পুলিশ নামের বাঁয়ে গ্রাম শব্দটি থাকায় ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না ৪৬ হাজার ৮৭০ গ্রামপুলিশের। বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত অথচ সর্বাধিক দায়িত্ব পালনে যারা নিয়োজিত আছে তারা হলো গ্রামপুলিশ। সাধারণভাবে তারা দফাদার ও মহল্লাদার হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম মানবেতর জীবনযাপনের খবরের শিরোনাম হতে হয়েছে এই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। অভাবের তাড়নায় ভিক্ষাবৃত্তি করছেন, অনেকে বিনা চিকিৎসায় মারাও গেছেন। এমন খবরও বিরল নয়।
ব্রিটিশ আমল থেকে গ্রামপুলিশের সদস্যরা বিভিন্ন আইনের অধীনে কাজ করে আসছে। সর্বশেষ তাদের ‘স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯’ এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ আইনের অধীনে ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) এ গ্রামপুলিশ বাহিনীর গঠন, প্রশিক্ষণ, শৃঙ্খলা ও চাকরির শর্তাবলী সম্পর্কিত বিধিমালা তৈরি করা হয়। কিন্তু এ বিধিতে তাদের চাকরির কোনো শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়নি। ২০০৮ সালের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গ্রামপুলিশদের চতুর্থ শ্রেণির স্কেল নির্ধারণে অর্থ বিভাগকে চিঠি দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত তারা নেয়নি। এ কারণে গ্রামপুলিশদের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে এ সংক্রান্ত একটি রিট দায়ের করা হয়েছে। গ্রামপুলিশ বাহিনীর (চৌকিদার) সদস্যদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় সরকার সচিব, অর্থ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব ও পুলিশ মহাপরিদর্শককে এ নোটিশ দেয়া হয়েছে।
সাধারণ মানুষের কাছে দফাদার ও চৌকিদার নামে পরিচিত হলেও তারা গ্রামীণ ট্যাক্স কালেকশন, জন্ম-মৃত্যুর তালিকা প্রণয়ন, ভিজিভি-ভিজিএফ বণ্টন, বিধবা ভাতা, বয়স্ক ভাতা বিষয়ে অনুসন্ধান ও তালিকা প্রণয়ন, ইউনিয়ন পরিষদের নোটিশ জারি, পুলিশের সঙ্গে আসামি ধরার কাজ, নির্বাচনী ডিউটি পালনের কাজ করেন। এছাড়া যে কোনো সরকারি অনুষ্ঠানের চিঠি বিলি, রাতে পাহারা দেয়া, নিজস্ব এলাকার আইনশৃঙ্খলা শান্ত রাখা, এলাকার অপরাধ সাধ্যমতো সমাধান করা, ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশে পরিষদের দায়িত্ব পালন, থানার অর্পিত দায়িত্ব পালন, রুটিন অনুযায়ী পরিষদের পাহারার দায়িত্ব পালন ও নিয়মিত থানায় হাজিরা দেয়াসহ রয়েছে বহুমুখী কাজ।
প্রায় ৭০ ধরনের কাজ করে বেতন মাত্র ৩০০০ (তিন হাজার) টাকা! এরাই হচ্ছে বাংলাদেশ গ্রামপুলিশ। গ্রামপুলিশের কোনো স্বতন্ত্র বেতন স্কেল নেই। চাকরির শুরুতে পাঁচশ’ টাকা ছিলো ভাতা। দীর্ঘকাল পর দফাদাররা ২১০০ টাকা ও চৌকিদাররা ১৯০০ টাকা বেতন পেত। বর্তমান সরকারের আমলে দফাদারদের বেতন ৩৪০০ ও চৌকিদারদের বেতন ৩০০০ টাকায় এসে দাড়িয়েছে। বেতনের অর্ধেক সরকারি কোষাগার ও বাঁকি অর্ধেক ইউনিয়ন পরিষদ অফিস দেয়। স্থানীয় সরকার থেকে ১৫০০ টাকা নিয়মিত পেলেও ইউনিয়ন পরিষদ থেকে টাকাটা নিয়মতভাবে পান না। চাল, ডাল, তেল আর লবণ কিনতে প্রথম সপ্তাহে তাদের ভাতার টাকা ফুরিয়ে যায়। বাকি দিনগুলো অন্যের কাছ থেকে ধার-দেনা, চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অথবা পরের বাড়িতে অবসরে কাজ করে চলতে হয়। সারা দেশে গ্রামপুলিশরা গ্রাম পাহারা দেওয়াসহ রাত দিন ২৪ ঘণ্টা ডিউটি পালন করেন। বর্তমান সময়ে একজন ভিক্ষুকও দৈনিক ৩০০ টাকা আয় করে। অথচ একজন গ্রামপুলিশের দৈনিক বেতন মাত্র ১০০ টাকা। যা খুবই অমানবিক। