সকল মেনু

মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকায় ছিলেন চিকিৎসকরা

8eef924908d1c255b5e8fd3cf3a9ac3d-58538268ad79dহটনিউজ২৪বিডি.কম : মুক্তিযুদ্ধের সময় চিকিৎসক, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র, কলেজ ও হাসপাতালের নানা শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবদান রেখেছেন নানা ভাবে। কেউ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন অস্ত্র হাতে, কেউ আবার হাসপাতালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আবার অনেক চিকিৎসক মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহে সাহায্য করেছেন, সহযোগিতা করেছেন তথ্য আদান-প্রদানে। চিকিৎসকদের গাড়িতে করে পার হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, আনা হয়েছে অস্ত্র, ওষুধসহ নানাকিছু।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধে মূলত চিকিৎসকরা পালন করেছেন ব্যতিক্রমী ভূমিকা। আর শহীদকন্যা নুজহাত চৌধুরী জানালেন, বাবার ডাক্তারির চিহ্ন দেওয়া গাড়িতে করে সীমান্তের ওপারে যে ক্যাম্প ছিল সেখানে বনেট ভর্তি করে ওষুধ যেত। টাকা উঠিয়ে দেওয়া, তথ্য আদান-প্রদান এবং অস্ত্র বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ হতো বাবার ডাক্তারির সেই চিহ্ন দেওয়া গাড়িতে করেই।

‘মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক পরিষদ ও মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসক ইউনিট’ এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী এ কে এম মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চিকিৎসকদের ভূমিকা ছিল খুবই জোরালো ও ব্যতিক্রমী। আহত, নিপীড়িত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাদানে তারা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। তারা যুদ্ধের ময়দানে যেমন অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনি সেবার মাধ্যমে যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।’

একই মন্তব্য স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব ডা. ইকবাল আর্সলানেরও। তিনি হটনিউজ২৪বিডিকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তখন যারা ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতেন। মুক্তিযোদ্ধারা সেসময় পরিচয় গোপন রেখে হাসপাতালে ভর্তি হতেন, তাদের সব ধরণের সহযোগিতা করতেন মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসকরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে চিকিৎসারত মুক্তিযোদ্ধাদের সব কাজের তদারকি করতেন ডা. ফজলে রাব্বি। অপরদিকে, শহীদ অধ্যাপক আলীম চৌধুরী সে সময় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য বেশিরভাগ সময় কাটাতেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। একইসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যালের তৎকালীন আবাসিক সার্জ ডা. আজহারুল হক বর্হিবিভাগ দিয়ে নানা কৌশলে হাসপাতালে ঢোকাতেন আহত মুক্তিযোদ্ধাদের।’

চিকিৎসাসেবা মানব ধর্ম-সেটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে প্রতিটি পদে পদে চিকিৎসকরা শিখিয়েছেন, করে দেখিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তাদের ভূমিকা অনন্য এবং ব্যতিক্রমী বলেও মন্তব্য করেন ডা. ইকবাল আর্সলান।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এইসব মহান চিকিৎসকদের নিয়ে একটি বই লিখেছেন দ্যা ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভিলেন্স অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসম) পরিচালক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ। ২০০৯ সালে প্রকাশিত এই বইতে তিনি প্রায় ১০০ জন চিকিৎসকের এবং ১৫ জন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। তুলে ধরেন তাদেরকে কী নির্মমভাবে হত্যা করেছে পাকহানাদার বাহিনী এবং আলবদর আল-শামসরা।

ডা. বায়জীদ খুরশীদ জানান, সেসময় কেবলমাত্র রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকদের কথা তিনি এ বইতে উল্লেখ করতে পেরেছেন। পাশাপাশি রয়েছেন কয়েকজন হোমিওপ্যাথ, আর্য়ুবেদ এবং পল্লী চিকিৎসকের কথা। কিন্তু তাদের বিষয়ে বিস্তারিত সবকিছু উল্লেখ করতে পারেননি তথ্যের অভাবে। এ বইতে ১০০ জন চিকিৎসকের স্মৃতিচারণ করেছেন কারও স্ত্রী, কারও সন্তান আবার কারও নিকট আত্মীয়।

