শরীফ সাথী: প্রিয় কবি বিদ্রোহী কবি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জানা অজানা কিছু কথা বিভিন্ন তথ্যের আলোকে পাঠকের চোখে ছেড়ে দিলাম। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসনসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মায়ের নাম জাহেদা খাতুন। কাজী’ হচ্ছে কবির বংশের উপাধী। পিতা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের মুত্তাওয়াল্লি। কবি ইসলামী চিন্তা ও ভাবধারার ভিতর দিয়ে বড় হন। শৈশবে নজরুলের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। কবির জন্মের পরে তার চার ভাইয়ের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে সংসারেও ছিল অর্থনৈতিক দুঃখ। কবির বয়স যখন মাত্র ৮ বছর তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। কবি তখন গ্রামের মক্তবের ছাত্র। মাত্র দশ বছর বয়সে কবি সুমধুর কন্ঠে পবিত্র কোরআন তেলওয়াত করতে পারতেন। বাল্যকালেই পবিত্র কুরআনের অর্থ ও তাঁর মর্মবাণী শিক্ষালাভ করেন। দশ বছর বয়সে আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে কবি প্রাথমিক পরিক্ষায় পাশ করেন। এসময় কবি কয়েকদিন গ্রামের মসজিদের মুয়াজ্জিন হয়ে সংসারের আর্থিক অনটন কিঞ্চিৎ লাঘব করার চেষ্টা করেন। চাচা করিম কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষাদান করেছিলেন।
শৈশব কাল থেকেই কবি ছিলেন একটু চঞ্চল প্রকৃতির। স্কুলের ধরাবাধা নিয়ম কবির ভাল লাগেনি। পড়াশুনা ছেড়ে মাত্র ১০ বছর বয়সে লেটোর দলে যোগ দেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই তিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন। লেটো গানের দলে কোন অশ্লিল গান পরিবেশন হতো না বরং বিভিন্ন পালা গান, জারি গান, মুর্শিদী গান ইত্যাদি পরিবেশিত হতো। অসামান্য প্রতিভার জন্য কবি লেটো দলের প্রধান নির্বাচিত হন। লেটো গানের দলে থেকেই কবি বিভিন্ন বই পত্র পড়ে সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যান। এসময় তিনি কয়েকটি কবিতা, ছড়া গান রচনা করে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দেন। তারপর আসনসোলের এক রুটির দোকানে মাত্র ৫ টাকা বেতনে কাজ নেন। রুটির দোকানে কাজ করার সময় একজন দারোগা সাহেবের সহায়তায় কবি ময়মনসিংহের হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। এখানেও কবির মন না বসায় কবি নিজ দেশে ফিরে শিয়ারসোল হাইস্কুলে ভর্তি হলেন এবং মেধাবী ছাত্র হিসাবে তিনি বৃত্তি ও লাভ করেছিলেন। কবি দশম শ্রেণী পড়াকালীন বাঙালী পল্টনে যোগ দিয়ে সৈনিক হিসাবে করাচি গমণ করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কবিতা ও সাহিত্য চর্চা থেমে যায়নি। করাচি সেনা নিবাসে সহকর্মী একজন পাঞ্জাবী মৌলিবী সাহেবের সাথে কবির পরিচয় হয়। তাঁর নিকট থেকে কবি ফারসী ভাষা শিক্ষা লাভ করেন এবং মহাকবি হাফিজ, শেখ সাদী (রঃ) প্রমূখ বিশ্ববিখ্যাত কবিদের রচনাবলী চর্চা করেন। এরপর থেকেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিতা, গল্প, উপন্যাস, হামদ নাত, গজল, সাহিত্য ইত্যাদির ব্যাপক রচনার তাগিদ অনুভব করেন।
