মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি: বিশিষ্ট শিল্পপতি, সাবেক মন্ত্রী ও মুন্নু গ্রুপ অব ইন্ডাসট্রিজের চেয়ারম্যান হারুনার রশিদ খান মুন্নু না ফেরার দেশে চলে গেলেন । মানিকগঞ্জবাসীর প্রিয় এই মানুষটি সর্বস্তরের মানুষকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মুন্নু সিটিতে তার নিজের প্রতিষ্ঠান মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মঙ্গলবার ভোর ৫টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে গোটা মুন্নু সিটি। শোক আর কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে সেখানকার পরিবেশ। তার প্রতিষ্ঠানগুলোতে উড়ছে কালো পতাকা এবং প্রতিটি মানুষ গায়ে শোক ব্যাচ ধারণ করে জানান দিচ্ছেন তাদের প্রিয় মানুষ হারুনার রশিদ খান মুন্নু নেই। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে, তিন নাতিসহ আত্মীয় স্বজন ও অসংখ্য শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন।
সরজমিন সকালে মানিকগঞ্জের গিলন্ড এলাকায় মুন্নু সিটিতে গিয়ে দেখা গেছে শোকের স্তব্ধতা। কারো চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে আবার কেউ উচ্চস্বরে কাঁদছেন প্রিয় মানুষ হারানোর শোকে। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে দু’মুঠো খাবার পাচ্ছেন এমন সব কর্মচারীদেরও অঝোরে কাঁদতে দেখা যায়। হাসপাতাল থেকে হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মরদেহ সকালে নিজ বাসভবনে নেয়া হলে সেখানে ছুটে আসেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার মানুষ।
বাবার মৃত্যুর খবর শুনে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ছুটে আসেন হারুনার রশিদ খান মুন্নুর ছোট মেয়ে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের স্ত্রী ফিরোজা পারভীন। বাবার লাশের পাশে বসে দু’চোখ গড়িয়ে অঝোরে পানি পড়ছে তার। আর দু’হাত দিয়ে বাবার মুখখানি ধরে আদর করছেন। আর হারুনার রশিদ খান মুন্নুর ৬২ বছরের বন্ধন তার স্ত্রী হুরুন নাহার স্বামীকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন। কখনো উচ্চস্বরে আবার কখনো নীরবে কাঁদছেন তিনি। হারুনার রশিদ খান মুন্নুর বড় মেয়ে আফরোজা খান রিতা লন্ডনে থাকায় তার বাবার জানাজা-দাফনের দিন তারিখ ঠিক হয়নি।
মুন্নু মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের প্রিন্সিপাল আক্তারুজ্জামন বলেন, স্যার একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তার স্বপ্ন এই মেডিকেল কলেজটি আদর্শ এবং একটি পরিপূর্ণ মেডিকেল কলেজ হবে। যেটাকে সারা জীবন মানুষ স্মরণ করবে এবং মানব সেবা যাতে স্থায়ীরূপ লাভ করে। তিনি বলেন, স্যার সব সময়ই বলতেন আমার শেষ নিঃশ্বাস যেন আমি আমার এই প্রতিষ্ঠান থেকে ত্যাগ করতে পারি। স্যারের সেই ইচ্ছা সৃষ্টিকর্তা হয়তো শুনেছেন। কারণ কয়েকদিন আগে তাকে ঢাকা ল্যাব এইড হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে তার মন টিকেনি। সেখান থেকে সব বাধা সবার অনুরোধ এবং চিকিৎসার নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে সোমবার তার নিজের গড়া হাসপাতালে ছুটে আসেন। রাতে ভর্তি হলে সকালে আজানের পরই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। একেই বলে মাটির টান।
হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মৃত্যুর খবর শুনে বিএনপি’র সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ছুটে আসেন মুন্নু সিটিতে। সকলেই তার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট গোলাম মহীউদ্দিন বলেন, হারুনার রশিদ খান মুন্নু আর আমি একই উপজেলার বাসিন্দা। তার সঙ্গে একাধিকবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি একজন আদর্শবান মানুষ ছিলেন। আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।
