গোলাম মোস্তফা রাঙ্গা: বাস্তবতার পরাকাষ্ঠে বেড়ে ওঠা নাছিমা বেগম ১৯৮১ সালের ১ মার্চ ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সদর উপজেলার চাপুইর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। বাবা মোঃ সদু ভুইয়া সরকার খাদ্য বিভাগের অতি ছোট্ট পদে (পিয়ন হিসেবে) চাকরী করে কোনমতে সংসার চালাতেন। মা আরশা বেগম ছিলেন একজন গৃহিনী। পরিবারের ৩ ভাই ও ৮ বোনের মধ্যে নাছিমা ছিলেন পঞ্চম। দারিদ্রতার পাশাপাশি বাবা-মার বাংলা শিক্ষার ঘোর বিরোধিতার কারণে প্রাথমিক শিক্ষার পর হাইস্কুলে যাওয়া হয়নি নাছিমার। একপর্যায়ে মা-বাবা ও সমাজের একশ্রেণির মানুষের পরামর্শে মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৯৫ সালে দাখিল পাশ করেন। একদিকে পরিবারে চরম অভাব অন্যদিকে ধর্মান্ধ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নাছিমার উচ্চ শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব পর হয়ে উঠেনি। ১৬ বছর বয়সে একই গ্রামের আব্দুল গফুর ভুইয়ার বেকার ছেলে মোঃ খলিল ভুইয়ার সাথে বিয়ে হয় তার। স্বামীর কোনো কর্ম না থাকায় বেকারত্ব দূর করার জন্য কাজের খোজে হন্যে হয়ে ঘোরাঘরি করেও কোন কাজ পান না। এতে নাছিমার সংসারে কষ্টের দাবানল আরো ধাউ ধাউ করে জ্বলে উঠে। এ অবস্থায় দিশাহারা হয়ে পড়েন নাছিমা। চরম দারিদ্র যেন নাছিমার পিছু ছাড়তেই চায় না।
সময়ের প্রবাহে নাছিমার সংসারও বেড়ে যেতে লাগলো। ১৯৯৬ সালে প্রথমে তার গর্ভে আসে ময়না নামে এক কন্যা সন্তান। তারপর বছরের ব্যবধানে আরো ৪ সন্তানের জন্ম, বড়জনের নাম মনিহার, পরের জন মায়া ও একমাত্র ছেলে সবুজ এবং শেষে জনের নাম মারজানা। নাছিমার বেকার স্বামী মোঃ খলিল ভুইয়া ভাগ্যের অন্বেষণে জীবন-জীবিকার তাগিদে মধ্যপ্রাচ্যে পারি জমান। বছর দুয়েক থাকার পর আবার দেশে ফিরে আসেন। নাছিমা তার স্বামী, চার মেয়ে ও এক পুত্র সন্তান নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য ধর্মান্ধতা ও সমাজের বাধা-বিপত্তি ভেদ করে দৃঢ় পদক্ষেপে কর্মস্থানে সোচ্চার হন। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কার্যক্রমের সাথে পরিচিত হন এবং তাদের কার্যক্রম জেনে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
১৯৯৬ সালে আনসার ও ভিডিপি’র গ্রাম দলনেত্রী জাহানারা বেগমের সহযোগীতায় আনসার ও ভিডিপি মাধ্যমে হস্ত ও কুটির শিল্প বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ঋণ কার্যক্রমসহ জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি, বাংলাদেশ (নাসিব), মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, সমাজ সেবা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর এবং সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হন। নাছিমা একজন ভাল উদ্দ্যোক্তার পাশাপাশি ২০১০ সালে নিজের গ্রামে ‘‘চাপুইর মহিলা কল্যাণ সংস্থা’’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে এবং সংগঠনের সভানেত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। সমাজের এতিম প্রতিবন্ধী, অসহায়, দরিদ্র, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের কুটির ও হস্তশিল্প প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে অস্থায়ীভাবে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন এবং তিনি উক্ত প্রশিক্ষণগুলি সুষ্ঠভাবে সু-সম্পন্ন করে থাকেন। এ পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার প্রায় ০৮ টি গ্রাম যেমনঃ- সুলতানপুর, রাধিকা প্রভৃতি গ্রামের ৩০০ জন মহিলাকে হস্ত ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করেছেন।
তিনি তার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এমব্রয়ডারী, ব্লক-বাটিক, নকশীকাঁথা, নকশী চাঁদর, নকশী বালিশের কভার, বাঁশের মোড়া, প্লাস্টিকের ব্যাগ, প্লাস্টিকের জুতা, বিভিন্ন রকমে পাপোশ, কাগজের ফুলদানী, ওয়ালম্যাট উলের কাজ, শলার কাজ, ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তুলেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলাদের এই সমস্ত তৈরী দ্রব্য ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করে থাকেন। তিনি অসহায় মহিলাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ভিডিপি কুটির শিল্পের ব্যানারে ‘‘নারী মুক্তি ভিডিপি’’ সংগঠন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ইতোপূর্বে তিনি আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষার জাতীয় সমাবেশসহ বিভিন্ন সময়ে আনসার ও ভিডিপি একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হস্ত ও কুটির শিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। পিছিয়ে পড়া নারী সমাজের উন্নয়নে তার অবদান প্রশংসার-দাবীদার। গবির-দুখিনী নারী, নির্যাতিত ও স্বামী পরিত্যাক্তা নারীদের জন্য নাছিমা বর্তমানে নিবেদিত প্রাণ। এছাড়া প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য নাছিমার আন্তরিক সহযোগীতার যেন অন্ত নেই। এছাড়া ২০০৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার কাউতলীতে ‘‘মেসার্স বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজ’’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। যার ট্রেড লাইসেন্স নম্বর ৯৮৪৬। সেই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেলাই, চুমকি স্কিন প্রিন্ট, ব্লক বুটিকের কাজ এবং কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন নাছিমা। শুরু হয় নাছিমার উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। বর্তমান মাসিক নীট আয় প্রায় ২০ হাজার টাকা। যুব মেলাসহ জাতীয় পর্যাযে বিভিন্ন মেলায় তার নিজস্ব উৎপাদিত পণ্য/ হস্তশিল্প নিয়ে অংশগ্রহণ করেও নাছিমা বেগম অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। অভাব অনটনের কারণে নিজে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে না পারলেও সন্তানদের সাধ্যমতো উচ্চশিক্ষা দিচ্ছেন নাছিমা বেগম। নিজেকে একজন শ্রেষ্ঠ সমাজসেবী হিসেবে গড়ে তুলতে চান তিনি। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার অংশগ্রহণের কমতি নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদিকা হিসাবেও কাজ করছেন তিনি। সংগঠনের পক্ষে তিনি সদর উপজেলায় পিঠা মেলায়ও অংশগ্রহণ করেন বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সমাবেশে আনসার ও ভিডিপি মহাপরিচালক তাকে সমাজসেবা ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় জাতীয় পুরষ্কার ও সদনপত্র প্রদান করেন।
আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান নাছিমা বেগমের শনৈ শনৈ অগ্রযাত্রা ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পাবার পেছেনে যে অবদান তার জন্য তিনি সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। নাছিমা বেগম মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে একজন আর্দশবাদী নারীও বটে। বর্তমানে তিনি ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলা মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর ফোরামের একজন সক্রিয় সদস্য।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।