পারিবারিক সীমাহীন দুঃখ দূর্দশার মধ্যেও আজীবন বাংলা কাব্য ও সাহিত্য চর্চায় ব্রতী ছিলেন, ছিলেন বিশ্ময়কর প্রতিভার অধিকারি, বাংলা কাব্য ও সাহিত্যে প্রচন্ড বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। দেশের স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জালেম শাসক গোষ্ঠির অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলমকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছিলেন। কবির কাব্য ও সাহিত্য ইসলামী ও ঐতিহ্য বলিষ্ঠ ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে উঠেছিল। কবিতা, হাম্দ, নাত, গজল ও ইসলামী গান প্রায় প্রতিটি বাঙ্গালী মুসলিমের হৃদয়কে করেছে জাগরিত। কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাধারে শ্রমিক, সৈনিক, কবি, সাহিত্যিক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী একজন খাঁটি দেশ প্রেমিক ছিলেন। যদিও কবি একাধিক কবির ন্যায় সোনার চামস মুখে দিয়ে জন্মলাভ করেননি। চুরুলিয়ার কাজী বংশ এককালে খুবই সম্ভ্রান্ত ছিল বটে; কিন্তু যে সময় কবি নজরুল ইসলাম শিশু হয়ে আভির্ভূত হন, সে সময় এ বংশটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানীর নানা রকম বঞ্চনা ও শোষনের শিকার হয়ে আভিজাত্যের পশ্চাৎপট থেকে সম্পূর্ণ স্ফলিত হয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, অপমান দারিদ্রের মধ্য দিয়ে কবির বাল্য, কৈশোর ও প্রাক যৌবন কেটেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি শিশুদের কবি, নিপীড়িতের কবি, প্রকৃতির কবি ও প্রেমের কবি হিসেবেও সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি শিশুদের জন্য এত সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা করেছেন, যা পড়ে শিশুরা বিমোহিত হয়ে পড়ে। যুদ্ধ থেমে গেলে আড়াই বছর সৈনিক জীবন শেষে পল্টন রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার পর কবি নিজ মাতৃভূমি চুরুলিয়া গ্রামে ফিরে আসেন। এরপর কবির শুরু হয় একনিষ্ঠ কাব্য চর্চা। কবির লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে। দৈনিক বসুমতি, মুসলিম ভারত, মাসিক প্রবাসী, বিজলী, ধূমকেতু পত্রিকায় সে সময় প্রকাশিত প্রতিটি লেখা আলোড়ন সৃষ্টি করে। রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রার যোগ হয় নজরুলের কবিতা। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে নিপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষ জাগরণে তারঁ কবিতা যেন অসাধারণ প্রবক্তা। ১৯২১ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সে কবি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত অমর কবিতা ‘বিদ্রোহী’ যা সাহিত্য জগতে তাকে চির অমর করে রেখেছে বিদ্রোহী কবি হিসাবে। কবির অম্লান বাণী ‘ বল বীর বল চির উন্নত মম শির- শির নেহারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির’ আজো প্রত্যেকের হৃদয় শিহরিত করে তোলে।
ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠির শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে দেশ প্রেমিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম কলমকে অস্ত্র ও বুলেট হিসাবে ব্যবহার করলেন। ব্রিটিশ বিরোধী তুমুল আন্দোলন শুরু হলে কবি সাপ্তাহিক ধূমকেতু পত্রিকায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লিখতে লাগলেন। অন্যায়, অবিচার, অসাম্য ও অসত্যের বিরুদ্ধে কবি লেখনীর মাধ্যমে প্রচন্ড বিদ্রোহ শুরু করেন।অতিতের ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করে শুনিয়েছেন মুসলিম জাতিকে জাগরনের বাণী এবং স্বদেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে দেয়ার জন্যে । