লালমনিরহাট প্রতিনিধি: বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী‘জায়গা-জমি, সবকিছুই নিজের নামে হয়েছে। এমনকি নিজের পরিচয়টাও হয়ে গেছে। কোনও যুদ্ধ ছাড়াই শেখের বেটিই আমাদের নতুন পরিচয় করে দিয়েছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েছি। এখন মাথা উঁচু করেই অন্যদের কাছে পরিচয় দিতে পারি— আমরা বাংলাদেশি, খাঁটি বাঙালি।’
সোমবার (৩১ জুলাই) বিকালে বিলুপ্ত ১১৯ নম্বর বাঁশকাটা ( মোমিনপুর) ছিটমহলে কথা হয় ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাবেক নেতা নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তার পাশেই বসেছিলেন আব্দুল মজিদ, নুরল ইসলামসহ অন্যান্যরা। বিলুপ্ত ছিটমহলের সার্বিক উন্নয়ন ও সমস্যা সংক্রান্ত বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম এসব কথা বলেন।
নজরুল ইসালাম আরও বলেন, ‘৬৭ বছরে যেসব চোখে দেখি নাই। গত দুই বছরেই তা হাতের মুঠোয় পেয়েছি। যেন সবকিছুই স্বপ্নের মতো পেয়ে গেছি।’
নজরুল ইসলামসহ অন্যরা জানান, রাস্তা-ঘাট, মসজিদ, মন্দির, তথ্য সেবাকেন্দ্র, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কমিউনিটি ক্লিনিক, বিদ্যুৎ সংযোগ, কমিউনিটি সেন্টার, স্যানিটারি ল্যাট্রিন স্থাপন, টিউবওয়েল বসানো, ধরলা নদী ভাঙন রোধে বাঁধ নির্মাণ ও ধরলা নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে নদী খননসহ বিভিন্ন প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়াও চিকিৎসাসেবা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে সরকার।
সরকারি চাকুরিতে বিশেষ নিয়োগের মাধ্যমে বিলুপ্ত ছিটমহলের শিক্ষিত বেকারদের নিয়োগের দাবি জানান স্থানীয়রা।
মঙ্গলবার (১ আগস্ট) বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে দ্বিতীয় বর্ষপূতির জন্য ব্যাপক কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। স্থানীয়দের আয়োজিত কর্মসূচিতে অংশ নেবেন লালমনিরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেনসহ স্থানীয় লোকজন।
লালমনিরহাট পাটগ্রাম উপজেলার বিলুপ্ত ১১৯ বাঁশকাটা ছিটমহলে নির্মিত হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবনপাটগ্রাম উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী আবু তৈয়ব মো. শামসুজ্জামান বলেন, ‘পাটগ্রামের বিলুপ্ত ছিটমহলে দুই কোটি ৫৯ লাখ ২১ হাজার ৯৮৩ টাকা ব্যয়ে চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৯ কোটি ৪০ লাখ ৮৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৬ কিলোমিটার পাকা রাস্তা, ৩৬ লাখ ৩২ হাজার ৩২২ টাকা ব্যয়ে দুইটি মসজিদ, ২০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি রাধা-গোবিন্দ মন্দির ও ৬৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক কালচারাল কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এসব কাজ বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।’
লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কৃষ্ণ কমল সরকার বলেন, ‘পাটগ্রামে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো রক্ষার জন্য ধরলা নদী শাসনে ১৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৭শ ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের পাঁচটি বাঁধ নির্মাণ প্যাকেজের ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই আরও আট কোটি ১৯ লাখ ব্যয়ে ধরলা নদীর নাব্যতা ফেরাতে খনন কাজের ঠিকাদার নিয়োগ দিতে দরপত্র আহবান করা হবে।’
লালমনিরহাট পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক বলেন, ‘বিলুপ্ত ছিটমহলের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এ ছাড়া শ্রীরামপুর ইউনিয়নের অভ্যন্তরে বিলুপ্ত ভোটবাড়ী ছিটমহলে একটি পুলিশ তদন্তকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ৭৫ ভাগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।’