হারুনার রশিদ খান মুন্নু সম্পর্কে মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপি’র সিনিয়র সহ সভাপতি এডভোকেট মোখসেদুর রহমান বলেন, হারুনার রশিদ খান মুন্নু ছিলেন মানিকগঞ্জে বিএনপি’র রাজনীতির একজন প্রান পুরুষ। ব্যাপক জনপ্রিয়তার অধিকারী ছিলেন তিনি। পাশাপাশি মানুষের প্রতি তার নিবিড় ভালোবাসা ছিল। মানব সেবা ছিল তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য। রাজনীতিবিদ হিসেবে জেলা নেতৃবৃন্দের কাছে ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। এই মানুষ ও প্রিয় নেতাকে হারিয়ে আজ আমরা একজন অভিভাবককে হারালাম। তবে হারুনার রশিদ খান মুন্নু রাজনীতিতে তার যোগ্য উল্টরসূরি হিসেবে বড় মেয়ে আফরোজা খান রিতাকে তৈরি করে গেছেন। একজন স্বার্থক পিতা হিসেবে আমরা তাকে স্যালুট করি। হারুনার রশিদ খান মুন্নু সারা জীবন আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠা হয়ে থাকবেন।
হারুনার রশিদ খান মুন্নুর বড় মেয়ে মুন্নু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফরোজা খান রিতা তার মেজো ছেলের বিয়ের কারণে কয়েক দিন ধরে লন্ডনে অবস্থান করছেন। মঙ্গলবার সকালে বাবার মৃত্যুর খবর শুনে তিনি সেখান থেকে রওনা হয়েছেন বলে জানান মুন্নু গ্রুপের এইচআর অ্যাডমিন আবদুল আওয়াল বুলবুল।
এদিকে শিল্পপতি হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মরদেহ মঙ্গলবার দুপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ল্যাব এইডের হাসপাতালের হিমঘরে। সেখানে মরদেহ রাখা হবে। বড় মেয়ে লন্ডনে অবস্থান করায় জানাজা, দাফন ও কর্মসূচি স্থগিত রাখা হয়েছে। তিনি বুধবার দেশে এলে পারিবারিকভাবে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন মুন্নু গ্রুপের এইচআর অ্যাডমিন আবদুল আউয়াল বুলবুল।
রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রথম জানাযা হওয়ার কথা রয়েছে। এর পর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। তৃতীয় জানাযা শেষে নিজ হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান ধামরাইয়ের মুন্নু সিরামিকসে তার মরদেহ নেয়া হবে। এর পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে মানিকগঞ্জ শহরে। সেখানে সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে চতুর্থ জানাযা শেষে এই রাজনীতিবিদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে তার জন্মস্থান গ্রামের বাড়ি জেলার হরিরামপুর উপজেলার পাটগ্রামে। পাটগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে পঞ্চম জানাযা হবে।
ষষ্ঠ ও শেষ জানাযা হওয়ার কথা রয়েছে মুন্নু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মাঠে। এর পর গিলন্ড এলাকায় মুন্নু সিটিতে মসজিদের পাশে হারুনার রশিদ খান মুন্নুকে দাফন করা হবে।
তবে হারুনার রশিদ খান মুন্নুর বড় মেয়ে আফরোজা খান রিতা লন্ডন থেকে বুধবার দেশে আসার পর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে।
হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মৃত্যুতে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাংসদ নাঈমুর রহমান দুর্জয়, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট গোলাম মহীউদ্দিন, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মঈনুল ইসলাম খান শান্ত গভীর শোক প্রকাশ করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
হারুনার রশিদ খান মুন্নুর মৃত্যুতে তিন দিন শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা বিএনপি। এই দিনগুলোতে জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন শাখা দলীয় কার্যালয়ে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, দলীয় পতাকা অর্ধনমিত ও কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাজ ধারণ এবং জেলা শহরের দলীয় কার্যালয়ে শোক বইতে স্বাক্ষর কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। আগামী শুক্রবার জুমার নামাজের পর জেলায় মসজিদসমূহে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।