃতিতে মুগ্ধ হয়ে আমাদের প্রিয় কবি কার্পাসডাঙ্গার এই মিশনারীর গীর্জার পার্শ্বে বসন্তের বাতাসে ঝাউগাছের ডানায় ভেসে কাল্পনিক দেশে বাস্তবতা মিশে রচনা করেছেন প্রিয় লেখায় সাজানো ‘পদ্মগোখরো’। এ গল্পের প্রেক্ষাপট মূলত এখানকার এবং এখানে বসেই রঁচিত। চোখের মায়াবী চাহনীতে মিশনারির প্রকৃতি সেজেছিল নয়নোভিরাম সৌন্দর্যে। হাতের পরশে জেগে উঠেছিল এখানকার মৃত পরিবেশ। কৃষ্ণনগরে রঁচিত কবির উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’তে কার্পাসডাঙ্গার স্মৃতিময় কাহিনী আবির্ভূত হয়েছে। বিশাল লিচু গাছের দৃশ্য বিশ্বকে জানিয়ে দিতে লিখেছেন কালজয়ী সৃষ্টি লিচু চোর’ এর মত দুর্দান্ত প্রাণবন্ত কবিতা। অবাঁধ শিশুদের লিচু পেড়ে লুকানো, কাঠবিড়ালীদের লিচু খাওয়া, পাখিদের কোলাহল কবি’র মায়াবী চোখ আটকে গিয়েছিল। রাতের আঁধারে লিচু চুরি হয়ে যায় বাবুদের বাগান হতে কবি এমন কথা শুনতে পেয়ে বাবুদের তালপুকুরের পাড়ে তালগাছের নিচে বসে লিচুগাছের সৌন্দর্যে মন হারিয়ে মজাদার লিচু চোর এর মত লেখা লিখে নিজ মুখে সে সময় পাঠ করে শুনিয়েছিলেন। বেশ কয়েকজন পাশে বসে শুনেছিল কবি’র লেখা কবির মায়াবী মুখের মিষ্টি কন্ঠে।
“বাবুদের তাল পুকুরে হাবুদের ডাল কুকুরে—–”নিজ কন্ঠের দ্ব্যার্থহীন অমলিন মিষ্টি ভাষা হৃদয় ছুঁয়েছিল এখানকার মানুষের মনে। এখানে এসে কবির বহুলেখা আজ ও মানুষের হৃদয়স্পর্শ করে আছে। সবচেয়ে বড় সত্য হল কবি কার্পাসডাঙ্গায় এসেছিলেন। লিচু চোর লিখেছিলেন। অসংখ্য গান, পদ্মগোখরো, মৃত্যুক্ষুধার কাহিনী, লিচু চোর কবিতা লেখাগুলোই বড় প্রমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম এখানে এসেছিলেন। এসব লেখাগুলো অন্য কোথাও সৃষ্টি নয়। কার্পাসডাঙ্গায় বসেই এসব লেখা কবির সৃষ্টি। লিচু চোর, পদ্মগোখরো বড় প্রমাণ স্মৃতিবিজড়িত কার্পাসডাঙ্গাকে উজ্বল করার। তাই স্মরণীয় হয়ে আছে হর্ষপ্রিয় বাবুর আটচালা খড়ের কুঁড়ে ঘর, ভৈরব নদীর সিঁড়ির ঘাট, লিচু গাছ ,তাল পুকুর, মিশনারীর আকাশে বাতাসে আজ ও কবির মায়াবী কন্ঠ ভাসে, ভাসে মুখোচ্ছবি যা ভুলবার নয়। হর্ষপ্রিয় বিশ্বাসের আটচালা খড়ের কুঁড়ে ঘরটি এলাকাবাসীর গর্ব। স্মৃতির মণিকোঠার অলংকার। এখানের কবির পদধ্বনি নয়নের সুরমা। কবি’র নিঃশ্বাসের বায়ু আতরের সুগন্ধে ভরপুর হয়ে ফুলে ফলে বিকশিত হয়। এখানকার ফুল ফলের গন্ধে ছন্দে আরো মাতোয়ারা করে তোলে নজরুল প্রেমী মানুষগুলোর। হৃদয়পটে প্রিয়মুখ ভেসে ওঠে। চোখের জ্যোতির্ময় আলোকে প্রকাশিত করে। নজরুলকে নিয়ে জনতার গর্ববোধে বুক ব্যাকুল হয়ে ওঠে সারাবিশ্বকে যদি জানাতে পারতাম নজরুল আমাদের পরিবারের পরিবেশের সদস্য ছিল। কবি নজরুল আমাদের অহংকার । নজরুল আমাদের গর্ব। ভালোবাসার দীপ্তিময় স্বর্ণালী ইতিহাস। মনের মনিকোঠার মনিব। অন্তরের অন্ত:স্থলের সাহসীবীর সৈনিক। ব্রিটিশদের অন্যায় দাপটের বিরুদ্ধে নজরুলের বিদ্রোহী সুর যা ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হুংকার। কার্পাসডাঙ্গা মিশনারীর প্রতিটি স্থানে কবির পদচারনা যা আজও মুখরিত করে আকাশে বাতাসে, মানুষের মণনে। এমন কালজয়ী মানুষের আগমন কি ভুলে থাকা যায়? গহীন অতলে কি হারিয়ে দেওয়া যায়? যায় না। কার্পাসডাঙ্গায় নজরুল স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস তুলে ধরতে, জাগিয়ে তুলতে, জানিয়ে দিতে এসব স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছু প্রীতি হয়ে থাকবে মানুষের মনে অনন্তকাল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের গর্ব আমাদের অহংকার।
নাতি দাদুকে বলল, খুব ভালো, খুব ভালো দাদু ভাই।
দাদু বলল, সবই তো ভালো কিšু‘ ফুরিয়ে যে গেল দিনের আলো নাতি ভাই। চলো আঁধার কালো নামার আগেই বাড়ি ফিরি আজ—-।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top