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে নামমাত্র বেতন দিয়ে গ্রামপুলিশদের জীবন ধারণ করা দুর্বিষহ। এত অল্প বেতনে সংসার চালানোর কথাই ভাবা দুস্কর। বাচ্চাদের পড়াশোনা করানোর স্বপ্ন তো বলাই বাহুল্য। গ্রামপুলিশের বেতন সরকারি চতুর্থ শ্রেণির বেতন স্কেলে উন্নীত করা হলে গ্রামীণ উন্নয়ন আরও উন্নত হবে বলে আশা করেন তারা।
গ্রামপুলিশ চাকরির বিধিমালা (৪ মে প্রণীত গ্রামপুলিশ বাহিনীর চাকরির বিধিমালা ২০১৫) পরিবর্তনসহ কয়েক দফা দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছে বাংলাদেশের গ্রামপুলিশ সদস্যরা। যে আইনটি সংশোধনের দাবী তারা করছে, তাতে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপাররাও সংশোধনের পক্ষে মত দিয়েছেন। তাদের দাবি, গ্রামপুলিশকে চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর ন্যায় জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তকরণ, কেন্দ্রীয়ভাবে স্থায়ী হেডকোয়ার্টার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, স্বল্পমূল্যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু, ন্যুনতম পাঁচ লাখ টাকা অবসর, গ্রামপুলিশদের ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন সরকারী চাকুরীতে ১০% অগ্রাধিকার প্রদান ও ঝুঁকি ভাতা প্রদানসহ চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান। তাদের নায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশহিসেবে সারা বাংলাদেশে কালো ব্যাচ ধারণ, ইউনিয়ন পরিষদে হাজিরা বর্জন, থানায় হাজিরা বর্জন এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে বাংলাদেশ গ্রামপুলিশ কর্মচারী ইউনিয়ন।
দেশের ৬৮ হাজার গ্রামের প্রতিটি ঘর গ্রামপুলিশ সদস্যরা নিরাপদ রাখার কাজে নিয়োজিত আছে। অথচ নামে পুলিশ হলেও তাদের কোনো মূল্যায়ন নেই। সর্বক্ষেত্রেই তারা অবহেলিত ও উপেক্ষিত। বাংলাদেশের গ্রামপুলিশদের সরকারের কাছে আকুল আবেদন, যেন তাদের জাতীয় পে-স্কেল দেয়া হয়। ৪৬ হাজার ৮৭০ জন গ্রামপুলিশ যেন ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। যেন মনোযোগ দিয়ে সরকারি আদেশ পালন করতে পারে। সারাদেশের ৪ হাজার ৫৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদের গ্রামপুলিশদের সরকার যদি বিভিন্ন ট্রেনিং-এর মাধ্যমে দক্ষ ও সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তাহলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠির জীবন যাত্রার মান যেমন উন্নতি হবে তেমনিভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরে লুকায়িত সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মল করাও সম্ভব হবে। মাদকের কালো হাত থেকে নতুন প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে গ্রামপুলিশদের সহায়তা ও কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্রের রক্ষাকারী এই গ্রামপুলিশরাই পারে প্রতিটি গ্রামকে মাদক ও জঙ্গিমুক্ত করে আমাদের সবার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে।
লেখক : শিপন রবিদাস প্রাণকৃষ্ণ, মহাসচিব, বাংলাদেশ রবিদাস ফোরাম (বিআরএফ), কেন্দ্রীয় কমিটি। মোবাইল ঃ ০১৭৩৭২৫৬৯১৯
বি: দ্র : মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ি নয়
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।