সকল মেনু

যেসব সুবিধা থাকছে ইসির নতুন ইভিএমে

হটনিউজ ডেস্ক: বর্তমানে এমন ইভিএম রয়েছে ইসির কাছে আগামী এক দশক ব্যবহারের বিষয়টি মাথায় রেখে উন্নত প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) সংগ্রহ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সর্বাধুনিক নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসম্বলিত এই নতুন ইভিএমে অন্তত ১০ ধরনের সুবিধা থাকছে। এই মেশিন কোনোভাবেই হ্যাক করা বা নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড দিয়ে চালু করার আগে ভোট দেওয়া সম্ভব নয় বলে দাবি ইসির। এমনকি ভোটের মাঝপথে নষ্ট বা ছিনিয়ে নেওয়া হলেও বিকল্প ব্যবস্থায় ভোটগ্রহণ চালু রাখা হবে।

ইভিএম বলা হলেও কার্যত: এটি ডিভিএম (ডিজিটাল ভোটিং মেশিন) বলে ইসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এর একেকটির দাম পড়বে এক লাখ টাকার মতো।নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, গতবছরের রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে উন্নত প্রযুক্তির ইভিএম এর একটি ভার্সন ব্যবহার করা হয়। কমিশনের দাবি, ওই নির্বাচনে ভোট দিয়ে বেশিরভাগ ভোটারই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। ওই ভোটের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা বলেছিলেন, একটি কেন্দ্রে বেশ সতর্কতার সঙ্গে ইভিএম এ ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। ভোটাররা উৎসাহ নিয়েই ভোট দিয়েছেন। ভোটাররা অভিভূত। সবার সঙ্গে কথা বলেছি, ইভিএমে কোনও বিচ্যুতি, কোনও ত্রুটি হয়নি। নতুন ইভিএম সফল। এ নিয়ে ভোটারদের থেকে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে।

রংপুরে সফল ব্যবহারের পরপরই ইসি অধিকসংখ্যক নতুন ইভিএম সংগ্রহে তৎপর হয়। এক্ষেত্রে তারা রংপুরে ছোটখাট যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আরও উন্নততর ইভিএম সংগ্রহে রাষ্ট্রায়ত্ত মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির সঙ্গে যোগাযোগ করে। মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি তা আপগ্রেড করে নতুন ইভিএম এর কয়েকটি কপি ইসিকে সরবরাহ করেছে। ইসি সেগুলোতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে আড়াই হাজারের মতো ইভিএম সরবরাহে মেশিন টুলসকে গতমাসে চিঠি দিয়েছে।

নতুন ইভিএমের সুবিধাগুলো-

ভোটগ্রহণের আগে মেশিন চালু হবে না: মেশিন চালু করার বিষয়টি পাসওয়ার্ডের ওপর নির্ভর করবে। এটি ভোটের আগে কারও জানার সুযোগ থাকবে না। ফলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে এটি চালু করার কোনও সুযোগ থাকবে না। এতে প্রচলিত কাগুজে ব্যালটের মতো ভোটের আগের রাতে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না।

সুরক্ষিত পাসওয়ার্ড: ইভিএম মেশিন চালু করার পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত থাকবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মোবাইল ফোনে ভোট শুরুর আগে এসএমএস এর মাধ্যমে ওই পাসওয়ার্ড পৌঁছে যাবে। ফলে ওই অনুমোদিত ব্যক্তির বাইরে কেউ এটি চালু করতে পারবেন না। তবে, এক্ষেত্রে প্রথম ব্যক্তি কোনও দৈবদুর্বিপাকে কেন্দ্রে উপস্থিত হতে না পারলে দ্বিতীয় নির্ধারিত ব্যক্তির মোবাইল ফোনে পাসওয়ার্ড পৌঁছে দেওয়া হবে।

জাল ভোটের সুযোগ থাকবে না: ভোটের সময় ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে ভোটার শনাক্ত করা হবে। কোনও ভোটারের ফিঙ্গার প্রিন্ট মিললেই তার ভোটটি আনলক হবে এবং সেটি প্রদান করা যাবে। ফলে জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। এমনকি মেশিন ছিনতাই করে নিয়ে গেলেও ভোট দেওয়া যাবে না।

ভোটার শনাক্তকরণ সহজ: কোনও ভোটার ভোট দিতে যাওয়ার পর তার ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ছবিসহ বেশ কিছু তথ্য মেশিনের স্ক্রিনে ভেসে উঠবে। একইসঙ্গে মেশিনের সঙ্গে যুক্ত থাকা মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে বড় পর্দায় এই তথ্যগুলো দেখা যাবে। এতে পোলিং এজেন্টরা ভোটারকে সহজে চিহ্নিত করতে পারবেন।

দুইভাবে ডাটা সংগ্রহ: ভোটাররা ভোট দেওয়ার পর তার তথ্য একইসঙ্গে মেশিনের অভ্যন্তরীণ ডাটা সেন্টারে সংরক্ষণ হবে। একইসঙ্গে মেশিনে যুক্ত এক্সটার্নাল চিপসেও তথ্য সংরক্ষণের সুবিধা থাকছে। এতে মেশিনটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ওই এক্সটার্নাল চিপসের তথ্য অন্য একটি মেশিনের মাধ্যমে রিড করা যাবে। আংশিক ভোট গ্রহণের পরও যদি মেশিনটি নষ্ট বা কোনও নাশকতায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এক্ষেত্রে কেবল চিপসটি রক্ষা করা গেলেই তা অন্য মেশিনে যুক্ত করে ভোটগ্রহণ অব্যাহত রাখা যাবে।