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলায় দুইটি, হাতীবান্ধা উপজেলায় দুইটি ও পাটগ্রাম উপজেলায় ৫৫টি ভারতীয় ছিটমহল বিগত ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশি ভূ-খণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়। এসব ভূ-খণ্ডে বসবাসকারীরা নতুন করে বাংলাদেশের নাগরিকত্বও পান। পরে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তারা কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ভোটও দেন।
লালমনিরহাটের বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীবিলুপ্ত ছিটমহল পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর কুতুবুল আলম বলেন, ‘বিলুপ্ত ছিটবাসীদের জন্য উন্নয়ন কার্যক্রমের মধ্যে এলজিইডি, জনস্বাস্থ্য অধিদফতর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, শিক্ষা, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও স্বাস্থ্য বিভাগের মাধ্যমে কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া ৩২০ জন দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা শুরু করা হয়েছে। ভিজিডি কর্মসূচির আওতায় এক হাজার একশটি কার্ড দেওয়া হয়েছে। পুরাতন ছিটমহলের অধিবাসী শুমারি-২০১৭ গণনা করা হয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদফতরের উদ্যোগে বিলুপ্ত ছিটমহলে উত্তরবঙ্গ প্রকল্পের আওতায় ১৩ পুরুষ ও ৬২ জন নারীকে গাভী পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতা এবং মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের মাধ্যমে বিধবা ভাতা দেওয়া শুরু করা হয়েছে।’
বিলুপ্ত ছিটমহলের বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জামেরুল ইসলামের স্ত্রী নবীজন বেগম বলেন, ‘আগে নিজের পরিচয় দিতে পারতাম না আমরা। শুধু নাগরিক সুবিধাই নয়, বিশ্বটাকে যেন হাতের মুঠোয় পেয়েছি। কোনও কিছু হলে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনেই স্বামীকে সবকিছু জানাতে পারছি।’
উপজেলার জোংড়া ইউনিয়নের বিলুপ্ত ১১৯ বাঁশকাটা ছিটমহলে স্থাপিত মামিনপুর বাঁশটাকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাকিবুল হাসান বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বিদ্যালয়টি স্থাপন করেছেন। ১৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ অঞ্চলে কোনও কলেজ না থাকায় নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান কার্যক্রম চলছে। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর স্বপ্ন পূরণে এবং আগামী প্রজন্মকে শিক্ষিত হিসেবে গড়ে তুলতে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ করার দাবি জানাচ্ছি।’
জোংড়া ইউনিয়নের সাবেক বাঁশকাটা ছিটমহলের শিক্ষার্থী ঈশিতা পারভীন তিথি বলেন, ‘আগে পরিচয় গোপন রেখে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়েছিল। এখন আগের মতো তথ্য গোপন রেখে পড়াশুনা করতে হয় না। এ ছিল আমাদের জীবনে এক অভিশাপ। আজ শুধু বাঙালিই নই, আমরা বাংলাদেশি।’
পাটগ্রাম উপজেলার মির্জারকোর্ট হাজী মহিম উদ্দিন বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মারুফা ইয়াছমিন মনিশা জানান, আগে ছিটমহল বিনিময় হওয়ার পর আমাদের সবকিছুই বদলে গেছে। আমি উচ্চ শিক্ষা নিয়ে একজন আদর্শ শিক্ষক হবো।’
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবুল ফয়েজ মো. আলাউদ্দিন খান বলেন, ‘বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীর ভাগ্য পরিবর্তনে উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এসব উন্নয়ন কাজ চলতি অর্থবছরে শেষ করা হবে। এ ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনীর আওতায় হতদরিদ্রদের উপকারভোগী হিসেবে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে।’
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।