তবে কাজটি এতো সহজ ছিল না উল্লেখ করে ডা. বায়জীদ খুরশীদ হটনিউজ২৪বিডিকে বলেন, ‘২০০৯ সালে ১২ কোটি মানুষের মধ্য থেকে কেবলমাত্র নাম অথবা একটি সূত্রের খোঁজ ধরে এসব মহান বীরদের খুঁজে পাওয়াটা ছিল মহাকাশে উল্কাপিণ্ড খুঁজে পাওয়ার মতো। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) কেবল তাদের একটি তালিকা ছিল কাঠের ভেতরে খোদাই করা, কিন্তু তারা কারা, কীভাবে শহীদ হন খোঁজ নিতে গিয়ে কোথাও তথ্য পাচ্ছিলাম না তেমন করে। শুধু ঘুরে ফিরে কয়েকজনের নাম আসে, মিডিয়াতেও তাই, এই ভাবনা থেকেই বাকিদের বিষয়ে তথ্য জানতে গিয়ে, বাকিদের অবদান কী মুক্তিযুদ্ধে সেটা তুলে ধরার ইচ্ছা থেকেই কষ্টসাধ্য এই কাজটি আমি করেছি।’

ডা. বায়জীদ খুরশীদ হক আরও বলেন, ‘কেবলমাত্র এসব চিকিৎসকরাই নন, ঢাকা, রংপুর, চট্রগ্রাম, রাজশাহী এবং ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ১৫ জন শিক্ষার্থীর অবদানের কথাও এ বইতে উল্লেখ রয়েছি।’
অপরদিকে, শহীদ অধ্যাপক ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শহীদ চিকিৎসকদের চিকিৎদানের যে ভূমিকা সেটা অনেকেই জানেন, কিন্তু তাদের যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক ভূমিকা ছিল সেটা বলতে চাই। শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়মাস নয়, মুক্তিসংগ্রামের ২৩ বছরে তাদের একেকজনের যে অবদান তার উদাহরণ ডা. আলীম চৌধুরী। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে করেছে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হয়েছিল কিন্তু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেইন গেইটের কাছেই। আমার বাবা ডা. আলীম চৌধুরী কেবল বুদ্ধিজীবী চিকিৎসকই নন, তিনি একজন ভাষা সৈনিকও।’

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারোয়ার আলীকে রেফারেন্স করে নুজহাত চৌধুরী বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতেই সম্ভাব্য এক আঘাতের আশঙ্কায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে নয়টি উইংয়ে ভাগ করা হয়েছিল যেন ঢাকার ভেতরে মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসাসেবা পায় এবং সাধারণ জনগণের কোনও ক্ষতি না হয়। আর এর দায়িত্বে ছিলেন ডা. আলীম চৌধুরী এবং ডা. ফজলে রাব্বী।’

তিনি আরও জানান, এমনকি সীমান্তের ওপারে যে ক্যাম্প ছিল সেখানে আমার বাবার গাড়ির বনেট ভর্তি করে ওষুধ যেত, টাকা উঠিয়ে দেওয়া, তথ্য আদান-প্রদান এবং অস্ত্র এদিক-সেদিক হতো আমার বাবার ডাক্তারির চিহ্ন দেওয়া গাড়িতে করে। সাহসীকতার সঙ্গে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই এসব কাজ করেছেন ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরীরা যারা নেতৃত্বে ছিলেন।

উল্লেখ্য, চক্ষু বিশেষজ্ঞ আলীম চৌধুরীকে ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাজাকার-আলবদর বাহিনী তার বাসা থেকে নিয়ে যায় এবং ওই দিন রাতে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নির্মমভাবে হত্যা করে। ডা. ফজলে রাব্বীকে ১৯৭১ সনের ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে পাকবাহিনীর কয়েকজন সৈন্যসহ রাজাকার-আলবদরদের কয়েকটি দল তার সিদ্ধেশ্বরী বাসা থেকে নিয়ে যায় এবং ১৮ ডিসেম্বর দিনের বেলায় রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। শুধু ডা. ফজলে রাব্বী এবং ডা. আলীম চৌধুরীই নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক হানাদার বাহিনী হত্যা করে অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. আজহারুল হক, ডা. সোলায়মান খান, ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী, ডা. কসির উদ্দন তালুকদার, ডা. মনসুর আলী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, ডা. মফিজউদ্দীন খান, ডা. জাহাঙ্গীর, ডা. নুরুল ইমাম, ডা. এস কে লালা, ডা. হেমচন্দ্র বসাক, ডা. ওবায়দুল হক, ডা. আসাদুল হক, ডা. মোসাব্বের আহমেদ, ডা. আজহারুল হক (সহকারী সার্জন), ডা. মোহাম্মদ শফীকেও।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, কর্তৃপক্ষ এর দায়ভার নেবে না।

top