হ্যাক হওয়ার আশঙ্কা শূন্য শতাংশ: সাধারণত কোনও ডিভাইস ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকলে সেটি হ্যাক হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। কিন্তু ইভিএম মেশিনটি ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত থাকবে না। এর পরিবর্তে ইসির নিজস্ব নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে। ফলে বাইরের কারও পক্ষে এটি হ্যাক করার সুযোগ থাকবে না।

নতুন ইভিএমে ভোট শুরুর আগে-পরে শূন্য ভোটিং, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফল প্রিন্ট, ঘোষণা ও বিতরণ করার ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া আরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে নতুন ইভিএমে। এগুলো হচ্ছে, পুরনো ইভিএমের ভোটার শনাক্তকরণ ইউনিট এবং ভোটিং ইউনিট দুটি একত্র করে একটি মেশিনে রূপান্তরিত করা; ব্যালট ইউনিট ক্যানসেল বোতামটি বাদ দেওয়া, ব্যালট ইউনিটের ভোট প্রদানের বোতামগুলো বড় আকারের ও ভিন্ন রঙের করা এবং বোতামের আকার একটু বড় করা; ভোটারের পছন্দের প্রতীকটি নিশ্চিতকরণে সতর্কতার সুযোগ, ভোট সম্পন্ন হওয়ার পর ভোটারের জন্য ‘ধন্যবাদ’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছে।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুরনো ইভিএমে ত্রুটি থাকায় ভোটগ্রহণে ছয় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। এগুলোর মধ্যে ভোটারের পরিচয়পত্র ও আঙুলের ছাপ পরীক্ষার ব্যবস্থা ও প্রদত্ত-গৃহীত ভোটের কাগুজে রেকর্ড সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা, কন্ট্রোল ইউনিটের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ভোটের ফল প্রকাশ না করতে পারা এবং মেশিনের ব্যাটারির চার্জ বেশিক্ষণ না থাকা।

নতুন ইভিএম সম্পর্কে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি) মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘পুরনো ইভিএম মেশিনে বেশ কিছু ত্রুটি পেয়ে আমরা উন্নত প্রযুক্তির এই ইভিএম সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি। এই নতুন ইভিএম যেমনটি ইউজার ফ্রেন্ডলি তেমনি এটি হ্যাক করা বা জাল ভোট দেওয়ার কোনও সুযোগ থাকছে না।’

নতুন এই ইভিএমের প্রতিটির মূল্য এক লাখ টাকার মতো। এত দামের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে এনআইডি উইংয়ের মহাপরিচালক বলেন, ‘এখন থেকে এক দশক আগে কমিশন যে ইভিএম সংগ্রহ করেছিল, তার প্রতিটির দাম ৪০ হাজার টাকার বেশি ছিল। ওই ইভিএমে অনেক ত্রুটি ছিল, যেটা আপনারা জানেন। আমরা সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন ইভিএম করছি। এটি আরও এক দশক ব্যবহার করা যাবে; সেই ধরনের প্রযুক্তি এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এগুলোর ওয়ারেন্টিও দেওয়া হচ্ছে ওই সময় পর্যন্ত।

ইসি নতুন ইভিএম বাংলাদেশে ব্যবহারের পাশাপাশি বিদেশে রফতানির আশা করছে বলেও জানান তিনি।

আধুনিক পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের প্রক্রিয়া চালুর লক্ষ্যে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ২০১০ সালে ব্যালট পেপারের বিকল্প হিসেবে ইভিএম চালু করেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সীমিত পরিসরে তারা ইভিএম ব্যবহার করে। পরে স্থানীয় পর্যায়ের আরও কিছু নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার চলতে থাকে।

এই ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্যের পাশাপাশি যন্ত্রটির কারিগরি ত্রুটির বিষয়টি বারবার সামনে আসে। হুদা কমিশনের পর গত রাকিবউদ্দিন কমিশনও স্থানীয় সরকারের কিছু কিছু নির্বাচনে সীমিত পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করে। তবে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমে বড় ধরনের ত্রুটি ধরা পড়ে।

বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হলে রাকিব কমিশন তাদের মেয়াদের বাকি সময়ে কোনও নির্বাচনে আর ইভিএম ব্যবহার করেনি। বর্তমান কেএম নূরুল হুদা কমিশন ২০১৭ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ইভিএম ব্যবহার না করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ইভিএম ব্যবহারে সরকার আগ্রহ ব্যক্ত করলে কমিশন নড়েচড়ে বসে। তারা পুরনো ইভিএমগুলো কী অবস্থায় রয়েছে তার পর্যালোচনাসহ নতুন ইভিএম তৈরির পদক্ষেপ নেয়।

ইভিএম নিয়ে বিএনপির তীব্র বিরোধিতায় কমিশন তাদের রোডম্যাপে ইভিএম এর বিষয়টি উল্লেখ করেনি। পরে ইসির সঙ্গে সংলাপে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো থেকে ইভিএমের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত আসে। কমিশন জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করলেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পর্যায়ক্রমে এর ব্যবহার বাড়াবে বলে উল্লেখ করে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ মেশিন টুলস্‌ ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) থেকে উন্নত ধরনের ইভিএম মেশিন তৈরি করছে ইসি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top