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠি মুসলিম কৃষকদের নিঃস্ব করে ফেলেছিল। জমি ও ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রায় পথে বসেছিল কৃষককূল। কবি নজরুল শাসকচক্রের বিরুদ্ধে কৃষক সমাজকে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়ে কৃষকের গান কবিতায় লেখেন-“ চল্ চল্ চল্! ঊর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল, নি¤েœ উতালা ধরণী-তল, অরুণ পাতে তরুণ দল, চল্-রে চল্-রে চল।” বাংলাদেশ সরকার বর্তমান এ কবিতাটি রণসঙ্গীতের মর্যাদা দান করেছেন।
আধুনিক বাংলা কাব্য ও সাহিত্যে মুসলিম সাধনার সবচেয়ে বড় প্রেরণা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ইসলামী বিষয়গুলোকে তিনিই প্রথম সত্যিকার সাহিত্যে রুপ দিয়েছেন। কবির আবির্ভাবে মুসলিম স্বাতন্ত্র কাব্য সাধনার দিগন্তে নবোদিত সূর্যের মহিমা বিকশিত হয়েছে। মুসলিম স্বাতন্ত্রবোধের বজ্রকন্ঠের বাণী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া অন্য কোন কবিরা তেমন ফলপ্রসু করে তুরতে পারেনি। কবির আল্লাহর প্রতি অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস ছিল। মানুষের প্রতি আল্লাহপাকের অশেষ নেয়ামতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করে লিখেছেন-“ এই সুন্দর ফল সুন্দর ফুল মিঠা নদীর পানি, খোদা তোমার মেহের বাণী।।” কবি বহু হামদ নাত, গজল, আধুনিক গান, ইসলামী গান, গল্প, কবিতা, সাহিত্য ও উপন্যাস রচনা করেন। তাঁর রচনার সংখ্যা কয়েক সহস্র। উল্লেখযোগ্য রচনাসূমহ অগ্নিবীণা, মৃত্যু ক্ষুধা, বিষের বাঁশী, দোলন চাঁপা চক্্রান্ত, সর্বহারা, ভাঙার গান, প্রলয় শিখা, নতুন চাঁদ, রিক্তের বিদন, ফনীমনসা, প্রভৃতি । ফারসী ভাষার মহাকবি হাফিজের কতকগুলি কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছেন। ইংরেজি ভাষায় ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের কিছু লেখার অনুবাদ হয়েছে এবং হচ্ছে। ১৯৪২ সালে কবি চিরদিনের ন্যায় বাক শক্তি হারিয়ে ফেলেন। অনেক চিকিৎসার পরেও সুস্থতা আনা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবি জগত্তারিণী পুরুস্কার প্রাপ্ত হন। ১৯৬০ সালে কবি বারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন। ১৯৭০ সালে বিশ্ব ভারতী কবিকে ডিলিট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করে। বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ আমন্ত্রণে কবিকে ১৯৭২ সালে ঢাকায় আনা হয়েছিল। ধানমন্ডিতে কবির নামে একটি বাসা বরাদ্দ হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে কবি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘একুশে পদক’ দ্বারা সম্মানিত করা হয়। কবি ১৯৭৬ সালের ২৯মে আগষ্ট বাংলা ১৩৮৩ সালের ১১ই ভাদ্র ঢাকার পি.জি হাসপাতালে সকাল ১০টায় ইন্তেকাল করেন। তিনি অছিয়ত করে যান তাকে মসজিদের পাশে কবর দেওয়ার জন্যে, যেন তিনি কবরে শুয়েও মুয়াজ্জিনের সুমধুর আযানের ধ্বনি শুনতে পান। তিনি লিখেছেন“মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন উত্তর পার্শ্বে রাষ্টীয় মর্যাদায় কবিকে সমাহিত করা হয়। মসজিদের পাশে কবি আজ চিরনিদ্রায় শায়িত। বাঙালী মুসলিম হৃদয়ে কবি অমর। কবি জীবদ্দশায় যেসব জায়গায় পদচারণ করে গেছেন, স্মৃতিবিজড়িত সেসব স্থানসমূহ ধন্য হয়েছে; ধন্য করেছে প্রতিটি মানুষের হৃদয় মঞ্জিল। ১১ই জ্যৈষ্ঠ কবির জন্মদিনে উৎসবে সেজে ওঠে স্মৃতিভূমি। ।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।